বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে ৫০০ কোটি টাকার বেশি জমা থাকলেও শ্রমিকের লাশ দাফনের সময় চাঁদা তুলতে হয়। এমনকি আবেদন জানিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও সহায়তা পাচ্ছেন না দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, কর্মহীন ও অসুস্থতার কারণে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত অসংখ্য শ্রমিক ও তাদের স্বজনরা। শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতাদের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. ওসমান গণি গণমাধ্যমকে বলেন, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে যে পরিমাণ অনুদান দেওয়ার দরকার তা আমরা পাই না। আমার হিসেবে শতকরা ১০ ভাগও পাই না। তিনি আরো বলেন, একজন শ্রমিক মারা গেলে সবার থেকে টাকা তুলে দাফনের ব্যবস্থা করতে হয়। মৃত্যুর পরেও অনেকের পরিবার কোনো টাকা পান না। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম শহিদুল আলম বলেন, তহবিলে টাকা পড়ে আছে, কিন্তু শ্রমিকরা ওইভাবে পায় না। অনেক সময় দলীয় বিবেচনায় টাকা দেওয়া হয়। এছাড়া তহবিল থেকে টাকা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এজন্য শেষে অনেকের আর আগ্রহ থাকে না।
তিনি বলেন, আমরা করোনার সময় মন্ত্রণালয়ে সাহায্যের জন্য আবেদন দিয়েছিলাম। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো, ডিসি অফিসে আবেদন দেওয়ার জন্য। সেটাও দিয়েছি, কিন্তু চার আনার সাহায্যও পাইনি। তিনি আরো বলেন, শ্রমিকরা অনেক অবহেলিত। দুর্ঘটনায় মারা গেলে তাদের খোঁজ নেওয়ার কেউ থাকে না। তাদের লাশ বাড়ি পাঠাতেও চাঁদা তুলতে হয়।
ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, শ্রমিক বাঁচলে কারখানা বাঁচবে। এজন্য শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে শ্রমিকদের দ্রুত আর্থিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। জানা গেছে, শ্রমিকদের স্বার্থে ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল গঠন করা হয়। শুরু থেকে চলতি বছরের ১৮ জুন পর্যন্ত ২০৩টি কোম্পানি শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে প্রায় ৫৫১ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। এ পর্যন্ত ১০ হাজার শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে ৩৯ কোটি ৭০ লাখ ৮০ হাজার টাকা অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে তহবিলে এখনো ৫১১ কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে। প্রতি বছরই এ তহবিলে জমার পরিমাণ বাড়ছে।
এ তহবিলের প্রধান উৎস হচ্ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মুনাফার অংশ। সরকারও এ তহবিলে অনুদান দেয়। এছাড়া বিনিয়োগ ও ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমেও তহবিলে অর্থ আসে। বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী-দেশি, বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানির নিট লাভের শতকরা পাঁচ শতাংশের এক দশমাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ তহবিল থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, আহত, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত শ্রমিকের চিকিৎসা ও তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য অনুদান দেওয়া হয়।
শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে শত শত কোটি টাকা জমা থাকলেও করোনা মহামারির মধ্যে গত এক বছরে মাত্র ১১ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ৩ হাজার ২৬৯ জন শ্রমিককে চিকিৎসা সহায়তা বাবদ ৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা, কর্মরত অবস্থায় মৃত ৯২ জন শ্রমিকের পরিবারকে ৩৯ লাখ ২০ হাজার টাকা ও শ্রমিকদের সন্তানের শিক্ষা সহায়তা বাবদ ১৬৬ জনকে ৫২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সংঘটিত দুর্ঘটনায় ১৫ জন আহত শ্রমিকসহ মোট ২৬ জন শ্রমিককে জরুরি চিকিৎসা সহায়তা বাবদ ১২ লাখ ১৫ হাজার টাকা ও সাত জন নিহত শ্রমিকের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা বাবদ ১৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, দেশে বিভিন্ন পেশার প্রায় সাত কোটি শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ১০ শতাংশের কম শ্রমিকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি রয়েছে। বাকি প্রায় ৯২ শতাংশ শ্রমিকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : নির্মাণ শ্রমিক, জাহাজভাঙ্গা শ্রমিক, গৃহশ্রমিক, মাটিকাটা শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, জেলে বা মৎস্য শ্রমিকসহ আরো অসংখ্য কারখানা এবং ক্যাটাগরির শ্রমিক রয়েছেন যাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি নেই।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭২৯ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে নির্মাণ খাতে ৮৪ জন, কৃষিখাতে ৬৭ জন, বিদ্যুৎখাতে ৩৫ জন, মৎস্যখাতে ২৭ জন, দিনমজুর ৪৯ জন, স্টিলমিল শ্রমিক ১৫ জন, নৌ-পরিবহন শ্রমিক ১৫ জন, মেকানিক ১৪ জন, অভিবাসী শ্রমিক ১৫ জন ও অন্যান্য খাতে ৬০ জন শ্রমিক মারা গেছেন।
শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন বিধিমালা অনুযায়ী, কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনাজনিত কারণে কোনো শ্রমিক দৈহিক বা মানসিকভাবে স্থায়ী অক্ষম হলে অথবা মৃত্যুবরণ করলে অথবা পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করলে এক্ষেত্রে এককালীন ২ লাখ টাকা দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে মরদেহ পরিবহন ও সৎকারের জন্য ২৫ হাজার টাকা ও জরুরি চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের জন্য ৫০ হাজার টাকা চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে মহাপরিচালক দিতে পারবেন, যা পরবর্তী বোর্ড সভায় অনুমোদিত হবে। এছাড়া কোনো শ্রমিকের দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য বোর্ডের অনুমোদনক্রমে ১ লাখ টাকা দেওয়া যাবে।
শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো মহাপরিচালক নিয়োগ হয়নি। শুরু থেকেই এ পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বর্তমানে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব বেগম জেবুন্নেছা করিম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেগম জেবুন্নেছা করিম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। আপনি অন্য কারো সঙ্গে কথা বলুন। কিন্তু দায়িত্বে তো আপনি রয়েছেন’- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দায়িত্বে থাকলেও আমি কথা বলতে পারব না।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে. এম. আব্দুস সালামকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি মিটিংয়ে আছি।’ পরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
