• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বেড়েছে আমদানি-রপ্তানি

দ্রুত ঘুরছে অর্থনীতির চাকা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০২১

দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ফলে দ্রুতগতিতে ঘুরছে অর্থনীতির চাকা। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার হিড়িক পড়েছে। এছাড়া পণ্য রপ্তানি বেড়েছে যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। শুধু তাই নয়, সরকারের রাজস্ব আয়ও বেড়েছে যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বৈদেশিক বাণিজ্যের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও গতিশীল হয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেসব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে আমদানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৩ শতাংশ।  আর সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ শতাংশ। একইভাবে আগস্ট মাসে সরকারের রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ শতাংশের বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা দীর্ঘদিনের স্থবিরতা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকেই আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন উদ্যমে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সে কারণেই একদিকে রপ্তানি আয় বাড়ছে, অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ (ক্যাপিটাল মেশিনারি) সব ধরনের পণ্য আমদানিই বেড়ে গেছে; বাড়ছে এলসি খোলার পরিমাণ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল হওয়ার কারণে রাজস্ব আয় বাড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। দেশেও করোনা পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সবমিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। অর্থাৎ রপ্তানি বেড়েছে। আবার বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখতে চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এ কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ধীরে ধীরে সব দেশেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। এতে নতুন বিনিয়োগ, ব্যবসা বাণিজ্য-উৎপাদন নিয়ে ব্যবসায়ীরা ভাবতে শুরু করেছেন। এ কারণেই আমদানি ব্যয় বেড়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ছোট-বড় সব উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। আর এসব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ পণ্য আমদানির পরিমাণ বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত আগস্টে  ৬০৯ কোটি ১০ লাখ (৬.০৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। গতবছরের আগস্টে পণ্য আমদানি হয়েছিল ৩৫২ কোটি ১০ লাখ (৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন) ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) আমদানি বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ দুই মাসে পণ্য আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৮৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৭৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলার।

গত সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিকভাবে ৪১৬ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। গত বছর সেপ্টেম্বরে সার্বিকভাবে ৩০১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এক হাজার ১০২ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি।

রপ্তানি আয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় এই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্ববাজারে রপ্তানি বেড়েছে ৪১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তথ্য মতে, আগস্ট মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশের বাজারে দেশীয় পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৪১ কোটি ৮৮ লাখ ইউএস ডলার। যা এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ২৪১ কোটি ৩৪ লাখ ইউএস ডলার। সেই হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় এই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০০ কোটি ইউএস ডলার রপ্তানি আয় বেড়েছে পোশাক খাতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে ৯০৫ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ-র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, গতবছর করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তৈরি পোশাক খাত। এখন ওই ক্ষতি কাটিয়ে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হয়েছে, দোকানপাট খুলেছে, ফলে পোশাকের চাহিদা বাড়ায় নতুন অর্ডারও আসছে। এ কারণে রপ্তানি আয় বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত আগস্টে ৭১৮ কোটি ৪০ লাখ (৭.১৮ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা) টাকার অংকে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কোনো একক মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে এত বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে দেখা যায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসের (জুলাই-আগস্ট) হিসাবে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। এই দুই মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানির জন্য ১ হাজার ২১৩ কোটি (১২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে খোলা হয়েছিল ৮১৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারের এলসি।

তথ্য বলছে, ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-আগস্ট সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খুলতে ৪৪৭ কোটি ৪৮ লাখ (৪.৪৭ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৮৭ কোটি ১০ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে; বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৯৭ কোটি ৩৯ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যান্য শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩৩৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থাৎ বেড়েছে ৪৯ শতাংশ।

এছাড়া জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ৯৪ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬২ শতাংশ। খাদ্যপণ্য (চাল ও গম) আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৪৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ বেড়েছে ৬৩ শতাংশ।

গত আগস্ট মাসে সরকারের রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আগের মাস জুলাইতে রাজস্ব আদায় বেড়েছিল ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই মাসে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছিল ১৫ হাজার ৩৫৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। আগস্ট মাসে রাজস্ব আয় হয়েছে ১৯ হাজার ১৯২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) রাজস্ব আদায়ে রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রথম দুই মাসে এনবিআরের আয় হয়েছে ৩৪ হাজার ৫৪৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা।  যেখানে গত অর্থবছরে জুলাই-আগস্ট মাসে ৩০ হাজার ১৬০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) আয়কর থেকে ১০ হাজার ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। ভ্যাট থেকে এসেছে ১২ হাজার ৯৬৪ কোটি ৩ লাখ টাকা এবং শুল্ক খাত থেকে প্রতিষ্ঠানটি আদায় করেছে ১১ হাজার ৫৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads