• বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বিদ্যুৎ নিয়ে চ্যালেঞ্জে সরকার

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ২৮ জুন ২০২১

করোনা মহামারি পরিস্থিতি না থাকলে দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দিতো বলে জানিয়েছেন  বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি জানান, ‘আমাদের কোনো উদ্বৃত্ত নেই। অনেকে বলে ৪-৫ হাজার মেগাওয়াট সারপ্লাস আছে। আমি খুঁজে পাই না যে কোথায় আছে। আজকে যদি এই মুহূর্তে ১৫ হাজার লাগে, আমি দিতে পারবো না। এ রকম অবস্থায় আছি। বৃষ্টি হচ্ছে এই সময়েও ১২ হাজার, সাড়ে ১২ হাজার চলে যাচ্ছে। কোভিড সিচুয়েশন যদি না থাকতো, তাহলে ১৫-১৬ হাজার  যেত। তাহলে কিন্তু ডিফিকাল্ট হতো।’

করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে আদালতের কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। এছাড়া, মহামারির ছোবলে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিল্প কারখানা, কমে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন। ফলে মহামারির উত্তর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। কিন্তু জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী করোনাত্তোর বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটানো নিয়ে চিন্তিত সরকার। কিন্তু উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে সরকারের সামনে রয়েছে নানামুখি চ্যালেঞ্জ।

চাহিদা মেটাতে নেপাল থেকে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনতে আগামী মাসে চূড়ান্ত চুক্তির কথা জানিয়েছেন নসরুল হামিদ বিপু। এছাড়া, বিদেশ থেকে চড়ামূল্যে আমদানি করা এলএনজি থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশ্লেষকদের মতে, যা হবে অনেক ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের জন্যও হুমকিস্বরূপ। এদিকে, নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে না পারায় ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প বাতিল করেছে। অথচ এই ১০টি কেন্দ্র থেকে নয় হাজার ৩৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। বর্তমানে আরো ১৯ টি কয়লাভিত্তিক প্রকল্প চলমান রয়েছে। কিন্তু বন্ধ করে দেওয়া ১০ টি কেন্দ্র থেকে লক্ষ্যমাত্রার ৯ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ কোথা থেকে পূরণ হবে সেটি এখনো অনির্ধারিত। অন্যদিকে, পরিবেশবিদরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতা করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। একারণে, ১০টি কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সরকারকে ‘সতর্ক’ সাধুবাদ জানিয়েছেন তারা। তবে রামপাল, মাতারবাড়ি ও মিরসরাইসহ বাকি ১৯টি নিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে যথারীতি উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। একইভাবে, সরকারের নতুন করে এলএনজি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্তেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সরকারকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘১০টি কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত সরকারের বোধোদয় হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে, সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অধিকতর সচেষ্ট হবে এবং সংশোধন হতে যাওয়া বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনায় কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে পুরোপুরি সরে আসার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হবে।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান এলএনজি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্তে টিআইবির উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘সরকার বাতিলকৃত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবর্তে ব্যয়বহুল এলএনজি এবং জ্বালানি তেলনির্ভর কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। যেটি বাংলাদেশকে ২০৩০ সলের মধ্যে এশিয়ার অন্যতম কয়লা ও কার্বন দূষণকারী দেশে রূপান্তরিত করবে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সাথে সাংঘর্ষিক বিধায় কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।’

পরিবেশবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা সরকারকে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। টিআইবির মতে, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও, এই উৎসগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনো সুনির্দিষ্ট পথরেখা এখনো সরকার প্রণয়ন করেনি। ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি থাকলেও বর্তমানে প্রতিদিন মাত্র ৭ শত ৩০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন হচ্ছে, যা মোট উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ক্রমশ হ্রাস পেলেও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব এবং এ খাতকে পর্যাপ্ত গুরত্ব প্রদান না করায়, ২০২১ সালেও নির্ধারিত লক্ষ্যের অর্ধেকও অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া, সরকার ২০৫০ সাল নাগাদ শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

কিন্তু সরকার বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প অনেক ব্যয়বহুল। পাশাপাশি এ ধরনের প্রকল্পের জন্য অনেক জমির প্রয়োজন। জমি স্বল্পতার জন্য সৌরবিদ্যুতের বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

তিনি জানান, ২০৪১ সালে নবায়ণযোগ্য জ্বালানির অংশ ৪০ ভাগ হবে। ৫৮ লাখ সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে প্রায় ২ কোটি গ্রামীণ জনগণকে বিদ্যুৎ সেবা দেওয়া হচ্ছে। নেট মিটারিং সিস্টেমের মাধ্যমে রূপটপ সোলার জনপ্রিয় বিজনেস মডেল হতে যাচ্ছে।

এদিকে, গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করছে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশই অব্যবহূত থাকছে। গত ২০ জুন অনুষ্ঠিত এক ওয়েবিনারে সংস্থাটি গত ১৬ মে উৎপাদিত বিদ্যুতের হিসাব উল্লেখ করে এই তথ্য তুলে ধরে।

সিপিডি বলছে, ওইদিন অধিকাংশ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়নি। ক্যাপাসিটি পেমেন্টের জন্য কোনো কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার ইউনিট প্রতি ব্যয় হয়ে যায় দেড় হাজার টাকা। তাই ২০৩০ সাল সামনে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্তন করা দরকার।

বিদ্যুৎ খাত নিয়ে তুলে ধরা গবেষণা নিবন্ধে সিপিডি বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অধিকাংশ অলস পড়ে থাকছে। বিদ্যুৎ না নিলেও চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে টাকা দিতে হচ্ছে। এটি ‘ক্যাপাসিটি পেমেন্ট’ হিসেবে পরিচিত, যা বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে লোকসানের চক্র থেকে বের হতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads