• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
এত মৃত্যু দেখেনি বাংলাদেশ

ছবি: বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

এত মৃত্যু দেখেনি বাংলাদেশ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৬ জুলাই ২০২১

কোনোভাবেই করোনার লাগাম টানা যাচ্ছে না। তীব্রগতিতে বাড়ছে। মহামারি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কমছে না উদ্বেগ ও শঙ্কা। গত কয়েকদিন ধরে টানা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মৃত্যু বাড়তে বাড়তে গতকাল সোমবার পর্যন্ত তা ১৫ হাজার ২২৯ জনে পড়ল। এর মধ্যে গতকালই মারা গেছে ১৬৪ জন, যা দেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর নতুন রেকর্ড। একদিনে এত মৃত্যু আগে দেখেনি বাংলাদেশ। কবরস্থানগুলোতে দীর্ঘ হচ্ছে নতুন কবরের সারি।

এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় এভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে বলে অভিযোগ নাগরিকসমাজের। অন্যদিকে এ অভিযোগ মানতে চাইছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষের অসচেতনতায় করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীন হচ্ছে। কারণ অনেকেই সংক্রমিত হলেও সাধারণ সর্দিজ্বর বা কাশিতে আক্রান্ত বলে ধরে নিচ্ছেন। তারা নমুনা পরীক্ষা বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না।

এরই মধ্যে সারা দেশে চলমান কঠোর লকডাউনের পঞ্চম দিনে দেশে সর্বোচ্চ ১৬৪ জনের মৃত্যুর খবর দিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ২২৯ জনে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা পজিটিভ হয়েছেন ৯ হাজার ৯৬৪ জন। এ নিয়ে দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮১ জন।

গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ৬০৫টি ল্যাবে করোনার ৩৪ হাজার ২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্ত হার ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। সার্বিক শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন আরও ৫ হাজার ১৮৫ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৮ লাখ ৩৯ হাজার ৮২ জন। সুস্থতার হার ৮৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত একদিনে মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১০৯ জন, নারী ৫৫ জন। তাদের মধ্যে বিশোর্ধ্ব ৪, ত্রিশোর্ধ্ব ১২, চল্লিশোর্ধ্ব ১৮, পঞ্চাশোর্ধ্ব ৪৭ ও ষাটোর্ধ্ব ৮৩ জন।

বিভাগ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে। এরপরই রয়েছে ঢাকা বিভাগ, ৪০ জন। এ ছাড়া, রাজশাহীতে ১৬, চট্টগ্রামে ১৮ জন, বরিশালে ৯, সিলেট ৮, রংপুর বিভাগে ১৬ ও ময়মনসিংহে বিভাগে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এর আগে রোববার (৪ জুলাই) একদিনে করোনায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫৩ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া গত ২৭ জুন মারা যান ১১৯ জন, এরপর ৩০ জুন মারা যান ১১৫ জন, ১ জুলাই ১৪৩ জন, ২ জুলাই মারা যান ১৩২ জন, ৩ জুলাই ১৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৩০ জুন মারা যান ১১৫ জন।

এদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, সোমবার (৫ জুলাই) সকাল ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে মারা গেছেন আরও ৬ হাজার ৭ জন এবং আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ২৭ হাজার ৮৫৭ জন।

 

এ নিয়ে বিশ্বে এখন পর্যন্ত মোট করোনায় মৃত্যু হলো ৩৯ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৯ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ কোটি ৪৫ লাখ ৬২ হাজার ৫১ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৬ কোটি ৮৯ লাখ ৭ হাজার ১৮১ জন।

করোনায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত হয়েছেন ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৯২ হাজার ৩৭৭ জন। মৃত্যু হয়েছে ৬ লাখ ২১ হাজার ২৯৩ জনের।

আক্রান্তে দ্বিতীয় ও মৃত্যুতে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে এখন পর্যন্ত মোট সংক্রমিত হয়েছেন ৩ কোটি ৫ লাখ ৮৪ হাজার ৮৭২ জন এবং এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ৪ লাখ ২ হাজার ৭৫৮ জনের।

আক্রান্তে তৃতীয় এবং মৃত্যুতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত করোনায় এক কোটি ৮৭ লাখ ৬৯ হাজার ৮০৮ জন সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৪৭৫ জনের। আক্রান্তের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ফ্রান্স। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৭ লাখ ৮৬ হাজার ২০৩ জন। ভাইরাসটিতে মারা গেছেন এক লাখ ১১ হাজার ১৬১ জন।

এ তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে রাশিয়া। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ৫৬ লাখ ১০ হাজার ৯৪১ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন এক লাখ ৩৭ হাজার ৯২৫ জন।

এদিকে আক্রান্তের তালিকায় তুরস্ক ষষ্ঠ, যুক্তরাজ্য সপ্তম, আর্জেন্টিনা অষ্টম, কলম্বিয়া নবম ও ইতালি দশম স্থানে রয়েছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩০তম।

এদিকে করোনায় এমন মৃত্যু ভারী করে তুলেছে অনেক পরিবারকে। স্বজনরা করোনার শুরুতে দাফনে অংশ নিতে না পারলেও এখন নিয়মিত যাচ্ছেন কবরস্থানে। রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থান। দেশের সবচেয়ে বড় এই কবরস্থানে সারি সারি নতুন কবর। এই কবরস্থানের একটা বড় অংশজুড়ে দাফন করা হয়েছে করোনা আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন তাদের দেহ। কেউ স্ত্রী, কেউ মা, কেউ বাবা, কেউ আবার এসেছেন ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে। চাপা কান্নায় তারা অংশ নেন দোয়া ও মোনাজাতে।

ঢাকার একটি স্কুলে বুয়ার কাজ করা মমতাজ বেগম এসেছেন তার স্বামীর কবর পরিচর্যায়। মাসখানেক আগে দারোয়ানের কাজ করা তার স্বামী মারা যায় করোনা আক্রান্ত হয়ে। শুধু রায়েরবাজার কবরস্থানেই এ পর্যন্ত দাফন করা হয়েছে এক হাজার তিনশ জনের দেহ। যারা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। করোনার ভয়াবহতা উপলব্ধির বড় একটি জায়গা এই কবরস্থান। যে মানষগুলো কদিন আগেই নিশ্বাস নিয়েছিলেন পৃথিবীর বুকে, আমাদেরই সাথে, তারা আজ শায়িত আছেন এই কবরগুলোতে। তাজা এই কবরগুলোর পাশে খুঁড়ে রাখা হয়েছে আরো কিছু সারিবদ্ধ কবর। এ অবস্থায় করোনার এই ভয়াল থাবা শেষ হোক, এটাই সকলের প্রত্যাশা।

অন্যদিকে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন-এক বছর আগে সব জেলায় নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্র (আইসিইউ) বসানোর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ কারণে করোনা যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তখন আইসিইউ সংকটে মানুষ মারা যাচ্ছে।

বিবৃতিতে তিনি বলেন, দেশের ৩৫ জেলায় এখনো আইসিইউ নেই। সব জেলায় আইসিইউ স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের আইসিইউ’র ৭৬ ভাগই ঢাকা বিভাগে, এর মধ্যে রাজধানীতেই ৭৩ ভাগ। আইইডিসিআর’বির তথ্যমতে, গেল জুন মাসে করোনা শনাক্তের ৭৮ ভাগই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। তাই করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য আইসিইউ এর চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সব জেলায় আইসিইউ না থাকায় কঠোর লকডাউনের মাঝে করোনা রোগী নিয়ে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছোটাছুটি করছে স্বজনরা।

এদিকে ভ্যাকসিন প্রত্যাশীদের বয়সসীমা পুনর্নির্ধারণ করে ৩৫ বছর করেছে সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ছাড়াও কৃষক ও শ্রমিকরা এই বয়সসীমার আওতায় করোনার ভ্যাকসিন পাবেন। মডার্নার ভ্যাকসিন সংরক্ষণ সুবিধা সারাদেশের সাতটি সিটি করপোরেশন এলাকায় দেয়া হবে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করোনার ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দেওয়া শিক্ষার্থীদের তালিকা আইসিটি মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নাম নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হয় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, করোনা পরিস্থিতি গ্রামে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। দেশের মোট করোনারোগীর ৫০ শতাংশই গ্রাম এলাকার। গ্রামের মানুষের অনেকেই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেও সাধারণ সর্দিজ্বর বা কাশিতে আক্রান্ত বলে ধরে নিচ্ছেন। তারা নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না। রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হওয়ায় তারা হাসপাতালে আসছেন।

তিনি জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের সঙ্গে অলাইনে আমরা বৈঠক করেছি। গ্রামের রোগীরা হাসপাতালে আসছেন রোগে আক্রান্ত হওয়ার বেশ পরে, যখন পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্রামে গ্রামে মাইকিং করার পরামর্শ দিয়েছি। বাড়ি বাড়ি রোগীর খোঁজ রাখতে বলেছি। এখন বর্ষার মৌসুম। সর্দিজ্বরে বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে এটা স্বাভাবিক। তাই সবাই যাতে করোনা পরীক্ষা করতে পারে সেজন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর করোনা পরীক্ষা বিনামূল্যে করেছে সরকার।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২১৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯। এরমধ্যে বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে গত বছরের ৮ মার্চ। ওই বছর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর সংবাদদেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads