• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

নৌপথে অবৈধ যানের দাপট

বৈধ জলযান মাত্র সাড়ে ১৩ হাজার

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৪ অক্টোবর ২০২১

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নৌপথে ফেরেনি শৃঙ্খলা। দেশের ৫ হাজার কিলোমিটার নৌপথে বৈধ যানের চেয়ে অবৈধ যানই চলাচল করছে বেশি। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিব্লউটিএ), নৌপরিবহন অধিদপ্তর (ডিওএস), নৌপুলিশ কর্তৃপক্ষ, নৌযান মালিক সংগঠন ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট এ খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে বিভিন্ন সময় সরকার নৌপথে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আর অনিবন্ধিত নৌযানের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে দেশের নৌপথ, প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। পাশাপাশি বড় অঙ্কের রাজস্বও হারাচ্ছে সরকার।    

এদিকে অবৈধ নৌযানের দাপটে কোণঠাসা হয়ে থাকেন বৈধ যানের মালিক ও চালকরা। নেই নৌপথে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের তদারকি। ফলে ফিটনেস সনদ ছাড়া নৌযান চলাচলের কারণেই প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। তা ছাড়া ফিটনেস সনদ থাক বা না থাক, প্রধান রুটগুলোতে বড় নৌযান ছাড়া রাতে যান চলাচল নিষিদ্ধ। তারপরও রাতে যাত্রীবাহী ট্রলার বা লঞ্চের সঙ্গে বালুবাহী বাল্কহেড বা অন্য নৌযানের সংঘর্ষের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। দেশের বিস্তৃত নৌপথে প্রাকৃতিক কারণে জলযান দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু নেহাত কম নয়।

বৈধ নৌযানের মালিকদের অভিযোগ, অবৈধ নৌযান চলাচলের কথা না থাকলেও এসবের দাপট বেশি। তারা বলছেন, যারা নিয়ম মেনে নৌযান পরিচালনা করছে তারাই উল্টো অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন। সব নৌযানকে নিবন্ধন এবং ফিটনেস সনদের আওতায় আনতে না পারলে এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না বলে মনে করেন বৈধ নৌযান মালিকরা।

এদিকে নৌপরিবহন খাতের এমন অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা দূর করতে নৌযান শুমারি ও সকল নৌযান নিবন্ধনের আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বলছে, নৌপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগির শুরু হবে নৌযান শুমারি।

সারা দেশে কত নৌযান চলছে আর এর মধ্যে কতগুলো নিবন্ধনবিহীন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছে। নৌযান মালিকদের ধারণা, অনিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা কমপক্ষে সাত হাজার। বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থাকে চাঁদা দিয়ে ও প্রশাসনের কারো কারো ছত্রচ্ছায়ায় এ যানগুলো চলছে বেশ দাপটের সাথে। এমন অরাজক পরিস্থিতির জন্য বিআইডবিব্লউটিএ এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তরকেই দুষছেন বৈধ নৌযানের মালিক-শ্রমিকরা।

দেশে নৌযান চলাচলের উপযোগী পথ রয়েছে ৫ হাজার কিলোমিটার। এই নদীপথে ১৬ অশ্বশক্তির বেশি সামর্থ্যের ইঞ্জিনচালিত নৌযানের লাইসেন্স ছাড়া চলাচল নিষিদ্ধ। অবৈধভাবে চলাচল করলে আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধানও রয়েছে। আর নদীপথে এসব কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব সরকারের দুই সংস্থা-বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডবিব্লউটিএ এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তরর। কিন্তু সারা দেশে কী পরিমাণ অবৈধ নৌযান চলাচল করছে তার কোনো হিসেব নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছে। কোনো অঞ্চলের নদনদীতে কী ধরনের যাত্রী বা পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে, তার তথ্যও নেই। এখন পর্যন্ত নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কাছে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৩ হাজার ৪৮৬টি। মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, বৈধ নৌযানের আড়ালে অবৈধ যান চলছে অন্তত ৫০ হাজার। 

বিআইডব্লিউটিএর নিবন্ধিত নৌযানের পরিসংখ্যান- যাত্রীবাহী জাহাজ ৮৩৮টি, যাত্রীবাহী বোট (ছোট লঞ্চ) ৪১৭টি, মালবাহী ৪ হাজার ২৮৪টি, তেলবাহী ৩৩৯টি, বালিবাহী ৫ হাজার ৭১টি, ড্রেজার ১ হাজার ৩৫২টি, বার্জ ৪৭৮টি, টাগ ১৫২টি, স্পিড বোট ৩৪০ টি, ফেরি ৪০টি, ওয়ার্ক বোট ৬৩টি, পরিদর্শন বোট ২৬টি ও অন্যান্য যান ৮৬টি।

দেশে কত সংখ্যক বৈধ-অবৈধ নৌযান চলাচল করছে সেই সংখ্যা নিশ্চিত হতে ২০১৬ সালে শুমারির উদ্যোগ নিয়েছিল নৌপরিবহন অধিদপ্তর। কিন্তু সেই প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি। নিয়ম অনুযায়ী, নৌযান নির্মাণের আগে নকশা নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। পরে নির্মিত নৌযান পরিদর্শন করে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদ দেন সার্ভেয়াররা। যা দেখিয়ে বিআইডব্লিটিএ থেকে রুট পারমিট নিতে হয়। কিন্তু এসব নিয়ম অনুসরণ না করেই হাজারো নৌযান চলাচল করছে।

নৌ-মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে সারা দেশে প্রায় এক হাজার নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছেন ৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। আহত হয়েছেন ১ হাজারের বেশি। আর নিখোঁজ ৫ শতাধিক। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কোটি কোটি টাকা।  নৌবিশেষজ্ঞ মীর তারেক আলী বলেন, নদীপথে শৃঙ্খলা আনতে নৌযান শুমারির পাশাপাশি নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। এতে শুধু দুর্ঘটনাই কমবে না, বাড়বে সরকারের রাজস্বও। বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে নৌপথে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সব নৌযান নিবন্ধনের আওতায় আনার। 

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, সারা দেশে ট্রলার, স্পিডবোট ও বালুবাহী বাল্কহেডসহ অন্যান্য নৌযানের জন্য দক্ষ চালক, সুকানি ও মাস্টার তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। করা হবে নৌযান শুমারি এবং একই সাথে ক্রমান্বয়ে সব নৌযানকে ডিজিটাল নম্বর প্লেটও দেওয়া হবে।

এদিকে নৌপথে শৃঙ্খলা আনতে নৌপুলিশকে বারবার চিঠি দিয়ে যাচ্ছে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। চিঠিতে অবৈধভাবে চলাচলকারী ও অনিবন্ধিত নৌযানগুলো আইনের আওতায় আনতে নৌপুলিশকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।

এ বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন বলেন, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী নৌপুলিশ সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। সে ক্ষমতা তাদের দেওয়া আছে। অভিযানে স্থানীয় পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ-সবার সহায়তা নিয়ে আমরা কাজ করি। নৌপুলিশ আমাদের কাছে আসতে পারে, কথা বলতে পারে। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। সমন্বিত উদ্যোগ ও আলোচনার কথা বলা হয়েছে। আমরা লাইসেন্সিং ও নৌপথের শৃঙ্খলা আনার বিষয়ে একটি কো-অর্ডিনেশন মিটিংয়ের উদ্যোগ নিচ্ছি।

নৌপুলিশের পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ডা. আ ক ম আক্তারুজ্জামান বসুনিয়া বলেন, নৌ-অধিদপ্তর থেকে চিঠি প্রাপ্তির পর আমরা একটা গাইডলাইন তৈরি করেছি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নৌপুলিশের ঢাকা অঞ্চলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকতা আলাপও করেন। এ বিষয়ে আমরা সুন্দর সমাধানে আসতে চাই। নৌযান নিবন্ধন ও অন্যসব সমস্যা সমাধান হলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং নৌপথ আরো নিরাপদ হবে।

তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত নৌ-অধিদপ্তর থেকে বেশ কয়েকটি সার্কুলার দেওয়া হয়েছে। সেখানে জাহাজ মালিক সমিতি, নৌযান মালিক সমিতি, নাবিকদের অ্যাসোসিয়েশন, নৌ-শ্রমিকদের নানা ফেডারেশনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, রেজিস্ট্রেশন ছাড়া যেন কোনো নৌযান না চলতে পারে। অনিবন্ধিত নৌযানগুলো যেন নিবন্ধনের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা হয়। এটা করার জন্য সমন্বয়ের দরকার আছে, যা নৌ-অধিদপ্তর করবে। কারণ এর আগে এ ধরনের আইনের প্রয়োগ আমরা করিনি। যেহেতু আগে করিনি, তাই প্রশিক্ষণের বিষয় আছে। নৌপুলিশের সদস্যদের এ আইন সম্পর্কে জানাতে হবে। কীভাবে কাজ করবে, সেজন্য টুলস-টেকনিক দিতে হবে। মামলা হলে সেটির ফরমেট লাগবে। একটি পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। আর সেজন্য দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হতে হবে। অনিবন্ধিত নৌযান মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের সময় দিতে হবে। ডেডলাইন (চূড়ান্ত সময়) দিতে হবে। সচেতন করতে হবে। কীভাবে সফল করা যায়, সেজন্য দুই পক্ষ মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads