• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
বাগেরহাটে করোনাকালীন পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা

প্রতিনিধির পাঠানো ছবি

জাতীয়

বাগেরহাটে করোনাকালীন পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা

  • এস এম সামছুর রহমান, বাগেরহাট
  • প্রকাশিত ৩১ জুলাই ২০২১

নানা ধরনের সংকট, সীমাবদ্ধতা ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলছিল বাগেরহাটের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা। এসবের সাথে নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত হয়েছে করোনা ভাইরাস। সুধু স্বাস্থ্য সেবা নয়,পরিবার পরিকল্পনা সেবারও বেহাল দশা বাগেরহাটে। এনিয়ে সচেতন মহলে রয়েছে ক্ষোভ। তবে জেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের দাবী তারা সাধ্যানুযায়ী জনসাধারনকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

নয়টি উপজলো ও তিনটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ ২৮ হাজার। এই জনসংখ্যার জন্য সরকারিভাবে রয়েছে ১৮টি চিকিৎসা কেন্দ্র। দীর্ঘদিন যাবৎ নজিরবিহীন চিকিৎসকের পদ শূন্যতায় ব্যহত হচ্ছে জেলাবাসীর স্বাস্থ্যসেবা। করোনাকালীন সময়ে এই সংকট আরো প্রকট আকার ধরণ করেছে।

এর মধ্যে সাধারণ মানুষের শেষ ভরসা বাগেরহাট সদর হাসপাতাল। চিকিৎসক ও জনবল সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জারিত এই হাসপাতালটি। জনবল সংকটের সত্যতা স্বীকার করেছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগও। তারা বলছে,বিষয়টি একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সুত্রে জানা গেছে,বাগেরহাট জেলায় একটি ১০০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতাল, ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৮টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১টি বক্ষ্য ব্যাধী হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসকের ২৫৪টি পদের মধ্যে ১২৯টি পদ শুন্য রয়েছে। বাকি ১২৫ জনের মধ্যে ৫ জন দীর্ঘদিন ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন।

অপরদিকে সেবিকা ৩০০টি পদের বিপরীতে রয়েছেন ২৮৮জন। ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী ৯৮৪ জনের মধ্যে রয়েছে ৬৫৯ জন, ৪র্থ শ্রেণীর ২১৬ জনের মধ্যে ১৭৫ জন। উপজেলাগুলোতে কোথাও যন্ত্রপাতি থাকলে তার পরিচালকের(অপারেটর) পদ শুণ্য, আবার কোথায় যন্ত্রপাতি নেই,অথচ তার পরিচালক রয়েছেন দীর্ঘদিন। এসব অব্যবস্থা ও সমন্বয়হীনতার ফলে দারুনভাবে স্বাস্থ্যসেবা ব্যহত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, দীর্ঘদিন যাবৎ নজিরবিহীন চিকিৎসকের পদ শূন্যতায় বাগেরহাট সদর হাসপাতালটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসা সেবা দেয়ার লোকের অভাবের রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় অন্যত্র। ফলে অসহায়, দরিদ্র-পিড়ীত, অসুস্থ মানুষদের সীমাহীন দূর্ভোগের পাশাপাশি অনাকাঙ্খিত মৃত্যু ও ভোগান্তির হার ক্রমেয় বেড়ে চলছে। করোকালীন এই মাত্রা আরো অনেকগুণ বেড়ে গেছে। জেলার প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্রের এই দুরাবস্থায় এখানে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ক্রমশ ক্ষোভ বাড়ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৭ সালে বাগেরহাট সদর হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ৩ বছরের মাথায় ১৯৭০ সালে ৫০ টি শয্যা নিয়ে হাসপাতালের যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৯৯২ সালে আধুনিক হাসপাতাল হিসেবে ১০০ শয্যায় উন্নীত করার কথা থাকলেও ৯৭ সালে ১০০ শয্যায় রূপান্তরিত হয়। আর সেই ১০০ শয্যার জনবল নিয়েই চলছে সদর হাসপাতালের কার্যক্রম।

বাগেরহাট সিভিল সার্জন অফিসের জেলা পরিসংখ্যানবিদ মো. আব্দুল বাসিত জানান, বাগেরহাট সদর হাসপাতালে কনসালট্যান্টে চিকিৎসকের ১২ টি পদের মধ্যে ৭টিই শূন্য। সার্জারি, চক্ষু, গাইনী, কার্ডিওলজি,অর্থো- ট্রমেটিক, এ্যানেস্থেশিয়া-জুনিয়র, রেডিওলজিতে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। সাধারণ চিকিৎসকের ১২ টি পদের ৯টি শূন্য।

সদর হাসপাতাল থেকে সামনে বের হলেই রয়েছে বক্ষব্যাধি ক্লিনিক। যা মাত্র একজন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চলছে এই সরকারী ক্লিনিকটি। দীর্ঘদিন এই বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের এক্সরে মেশিনটি নষ্ট রয়েছে। আর এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের নানা দালাল চক্রের হাতে হয়রানীরও অভিযোগ রয়েছে। এমন ঘটনার সত্যতাও খুঁজে পাওয়া গেছে রোগী হিসেবে সেখানে গিয়ে।

বাগেরহাটের ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালটির পাশে আরেকটি পাঁচতলা ভবন করে আড়াইশ শয্যায় উন্নীত করা হয় তিন বছর আগে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ না দেওয়ায় ভবনটি একপ্রকার খালি পড়ে ছিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ওই ভবনটিতে ৫০ শয্যার কোভিড ডেডিকেটেড ইউনিট চালু করে স্বাস্থ্য বিভাগ। সেখানেই করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা এবং আক্রান্ত অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে এখন। কিন্তু হাসপাতালে আইসিইউ না থাকায় সঙ্কটাপন্ন রোগীদের পাঠাতে হয় খুলনায়। শ্বাসকষ্টের রোগীদের একমাত্র ভরসা এখানকার সেন্ট্রাল অক্সিজন ইউনিট।

কারো ইউনিটে ৮জন চিকিৎসক ও ১২ জন সেবিকা দায়িত্বে রয়েছেন। তারা পালাক্রমে এখানে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন বলে স্বাস্থ্য বিভাগ দাবী করলেও রোগীরা বলছেন,দায়সারা গোছেন চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এখানে। খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এখানে থাকা রোগীরা। আর করোনা আক্রান্ত রোগীদের সাথে থাকা স্বজনরা খেয়ালখুশিমত চলাচল করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। যখন যেখানে ইচ্ছা যাচ্ছে,সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা করছে। বাজারে খাবার কিনতে যাচ্ছে। সচেতন মহল বলছে, বাগেরহাটের কারোনা হাসপাতাল থেকেই কার্যত করোনা ছড়াচ্ছে।

অপরদিকে বাগেরহাটের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনা সেবা কার্যক্রমে বেহাল দশা বিরাজ করছে। জেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে (এফডব্লিউসি) নেই পর্যাপ্ত জনবল। পরিচালনা কমিটিরও খবর নেই অনেক স্থানে। ফলে সেবা নিতে গিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে অনেককেই। আর করোনাকালীন এই ভোগান্তি আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে,জেলায় তাদের কার্যক্রম সন্তোষজনক। গত এক দশকে সব সূচকেই তাদের উন্নতি হয়েছে। সংকট সত্ত্বেও সেবার পরিধি বেড়েছে।

১,৮৩৪.৭৪ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চলসহ ৫৮৮২.১৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাগেরহাট জেলায় মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ হাজার ২৮ হাজার ২২৯। জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসাবে,সক্ষম দম্পতি ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ৩৬৯। এদের মধ্যে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৯৬৬ জন আছেন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সেবার আওতায়। শতকরা হিসাবে যা ৮১.১৪ শতাংশের ওপর।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের সেবা কার্যক্রমের আওতায় এসেছে অধিকাংশ গ্রামীণ জনগণ। তাছাড়া শহর এলাকায় নিম্ন আয়ের লোকজনও এসেছে। চাহিদা মাফিক বিভিন্ন জন্মনিয়ন্ত্রক সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু জনবল সংকট ও পরিচালনা পর্ষদের নিষ্ক্রিয়তায় মাঠ পর্যায়ের ইউনিটগুলোর কার্যক্রম গতিশীল করা যাচ্ছে না।

কর্মকর্তাদের ভাষ্য, প্রায় ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার দম্পতি নিয়ে কাজ করছেন মাত্র একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ)। অনুমোদিত ৪০১টি পদের বিপরীতে কর্মরত মাত্র ২৫৬ জন। পরিবার কল্যাণ সহকারীর ১৪৫টি পদ শূন্য।

পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) পদ খালি ৪৪টি। অনুমোদিত ৯৫ পদের বিপরীতে এই পদে কর্মরত ৫১ জন। ৭৭ টি পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক (এফপিআই)  পদের বিপরীতে কর্মরত ৬৩ জন। ৫৪টি পদের বিপরীতে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রয়েছেন ৪৪ জন। বিভিন্ন প্রশাসনিক পদও শূন্য দীর্ঘদিন ধরেই।

বাগেরহাট পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী পরিচালক ( ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন) ও ডিষ্ট্রিক্ট কনসালট্যান্ট (এফপিসিএস-কিউআইটি) ডা. স্বপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা কমিটি ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (এফডব্লিউসি) পরিচলনা কমিটিগুলো করোনা কালে ঝিমিয়ে পড়েছে। যেটা শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে। আর জনবল সংকটও রয়েছে প্রকট। খুলনা বিভাগে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ১৯ শতাংশ। কিন্তু বাগেরহাট জেলায় ২ দশমিক ১০ শতাংশ।

তিনি আরও বলেন, করোনা কালে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়া একটা চ্যালেঞ্জ। তবে আমরা এফডব্লিউএ দের বিভিন্ন ভাবে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করছি। সাথে সাথে ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকে গর্ভবতিও পরিবার পরিকল্পনা গ্রহনকারীদেরদের সেবা নিশ্চিত করার লক্ষে কাজ করা হচ্ছে।

বাগেরহাট শহরের প্রাণ কেন্দ্রে রয়েছে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। সেখানে পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিতে আসা মায়েদের বিভিন্ন রকম হয়রানি হতে হয়। সেখানের যারা মায়েদের সেবা দেন তাদের রুঢ় আচারনের অভিযোগ দীর্ষদিনের। এই মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে থাকা দালালচক্র সেখানে আসা প্রসূতি মায়েদের পাঠিয়ে দেয় শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে।

এসব অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে স্থানীয় বাগেরহাট পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলহাজ্ব আব্দুল বাকী তালুদার বলেন, এই  মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে আসা প্রসুতিদের শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাছাড়া এখানে সেবা নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে এই মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে  কথা হয় রফিকুল ইসলাম ( ছদ্মনাম) নামের নববিবাহিত এক স্থানীয় যুবকের সাথে। তিনি হাতে একটি ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) নিয়ে বিভিন্ন কক্ষে ঢুকছিলেন আর বের হচ্ছিলেন।  কি হয়েছে যানতে চাইলে তিনি বলেন, তার স্ত্রীর জন্য ক্যালশিয়াম ট্যাবলেট লিখেছিল এখানের ডাক্তার। ঈদের আগে বলা হয়েছে ঈদের পরে আসেন। আর এখন কেউ কিছু বলছে না। অবশ্য সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে সেখানে কর্মরতরা ওই যুবককে ডেকে ট্যাবলেট দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ভিতরে নিয়ে যান।

১৬ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভা নিয়ে গঠিত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা। সাড়ে ৪ লাখ লোকের বসবাস এই উপজেলায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যায়  উন্নত হলের বাড়েনি স্বাস্থ্য সেবার মান। ডাক্তার স্পল্পতাই এর মূল কারন।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, ২৫ জন্য মেডিকেল চিকিৎসকের বিপরীতে মাত্র ১১ জন চিকিৎসক রয়েছেন। শুন্য রয়েছে ১৪টি পদ। প্যাথলজীর ২ টি পদ ৪-৫ বছর যাবৎ শূন্য। এক্সরে বিভাগ বন্ধ। প্যাথলজি,এক্স-রে বিভাগের কক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ । পলেস্তরা খসে খসে পড়ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কামাল হোসেন মুফতি বলেন, অধিকাংশ রোগীকে একার সামলাতেই হয়।  

হাসপাতালে প্রবেশ ফটকের ডান পাশে জরুরী বিভাগের পাশের রুমেই প্রায় ২ মাস যাবৎ চলছে করানোর র‍্যাপিড টেস্ট। আর এর আশপাশেই সাধারণ রোগীরা স্বাস্থ্য বিধি তোয়াক্কা না করে চলাচল করছে। প্রতিদিন শতশত রোগী চিকিৎসা নিতে ভিড় করে এখানে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসোলেশন বেড রয়েছে ৫টি। যা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য ।

চিতলমারী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে  চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২৭ টি। কিন্তু কর্মরত আছেন ১৪ জন। এখানে ১৩টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে পদ রয়েছে ১১৮টি। সেখানে শূন্য রয়েছে ২৬ টি। মেডিকেল ট্যেকনোলজিস্ট গ্রাফির পদটি ৫ বছর যাবৎ শূন্য রয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরীক্ষার জন্য ২টি এক্সরে মেশিন অকেজো রয়েছে। নারী ও শিশু বিশেষজ্ঞ না থাকার কারণে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। তাদের চিকিৎসার জন্য ছুটতে হচ্ছে বাগেরহাট, খুলনা, গোগালগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তি জেলাগুলোতে। এতে সমস্যায় পড়েছেন দরিদ্র রোগীরা।

চিতলমারী উপজেলার আড়ুয়াবর্ণি গ্রামের বাসিন্দা মো. রাজু মুন্সী জানান, তাদের ঘরে অসুস্থ এক নারী রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নারী ও শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় বাইরে চিকিৎসা নিতে যেতে হচ্ছে। করোনা কালীন সময়ে অন্যত্র ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা খুবই ঝুঁকি তবু যেতে হচ্ছে।

শরণখোলায় স্বাস্থ্য সেবারও বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নামে ৫০ বেডের হাসপাতাল হলেও কার্যক্রম চলছে ৩১ বেডের আদলে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রশিক্ষিত ফার্মাসিষ্টের অভাবে নার্স দিয়ে রোগীদের মাঝে ঔষধ বিতরণ করা হয়। অচল হয়ে আছে এক্সরে মেশিন বন্ধ রয়েছে অপারেশন থিয়েটার।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ৩১ বেডের হাসপাতালটি কাগজে কলমে ৫০ বেডে উন্নীত করা হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। স্বল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে দেড় লক্ষাধিক জনসংখ্যার শরণখোলা উপজেলার একমাত্র সরকারী হাসপাতালের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ অচল হয়ে থাকা এক্সরে মেশিনটা  গত জানুয়ারী মাসে সচল করা হলেও মাস খানেক চালু থেকে আবার অচল হয়ে রয়েছে চার মাস যাবৎ। জুনিয়র কনসালটেন্ট (এ্যানেস্থেসিয়া),  জুনিয়র কনসালটেন্ট ( শৈল্য), জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনী), জুনিয়র কনসালটেন্ট ( মেডিসিন) নিয়োগ না দেওয়ায় অপারেশন থিয়েটার ( ওটি) বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ড চালু করে ৫টি বেড প্রস্তত রাখা হয়েছে। করোনা রোগীরা এখানে ভর্তি না হয়ে খুলনায় চিকিৎসার জন্য যায়। ১৪ জন মেডিকেল অফিসারের অনুমোদিত পদ থাকলেও বর্তমানে ৮জন কর্মরত রয়েছেন। শুন্য রয়েছে ৬টি পদ।

রামপাল উপজেলা হাসপাতালে ৫০ শয্যায় উন্নিত করা হলেও রয়েছে অবকাঠাম ও জনবল সংকট। এখানে নিরাপদ মাতৃত্ব সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। এনেসথেসিয়া, সারজারি কনন্ট, গাইনি বিষেসজ্ঞ না থাকায় গর্ভবর্তী মায়েরা থাকে প্রসব কালিন ঝুঁকিতে। নরমাল ডেলিভারির ব্যবস্থা করা হলেও কোন সিজারিক অপারেশন করা হয় না। অন্য দিকে ৩১ শয্যার অবকাঠামতে চলছে ৫০ শয্যার কার্যক্রম। চিকিৎসকের পদ আছে ৩২জন সেখানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৩জন। শুন্য রয়েছে ১৯টি পদ। এনেস্থেওলজিষ্ট না থাকায় অপারেশন বন্ধ ও এক্সে মেশিন আছে তবে জনবল সংকটে কার্যক্রম বন্ধ।

জেলার অন্য উপজেলাগুলোতেও একই অবস্থা । মোল্লাহটে চিকিৎসকের পদ আছে ২৮ টি সেখানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৪জন। শুন্য রয়েছে ১৪টি পদ। কচুয়ায় চিকিৎসকের পদ আছে ২৯ টি সেখানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৫জন। শুন্য রয়েছে ১৪টি পদ। মোংলায় চিকিৎসকের পদ আছে ২৭ টি সেখানে কর্মরত আছেন মাত্র ১০জন। শুন্য রয়েছে ১৭টি পদ। এছাড়া টেকনিশিয়ান ও কর্মচারীরও ব্যপক সংকট রয়েছে এসব উপজেলায়।

সরেজমিনে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, রোগীরা সামাজিক দুরত্ত্ব বজায় না রেখেই গাদাগাদি হয়ে দাড়িয়ে বা বসে রয়েছে। কারো কারো মাস্ক রয়েছে থুতির নিচে।

কর্মরত একাধিক স্বাস্থ্যকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যারা করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করেন শুধু তারাই পিপিই পরে থাকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাদের স্বাস্থ্য সেবা দিতে হয়। এছাড়া রোগী ও তার স্বজনরা কেউ কেউ রোগের তথ্য গোপন করে। করোনা আক্রান্তের লক্ষণ থাকলে অন্য রোগ বলে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করে।

তবে বাগেরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ তন্ময় করোনাকালীন বাগেরহাটের স্বাস্থ্য সেবায় মহতি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি ‘ডাক্তারের কাছে রোগী নয়, রোগীর কাছে ডাক্তার' নামের একটি সেবা চালু করেন। যেখানে কল দিলেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডাক্তার রোগীতে দেখে আসে। করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পর তিনি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নমুনা পরিক্ষার জন্য জরুরি সেবা চালু করেন। এছাড়া তার উদ্যোগে বাগেরহাট অক্সিজেন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এই অক্সিজেন ব্যাংক থেকে স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মীরা রোগীদের বাড়িতে অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে।

বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. কেএম হুমায়ুন কবির বলেন, চলতি বছরের শুরুতে এ হাসপাতালের জন্য ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটের সরঞ্জাম বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে  প্রশিক্ষিত জনবল ও অবকাঠামো সংকটের কারণে সেটা চালু করা সম্ভব হয়নি। পাঁচতলা হাসপাতাল ভবনের ওপরে ষষ্ঠ তলায় আইসিইউ ইউনিট হবে। ষষ্ঠতলা নির্মাণের জন্য দরপত্র দিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ। কাজ শেষ হতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে বলে তারা ধারণা করছেন। তারপর জনবল পাওয়া সাপেক্ষে আইসিইউ ইউনিটটি চালু করা যাবে।

তিনি আরো বলেন, করোনায় বাগেরহাটের এই পর্যন্ত ১২০জন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছে। পর্যাপ্ত পিপিই মজুদ রয়েছে। তবে স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই পরতে আগ্রহ নেই। শুধুমাত্র যারা করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করে তারাই পিপিই ব্যবহার করে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads