• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

প্রধানমন্ত্রীর উপহার প্রকল্পেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০২১

বাংলাদেশে সরকারি প্রকল্পে অনিয়ম আর দুর্নীতি এখন অবাক করার মতো কোনো খবর নয়। কত উপায়েই না প্রকল্পের অর্থ নয়ছয় হয়। এবার হতদরিদ্র ভূমিহীনদের প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেওয়া ছোট্ট কুটির নির্মাণ প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগে হতবাক হয়েছে জনগণ। সম্প্রতি নির্মাণ করে দেওয়া এসব ঘর কোথাও ধসে পড়েছে, কোথাও পানির নিচে, আবার কোথাওবা ঘরের নিচ থেকে সরে যাচ্ছে মাটি। এখনো দাঁড়িয়ে থাকা ঘরগুলোতে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে বাসিন্দাদের।

বিশ্লেষকদের অভিমত, প্রকল্প মানেই কিছু মানুষের সম্পদ ও অর্থ গ্রাসের মাধ্যম। দুঃখজনকভাবে এই প্রকল্পেও এমনটাই ঘটেছে। অন্যদিকে প্রকল্পের পরিচালক বলছেন, প্রকল্পে কোন অর্থ আত্মসাৎ হয়নি। নিচু জমি ভরাট করে উন্নয়ন করায় এমনটি হয়েছে। তবে অভিযুক্ত এলাকায় কোনো দুর্নীতি হয়েছে কি না, তা তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।    

মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জেলায় আশ্রায়ন-২ প্রকল্পের আওতায় মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০টি ঘর উপহার দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের আওতায় প্রথম দিকে ঘর প্রতি নির্মাণ ব্যয় দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। কিন্তু নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়া পরবর্তীতে ঘর প্রতি বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা। সবশেষ চলতি বছরের ৮ মার্চ বরাদ্দ বাড়িয়ে ঘর প্রতি নির্মাণ ব্যয় দেওয়া হয় দুই লাখ টাকা। প্রকল্প সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত আশ্রয়ণ প্রকল্প ও আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে সর্বমোট ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫৬২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার। এর মধ্যে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকার থেকে প্রকল্পের ঘর ধসে পড়া বা পানিতে ডুবে যাওয়ার খবর আসছে। দেশের ২২ জেলার ৩৬ উপজেলায় এমন অভিযোগের দায়ে গত মঙ্গলবার উপসচিব ও ইউএনও পর্যায়ের ৫ কর্মকর্তাকে ওএসডি করেছে সরকার। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ও প্রকল্পের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের দাবি, কোনো ছাড় নয়, যে-কোনো মূল্যে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

১৯৯৭ সালের ১৯ মে কক্সবাজার জেলাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হওয়ায় বহু পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছর ২০ মে এলাকাটি পরিদর্শনে যান। তিনি মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন এবং সকল গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজারের স্থানীয় একজনের দানকৃত জমিতে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙন কবলিত ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। কক্সবাজার জেলা হতেই শুরু হয় ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবার পুনর্বাসনের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের কার্যক্রম এখন সারা দেশে দেশে ছড়িয়ে পরেছে। সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ১৯৯৭ সাল থেকে জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত চারটি ফেজে আশ্রয়ণ প্রকল্পে মোট ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫৬২টি পরিবার পুনর্বাসন করা হয়। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২২। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী এ প্রকল্প মাধ্যমে ২০২২ সালের মধ্যে তালিকভুক্ত প্রায় আরো চার লাখ গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসন করার জন্য কাজ চলছে।

এদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন মডেল হিসেবে নির্মিত এসব বাড়ি পেয়ে যারা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন বছর ঘুরতে না ঘুরতে কিছু কিছু জায়গায় সেই স্বপ্ন আজ ফিকে হয়ে আসছে। ভূমিহীনদের সমাজের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে যেসব নতুন গ্রাম তৈরি করা হলো। সেসব স্থাপনা এখন কোথাও পানির নিচে, আবার কোথাওবা ঘরের নিচ থেকে সরে যাচ্ছে মাটি। বগুড়ার সদর উপজেলার চাঁদমুহার এ ঘরের বাসিন্দারা ঠিক যতটা খুশি হয়েছিলেন নতুন বাড়ি পেয়ে। এখন ততটাই আক্ষেপ এখন নির্মাতাদের ওপর।

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বালুয়াকান্দি ইউনিয়নের বড় রায়পাড়া গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরটির একটি পিলারসহ বারান্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, সোমবার সকালে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘটনার সময় ঘরে মানুষ ছিল না। দুই ঘরের মাঝখান দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে পানি যাচ্ছিল। এতে বারান্দার অংশসহ পিলার ভেঙে যায়। ঘরগুলোর আনুষঙ্গিক কাজ এখনো শেষ হয়নি। যেসব ঘরের বালু সরে গেছে সেখানে বালু ফেলা হবে। ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে তৈরি এই ঘর মেরামতে ৬-৭ হাজার টাকা লাগবে।

বগুড়া শাজাহানপুর উপজেলার আশ্রয়ণ প্রকল্পের সবগুলো নতুন ঘর পানিতে ওপরে ভাসছে। ফলে গত কয়েকদিন ধরে সেখানে থাকা নয়টি পরিবার চরম দুর্ভোগে আছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে এমন নিচু জায়গাতে ঘর করা নিয়ে স্থানীয় লোকজন কাজ শুরুর পর থেকেই আপত্তি তুলেছিলেন। তাদের দাবি ছিল, গৃহ নির্মাণে সমতল মাটির নীচে ইট ব্যবহার করেনি মিস্ত্রিরা। এ ছাড়া নিম্নমানের ইট, বালি, রড, কাঠ ও অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহারে অনিয়ম করা হয়েছে বলে জানান তারা। এ জন্য স্থানীয়রা তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা পারভীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। তবে সব বাধা উপেক্ষা করেই তৎকালীন ইউএনও সেখানে ঘর নির্মাণ করেন।

এছাড়া বগুড়ার শেরপুর উপজেলার আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে নির্মিত সাতটি ঘর বসবাস শুরুর আগেই ভেঙে পড়েছে। বর্ষায় টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে এসব ঘরের এক পাশের মাটি ধসে পড়েছে খালে।

এ ছাড়া কুড়িগ্রামের চিলমারী, রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙা, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে, গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার মধুপুর, বরগুনায় তালতলী উপজেলার করইবাড়িয়া ইউনিয়নের বেহেলায়, বরিশালের আগৈলঝাড়ায় উপজেলার বাগধা ইউনিয়নের জোবারপাড় (রামদেবেরপাড়) গ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আরো কয়েকটি ঘরও ধসে পড়েছে। আবার কিছু কিছু প্রকল্পের এলাকা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হতদরিদ্রের দানের একটু খানি কুটির নির্মাণেও দুর্নীতি হয়, এটা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পকে যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ বা হাইপ্রোফাইলের প্রকল্পে দুর্নীতি প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশে প্রকল্প মানেই কিছু মানুষের সম্পদ গ্রাসের মাধ্যম। দুঃখজনকভাবে এই প্রকল্পেও এমনটাই ঘটেছে। বিষয়টি জরুরিভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এর সঙ্গে কোনো কোনো কর্মকর্তা, ঠিকাদার বা স্থানীয় অন্য কোনো প্রভাবশালী কেউ যুক্ত থাকলে তা খুঁজে বের করতে হবে। আইন অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের এ প্রকল্পে দুর্নীতি ও গাফিলতির অভিযোগে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ যে পাঁচ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে তারা হলেন- বরগুনার আমতলী উপজেলার ইউএনও আসাদুজ্জামান, বর্তমানে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শফিকুল ইসলাম, মুন্সীগঞ্জ সদরের এসিল্যান্ড শেখ মেজবাহ-উল-সাবেরিন ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রুবায়েত হায়াত শিপলু এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক লিয়াকত আলী শেখ। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালিত এ প্রকল্প নিয়ে কেন গাফিলতি হচ্ছে, কারা দেখাচ্ছে এ দুঃসাহস। এমন প্রশ্নের জবাবে নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি অভিযোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হচ্ছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যে-কোনো সময় আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাকি ঘরগুলোও ভেঙে পড়তে পারে। ভাঙন আতঙ্কে তারা দিনাতিপাত করছেন।

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের-২-এর পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন বলেন, প্রতিটি বিষয় আমরা তদন্ত করেছি। আর তদন্তের আলোকে যারা দায়ী হবেন সরকারি বিধি অনুসারে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। দেশব্যাপী নির্মিত এসব ঘর নিয়ে কারো অভিযোগ থাকলে তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় কিংবা জেলা প্রশাসকের দপ্তর এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও অবহিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও বেশকিছু জায়গাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে গেছে। উপজেলা পর্যায়ে বেশকিছু কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো যেটা থাকা দরকার সেটাকে পরীক্ষা না করে করেছে। তারা শৈথিল্য সেখানে দেখিয়েছে, আমরা কিন্তু সেটা দেখাব না। এ ক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স দেখাব। ছিন্নমূলদের আবাসন নিয়ে নয়ছয় করা কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত চাকরি হারাতে পারেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্বস্ত করছে, ছাড় দেওয়া হবে না কাউকেই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads