• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

ভুয়া এমএলএমের ফাঁদে সর্বস্বান্ত লাখো গ্রাহক

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

ই-কমার্সের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত লাখ লাখ গ্রাহক। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতারণার শিকার হয়ে গ্রাহকরা মামলা করছেন। অনেক ই-কমার্সের মালিক গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। কেউ কেউ আত্মগোপনে, আবার অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এবার ই-কমার্সের পাশাপাশি ভুয়া এমএলএম কোম্পানির বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান। বিশেষ করে এহসান গ্রুপের হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর তৎপর হয়ে উঠেছে গোয়েন্দারা।

গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের শীর্ষ এমএলএম কোম্পানি হিসেবে পরিচিত ডেসটিনির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ডেসটিনির কিছু কর্মকর্তা বিভিন্ন নামে এমএলএম কোম্পানি খুলে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করছেন। প্রতারণার শিকার হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ।

কর্মকর্তারা জানান, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ নতুন নয়। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। দেশে করোনা সংক্রমণের আগে এ ধরনের ১৫৬টি এমএলএম প্রতিষ্ঠানের তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)  পাঠানো হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখছে দুদক। এ ছাড়া দেশের সব বিমানবন্দর ও সীমান্ত চেকপোস্টের ইমিগ্রেশন পুলিশের দপ্তরে ৫৮ এমএলএম প্রতারকের নাম-ঠিকানা পাঠানো হয়েছে। তারা যেন দেশত্যাগ করে পালাতে না।

ছয় মাসে আড়াইশ কোটি হাতিয়েছে এসপিসি : রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় গত বছর থেকে ই-কমার্সের নামে যাত্রা শুরু করে এমএলএম কোম্পানি এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে রয়েছে আল আমিন প্রধান। তিনি মূলত ডেসটিনি-২০০০-এর একজন উচ্চ পর্যায়ের টিম লিডার ও প্রশিক্ষক ছিলেন। সেখানে তার যেসব সহযোগী ছিলেন তাদের নিয়েই ভিন্ন কৌশলে মাঠে নামেন আল আমিন। মাত্র ১১ মাসে তার ঝুলিতে জমা হয় ২৬৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমএলএম ব্যবসা ও প্রতারণার দায়ে আল আমিনসহ প্রতিষ্ঠানটির ছয়জন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এহসান গ্রুপের আত্মসাতে চাঞ্চল্য : ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এমএলএম কোম্পানির ফাঁদ তৈরি করে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তি, ইমাম শ্রেণি ও অন্যদের টার্গেট করে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান। তিনি শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগের বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণা করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতেন। এ ছাড়া তিনি ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের নামে ব্যবসায়িক প্রচার-প্রচারণা করতেন।

র্যাব জানায়, তিনি ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। তার বিরুদ্ধে ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে। রাগীব আহসান লাখ টাকার বিনিয়োগে মাসিক মাত্রাতিরিক্ত টাকা প্রাপ্তির প্রলোভন দেখিয়ে ২০০৮ সালে ১০ হাজার গ্রাহককে যুক্ত করেন। এখন তার গ্রাহকের সংখ্যা লক্ষাধিক।

ভুয়া এমএলএম এহসানের বিপুল অঙ্কের এই টাকা আত্মসাতের খবরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। একদিকে ই-কমার্সের প্রতারণা যখন আলোচনার শীর্ষে তখন এসব ভুয়া এলএমএম কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ২২ সেপ্টেম্বর কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে কথিত এমএলএম কোম্পানি সুইসড্রামের পরিচালক কাজী আলামিনসহ তার ১৭ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।

র্যাব জানায়, সুইসড্রাম কোম্পানি মধ্য শিক্ষিত বেকার ও নিরীহ যুবক এবং শিক্ষিত সরল শ্রেণির লোকজনকে মোটিভেশনাল বক্তব্য প্রদান ও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সদস্য হিসেবে সুইসড্রাম অ্যাপস্-এ অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

র্যাব-৪-এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের জানান, এই চক্রটি নামিদামি রেস্টুেরেন্টে সভা, সেমিনার, মোটিভেশনাল ওয়ার্কশপ, আকর্ষণীয় লাঞ্চ ও বুফে ডিনার পার্টির আয়োজন করে সদস্যদের আস্থায় নিত। এ ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে প্রলুব্ধ হয়ে খুব সহজেই তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিত। এভাবে চক্রটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কথিত ওষুধ বিক্রির দায়িত্ব ছাড়াও এই চক্র সুইসড্রাম অ্যাপসে অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিত।

তিনি আরো বলেন, কথিত কোম্পানির পরিচালক কাজী আলামিন দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি থেকে সদস্যদের সামনে নামতেন। তিনি নিজেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কখনো প্রবাসী বলে পরিচয় দিতেন। এদের কথিত এস-ফ্যাক্টর ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যের বিএসটিআই বা ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদন নেই। কোম্পানির বৈধ কাগজপত্রও নেই।

সম্প্রতি রাজধানীর বাড্ডায় গ্লোবাল গেইন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি ভুয়া এমএলএম কোম্পানির অফিসে অভিযান চালিয়ে ৮ জনকে আটক করেছে র্যাব। প্রতিষ্ঠানটি ১৩ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

জানা যায়, ২০০২ সালে ডেসটিনিসহ দেশে এমএলএম কোম্পানি ছিল ১৬টি। ২০০৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪টিতে। বর্তমানে দেশে ২ শতাধিক এমএলএম কোম্পানি রয়েছে। কিন্তু একটি কোম্পানিকেও লাইসেন্স দেয়নি সরকার। অর্থাৎ দেশে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রতারণার ধরন পাল্টে ই-কমার্স, ই-বিজনেস ও ডিরেক্ট টেলিমার্কেটিং, ক্যাশলেস সোসাইটি প্রভৃতি নামে বিভিন্ন ‘এমএলএম কোম্পানি’ গড়ে উঠেছে। কোনো কোনো কোম্পানি ফুড সাপ্লিমেন্ট, প্রসাধনসামগ্রী ও হারবাল ওষুধ বিপণনের নামে এমএলএম কার্যক্রম চালাচ্ছে। যদিও ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২-তেও ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আছে। এছাড়া ভারত, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান থেকে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আসছে। তারা মাল্টিপারপাস আদলের কোনোভাবে একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করেই প্রতারণার পসরা নিয়ে বসছে। কেউবা শুধু ট্রেড লাইসেন্স জোগাড় করেই ‘অলৌকিক পদ্ধতির’ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর কারওয়ানবাজার, পল্টন, বিজয়নগর, কাকরাইলসহ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বড় পরিসরে অফিস নিয়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করছে বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানি। এরপর তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিলেই ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্যাকেজের পণ্য। এসব প্যাকেজে আছে গৃহস্থালি পণ্য, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য, হোম এপ্লায়েন্স পণ্য, প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ পণ্য এবং হারবালসহ নানা ধরনের পণ্য। এরপর এসব পণ্যের অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়। নিম্নমানের পণ্য বা সেবা বিক্রি করা এবং অসত্য, কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য না দেয়ার শর্তে লাইসেন্স নেওয়ার কথা বলা হয় কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে। কিন্তু লাইসেন্সের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি এড়িয়ে প্রতারক চক্র কেবল জয়েন্ট স্টকের অনুমোদন আর নামের ছাড়পত্র নিয়েই প্রতারণার বাণিজ্য খুলে বসে। সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশনের অনুমোদন নেওয়ার সময় তারা ‘ক্যাটাগরি’ কলামে ব্যবসার ধরন হিসেবে আমদানি-রপ্তানি, হারবাল পণ্য উৎপাদন, বিক্রি, আইটি সফটওয়্যার, বহুমুখী পণ্য বিপণন, ট্র্যাভেল এজেন্সি, বৃক্ষে বিনিয়োগ, অদৃশ্য স্বর্ণ ব্যবসা, সর্বরোগ মুক্তির ব্রেসলেট বিপণন প্রভৃতি উল্লেখ করে।

এদের বেশিরভাগেরই বৈধ অনুমোদন নেই, অফিস নেই। দেশে প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্য, রীতিনীতির সঙ্গেও কোনো মিল নেই। সরকারের অনুমোদন ছাড়াই কার্যক্রম পরিচালনা করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এরা। অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সদস্য বানাচ্ছে সহজ-সরল তরুণ-তরুণীদের। এর মাধ্যমে নিম্নমানের ইলেকট্রনিকসামগ্রী ৩-৪ গুণ বেশি দামে সদস্যদের ধরিয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নজরদারী রয়েছে। প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা মামলা করলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহন করব। 

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাবের গোয়েন্দা শাখা থেকে নজরদারী করা হচ্ছে। অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads