• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯
‘গাড়ি চললেও ঘুরবে না ভাগ্যের চাকা’

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

‘গাড়ি চললেও ঘুরবে না ভাগ্যের চাকা’

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৫ জুলাই ২০২১

কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করে আট দিনের জন্য গণপরিবহন চলাচলের সুযোগ করে দেওয়ার পরও আশা দেখছেন না পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা।

গতকাল বুধবার রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন হতাশার চিত্র পাওয়া গেছে।

তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই ধাপে ধাপে বিধিনিষেধে প্রায় চলাচল বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন। তাই অনেকটাই সংকটের মুখে সড়ক পরিবহন খাত। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। এ ছাড়া মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো নয়।

যাত্রী পরিবহন করতে হবে ধারণক্ষমতার অর্ধেক। এ অবস্থায় ঈদে মানুষ কতটা গ্রামমুখী হবে, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের। দূরপাল্লার গাড়ি চালিয়ে ভাগ্যের চাকা আদৌ ঘুরানো সম্ভব হবে কি না, সেটা নিয়ে ভাবছেন তারা।

পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে গণপরিবহন চলাচল, দোকান-শপিংমল খুলে দেওয়াসহ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিয়ে চলমান বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। ১৪ জুলাই (গতকাল) মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত বিধিনিষেধ শিথিল করে গত মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

একই সঙ্গে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত ফের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আগামী ২১ জুলাই বুধবার দেশে মুসলমানদের দ্বিতীয় বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপিত হবে। সায়েদাবাদে দূরপাল্লার বিভিন্ন বাসের টিকিট বিক্রি করেন মো. আলী হোসেন। তিনি বলেন, ‘পরিবহন লাইনের সবার অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক দিন পর গাড়ি চলবে, মালিক-শ্রমিকরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘এ খাতের মূল দুটি সিজন দুই ঈদ। কিন্তু সবকিছু মিলে মনে হচ্ছে না আহামরি কিছু হবে। কারণ পকেটে টাকা থাকলে বাড়ি যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা থাকে মানুষের। সবারই অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। ঈদ এলেও পরিস্থিতি তো স্বাভাবিক নয়। মানুষের মনেও তো ভয় আছে করোনা নিয়ে। খুব জরুরি না হলে কেউ স্থান ত্যাগ করবে না। তাই আমগো ভাগ্যের উন্নতি হবে বলে তো মনে হয় না।’

একটি বাসের চালক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এভাবে গাড়ি বন্ধ থাকলে আমরা ক্যামনে চলমু। আমাগো চলার তো রাস্তা নাই। এতদিন বন্ধের পর এক সপ্তাহ টাইম দিছে, তাও দুই সিটে একজন। কী অইব বলেন? আমগো সারা মাস গাড়ি চালাইতে দেন, আমরা একজন কইরাই যাত্রী টানমু। এটাই আমগো দাবি।’

তিনি বলেন, ‘আমগো আর কান্দাইয়েন না। আমরা দুই ছেলে, স্ত্রী আছে। বলতে গেলে এতদিন ভিক্ষা করে সংসার চালাইছি।’

বাসের মালিক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘একটা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হইতেও তো কিছুটা সময় লাগে। এর মধ্যে মাত্র আটদিন খোলা। আবার দুই সিটে যাবে একজন, কিন্তু দুই সিটের ভাড়া তো পাওয়া যাবে না। যতটা পারছি বসাইয়া বসাইয়া শ্রমিকদের বেতন দিছি, যা পরিস্থিতি তাতে খুলে দিলেও খরচ ওঠানো যাইব কিনা কে জানে।’

কুমিল্লা রুটে চলাচলকারী একটি গাড়ির চালক হোসেন মিয়া বলেন, ‘ঈদে বাড়ি গেলেও ঈদের পরদিনই আপনাকে আবার ছুটতে হবে। এরপর আবার ১৪ দিনের লকডাউন। মানুষ তো বেকায়দায় না পড়লে কোনো জায়গায় যাবে না।’

বাসের সুপারভাইজার মো. নবী হোসেন বলেন, ‘গত বছর লকডাউনের সময় ১০ হাজার টাকা কিস্তি উঠাইয়া ঘর ভাড়া দিছি। সেই কিস্তি এখনো শোধ করতে পারি নাই। এর মধ্যে কাজকাম বন্ধ। লকডাউনে আমগো মরা ছাড়া উপায় নেই। এখন খুলছে প্রতিদিন ৫০০-৭০০ টাকা ইনকাম হইব। একদিন ইনকাম হইব দুদিন খাইতে অইব। আটদিনে কী কদ্দুন কী অইব?’

ঢাকা কেন্দুয়া রুটের একটি বাসের চালক মফিজুল ইসলাম রনির তিন মেয়ে, এক ছেলে। থাকেন নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকায়। বৃহস্পতিবার (আজ) থেকে গাড়ি চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে আমরা পুরাই বসা। এতদিন ঋণ করে কষ্ট করে চলেছি। গাড়ি খুলে দিয়েছে ভালো সিদ্ধান্ত। এতদিন গাড়ি বন্ধ কোনো সহযোগিতা পাই নাই আমি। সরকার বলছে সহযোগিতা করব, আমরা তো কিছুই পাইলাম না, কোনো সংগঠন থেকেও কিছু পাইনি।’

মহাখালি বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় বাস চালক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি টাঙ্গাইলগামী একটি পরিবহনের চালক। তিনি বলেন, এই চলল, এই থামল, এমন পরিস্থিতিতে কিছুই সুখের হয় না। আমাদের উপার্জন তো খুব কম। আমরা জমাতে পারি না। বাস চললে খেতে পারি। না চললে পুরো পরিবারসহ কষ্ট করি।

মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দিনে চার শতাধিক বাস বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল জেলায় চলাচল করে। এছাড়া ওই টার্মিনাল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ সিলেটে আরো দেড় শতাধিক বাস যাত্রী পরিবহন করে।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, টার্মিনালের ভেতর তিন শতাধিক দূরপাল্লার বাস সারিবদ্ধভাবে পার্কিং করা রয়েছে। এরমধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বাসে ধোঁয়া-মোছার কাজ করছেন চালক ও শ্রমিকেরা। ইঞ্জিন চালু দিয়ে পরীক্ষাও করছেন তারা।

সমান তালে চলছে নিজ নিজ পরিবহন টিকিট কাউন্টার পরিষ্কারের কাজ। টার্মিনালের দ্বিতীয় তলায় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়ে আসা-যাওয়া করছেন বিভিন্ন পরিবহনে মালিকরা। টার্মিনালের ভেতর ফুটপাতে হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসছেন হকাররা।

রিফাত পরিবহনের চালক সাব্বির হোসেন। বেলা ১১টার দিকে তিনি টার্মিনালে আসেন। বাস পরিষ্কার করে ইঞ্জিন চালু দেন। আলাপকালে তিনি বলেন, এই অল্প সময়ের জন্য গণপরিবহন চালুর কোনো দরকার ছিল না। কারণ ঈদে ঘরমুখো মানুষের কারণে সব সড়কেই যানজট থাকে। চাইলেও বেশি যাত্রী নেওয়া সম্ভব না।

তিনি বলেন, লকডাউনে কাজ বন্ধ থাকায় তাদের অনেক শ্রমিকের চার-পাঁচ মাসের ঘর ভাড়া বাকি। এখন কাল থেকে গণপরিবহন চালু হলে বকেয়া ভাড়ার জন্য চাপ দেবেন মালিকরা।

মহাখালী আন্তঃজেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহ-সভাপতি শওকত আলী বাবুল বলেন, অনেক পরিবহন মালিক ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের সুদে টাকা নিয়ে বাস কিনেছেন। করোনার সময় বাস বন্ধ থাকলেও ব্যাংক সুদ নেওয়া বন্ধ করেনি।

তিনি বলেন, শ্রমিকদের বেতন-ভাতাও কম-বেশি দিতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে লকডাউনেও দূরপাল্লার বাস চলতে পারে। সরকার গণপরিবহন চালু রাখলে লাখ লাখ পরিবহন মালিক শ্রমিক বেঁচে যাবে।

এনা পরিবহনের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মাঈন উদ্দিন। তিনি বলেন, লকডাউনের এ সময়ে তারা তাদের পরিবহনের সব শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। এখন মাত্র আট দিনের জন্য বাস চালু করতে বলেছেন পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads