• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০১ আগস্ট ২০২১

দেশে করোনা মহামারীর মাঝে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। এর মাঝে শিশুরাও আছে। যদিও অভিভাবকরা অভিযোগ করে জানান, তাদের বাসাবাড়ি সব সময় পরিষ্কার রাখা হয়। বাইরে খেলতে গিয়ে তাদের সন্তানরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে।

গতকাল শনিবার ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীর অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এমন কথা জানা গেছে। এরই মাঝে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ছিল আনুমানিক হাজার খানের রোগী ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সারা দেশে গত একদিনে ১৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অন্যদিকে গতকাল শিশু হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা গেছে, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকরা সেবা দিতে হিমশিম খান। শুরুতে বিভিন্ন ওয়ার্ডের মধ্যে ডেঙ্গু রোগীদের রাখা হলেও বর্তমানে ২০ বেডের দুটি ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হয়েছে। সেখানে একটি বেডও ফাঁকা নেই। রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অন্য ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হয়েছে।

বনশ্রীতে বসবাস করা ইসমত আরা জানান, তার একমাত্র ছেলে আহমদ (৫) ২৭ জুলাই বাইরে খেলতে গিয়ে বাসায় ফেরার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর শরীরে জ্বর আসতে থাকে। শুরুতে কম আসলেও পরে তা ১০৫ ডিগ্রিতে ওঠে। প্রথমে নাপা ও সাপোজিটরি ব্যবহার করে কিছুটা জ্বর কমলেও আবারো তা বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বনশ্রী ফরাজী হাসপাতালে পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পরে। প্রতিনিয়ত রক্তের প্লাটিনেট কমতে থাকে। সেটি এক লাখে নামলেও হাসপাতালের রিপোর্টে ১০ হাজার দেখানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে তারা দিশেহারা হয়ে চারটি হাসপাতাল ঘুরে ভর্তি না নেয়ায় শুক্রবার রাত ১২টায় ঢাকা শিশু হাসপাতালে এনে ভর্তি করান। বর্তমানে তাকে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি রাখা হয়েছে।

এ শিশুর মা বলেন, ‘আমরা বনশ্রী আবাসিক একটি এলাকায় থাকি। পুরো বাড়ির ভেতর-বাইরে পরিষ্কার করে রাখা হয়। কোথাও ময়লা-আবর্জনা না থাকলেও বাইরে খেলতে গিয়ে সে আক্রান্ত হয়েছে বলে ধারণা করছি।’

এদিকে শিশু হাসপাতালে তাহামন নামে ডেঙ্গু আক্রান্ত আট বছরের আরেক শিশুর দেখা মেলে। তার বাসা কুড়িল বিশ্বরোডে। শিশুটির সঙ্গে নানি মনোয়ারা থাকছেন। ২৬ জুলাই এই শিশুর জ্বর আসে। তার সঙ্গে মাথা ব্যথা, বমি ও শরীর ব্যথা শুরু হয়। ২৮ জুলাই তাকে শিশু হাসপাতালে এনে পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে।

অপরদিকে পাঁচ বছরের কন্যাশিশু সামিয়ার ২২ জুলাই হালকা জ্বর আসে। দুদিন পরে তা বেড়ে যায়। জ্বর বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করা হলে তার ডেঙ্গু ধরা পরে। এরপর তাকে মিরপুরের এম আর খান শিশু হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে দুদিন ভর্তি থাকলেও এই শিশুর রক্তের প্লাটিনেট কমে ২০ হাজারে নামলে জরুরিভাবে তাকে রক্ত দেওয়া হয়। এতে করে রক্তের প্লাটিনেট ৪০ হাজারে ওঠলে সেখানে আইসিইউ সুবিধা না থাকায় অন্য হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেয়া হয়। সেদিন দুপুরে তাকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করান তার মা আকলিমা।

আকলিমা বেগম বলেন, ‘আমার তিন মেয়ের মধ্যে সামিয়া ছোট। গত কয়েক বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ায় আমাকে বাড়ি ভাড়া ও সংসার চালাতে হচ্ছে। মেয়ে হঠাৎ করে অসুস্থ হওয়ায় আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমরা যেখানে থাকি সেখানে কোনো আর্বজনা না থাকলেও পাশের ফ্ল্যাটের দুজন শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে বলে শুনেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় গত কয়েকদিনে গচ্ছিত অর্থ শেষ হওয়ায় আত্মীয়ের কাছে টাকা ধার করে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। মেয়ের চিকিৎসায় এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে।’ আরো কত টাকা প্রয়োজন হবে তা জানেন না বলে জানান তিনি।

এর মধ্যে দেখা গেল ৯ বছরের শিশু জিসানকে। সে ১০ দিন হাসপাতালে ভর্তির পর সুস্থ হয়ে বাড়ি যাচ্ছে। মোহাম্মদপুরে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া থাকে তারা। ভর্তির পর তাকে চারদিন আইসিইউতে রাখা হয়। এ পর্যন্ত তাদের লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়েছে। অনেক দিনের জমানো সব অর্থ ব্যয় করে ছেলের চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে গেছেন বলে জানান জিসানের মা মোছা. মোরশেদা বেগম।

ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে জানা গেছে, গত দুই মাস ধরে ব্যাপকভাবে শিশুরা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। স্বাস্থ্যবান ও বেশি ওজনের শিশুদের অবস্থা গুরুতর হচ্ছে।

দেখা গেছে, গত কয়েক মাসে এ হাসপাতালে ১১৮ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। তার মধ্যে গত এক সপ্তাহে ৪১ জন শিশু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়। বর্তমানে ২৯ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। তার মধ্যে আইডিইউতে পাঁচজন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত চার শিশু প্রাণ হারিয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, ‘স্কুলগামী শিশুরা ডেঙ্গু জ্বরে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ২০ সিটের আলাদা দুটি ওয়ার্ড তৈরি করা হয়েছে।’ এই চিকিৎসক পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘সকলকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। ঘরের ভেতরে ও বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ বা স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।’ কারো শরীরে ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত সময়ের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেন ডা. প্রবীর কুমার সরকার।

উপসর্গ নিয়ে ১৫ দিনে ঢামেকে চিকিৎসা নিয়েছেন হাজার রোগী : ঢাকা মেডিকেল বহির্বিভাগের মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ শাইখ আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ছিল এরকম আনুমানিক হাজার খানের রোগী ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের কারো কারো অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের মিটফোর্ড ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নারে পাঠানো হয়েছে। যাদের শারীরিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো তাদের কেউ কেউ ঢাকা মেডিকেলেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ঢাকা মেডিকেলের কয়েকটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা মেডিকেলে গতকাল শনিবার ৯ জন রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে শিশু ছয়জন, নারী দুজন ও পুরুষ একজন।

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত বুশরা আক্তার (১০)। তাদের বাড়ি যাত্রাবাড়ী বিবিরবাগিচা এলাকায়। বুশরার মা সোনিয়া আক্তার জানান, গত ২৫ জুলাই জ্বর আসে বুশরার। গত ২৭ জুলাই ঢাকা মেডিকেলে ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষা করানো হয়। ২৮ জুলাই ডেঙ্গু পজিটিভ রেজাল্ট আছে। সেদিন থেকেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে।

৭ মাস বয়সি আলিফ। তাকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন মা তাসলিমা আক্তার। তাসলিমা জানান, তাদের বাসা বংশাল নাজিমউদ্দিন রোডে। শিশুটির বাবা আমিনুল রিকশা চালায়। গত ২৯ জুলাই হঠাৎ করে জ্বর আসে আলিফের। গতকাল ৩০ জুলাই ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয় তাকে।

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাসলিমার ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর আলিফকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ঢামেক হাসপাতালের শিশু বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, সাকিবুল আলম (১১) বছরের এক শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় তার পরিবার সাকিবুলকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর চেষ্টা করছে।

সাকিবের বাবা ঢামেক হাসপাতালের স্টাফ মো. শাহ আলম জানান, তাদের বাসা এলিফ্যান্ড রোডের মেডিকেল স্টাফ কোয়ার্টারে। গত ২৭ জুলাই জ্বর আসে সাকিবের। বাসাতেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু থেমে জ্বর আসায় তারা ডেঙ্গু হয়েছে বলে ধারণা করছেন।

শিশুদের ডেঙ্গুর বিষয় নিয়ে কথা হয় বহির্বিভাগের শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রাজেশ মজুমদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ছয় শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে আসা শুরু করেছে। এর মধ্যে সবই ঢাকা থেকে এসেছে।’

ডা. রাজেশ বলেন, ‘গত সপ্তাহে ৮ থেকে ১০ জন শিশু পজিটিভ পেয়েছি। এদের মধ্যে যাদের শারিরীক অবস্থা খারাপ, র‍্যাশ আছ, রক্তের প্লাটিলেট অনেক কম, ভবিষ্যতে খারাপ হতে পারে। সেইসব শিশুকে ভর্তি দেওয়া হচ্ছে।’

ডা. রাজেশ বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ অনেকেরই জানা, যেমন প্রস্রাব লাল, শরীরে লাল র‍্যাশ ওঠে, দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্ত বের হওয়া, পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্ত দিয়ে হওয়া। এমনকি জ্বর আসার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু পরীক্ষা করালে পজিটিভ নাও আসতে পারে। আবার মশা কামড়ানোর তিন থেকে সাত পরেও পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু পজেটিভ আসতে পারে।’

ডা. রাজেশ মজুমদার বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে জ্বর আসার পর নাপার অতিরিক্ত কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। জ্বর কয়েকদিন থাকলে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে। একটি নির্দেশনা পেয়েছি, যারা জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসে, সব পরীক্ষার সঙ্গে ডেঙ্গু পরীক্ষাটাও করা হয়।’

বহিঃবিভাগের মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ শাইখ আব্দুল্লাহ বলেন, জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছি। হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডনগুলো করোনা ইউনিট বানানো হয়েছে। তবে যেসব রোগীর অবস্থা খারাপ থাকে তাদের ভর্তি দেওয়া হচ্ছে। বেশ কয়েকজন রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

আরো ১৯৬ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি : গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে আরো ১৯৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের ডেঙ্গু বিষয়ক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৯৬ জন। এর মধ্যে ঢাকাতেই ১৯৪ জন। আর ঢাকার বাইরের রয়েছেন ২ জন।

এতে আরো বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ৭৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৭৪৭ জন এবং অন্যান্য বিভাগে বর্তমানে সর্বমোট ৩০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুলাই বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ২ হাজার ৬৫৮ জন। একই সময়ে তাদের মধ্য থেকে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র পেয়েছেন ১ হাজার ৮৭৭ জন রোগী।

একই সঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে চারটি মৃত্যুর তথ্য পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads