• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ভুল পরিকল্পনায় ১০ বছরে কাজ এগিয়েছে ৩০ শতাংশ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৪ অক্টোবর ২০২১

ঢাকার যানজট নিরসনে দশ বছরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৩০ শতাংশ। সময় বাড়ানো হয়েছে চার বার। বিলম্ব হওয়ায় একদিকে বেড়েছে জনভোগান্তির সঙ্গে সরকারি অর্থও অপচয় হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করতে হবে।

প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব জটিলতা কাটিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে কাজ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বারবার উদ্বোধন আর প্রতিশ্রুতির মধ্যেই ঘুরছে ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন’। ভুল পরিকল্পনা এবং ভূমি অধিগ্রহণে অদক্ষতার ফলেই মূলত প্রকল্পের সুফল মিলছে না নির্দিষ্ট সময়ে। তারা মনে করেন, শুধু প্রাইভেট কার চলাচলের জন্য বেশি সুবিধা মিলবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে। এ পরিস্থিতিতে আগামী বছরেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।

রাজধানীর যানজট অর্ধেকে নামিয়ে আনার পাশাপাশি রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণ অংশের সংযোগ ও ট্রাফিক ধারণক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সালে সরকার হাতে নেয় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-কুড়িল-বনানী হয়ে মহাখালী-তেজাগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-কুতুবখালী (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) পর্যন্ত এলাকাকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। উড়ালপথে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণের জন্য সময় ধরা হয় চার বছর। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) অধীনে প্রকল্পটি তিন ধাপে নির্মাণের কাজ শুরু করে সেতু বিভাগ। প্রথম ধাপে ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপে ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার ও বাকি অংশ তৃতীয় ধাপে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। নকশা অনুযায়ী এই উড়াল সড়কে উঠা-নামার জন্য র্যাম্প রাখা হয়েছে ৩১টি। এগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার।

সময়মতো কাজ শুরু হলেও জমি অধিগ্রহণ ও বিনিয়োগ জটিলতায় কাজে ধীরগতি চলে আসে। জটিলতা দেখা দেয় অর্থায়ন ও নকশায়। এসব কারণেই চার বছর মেয়াদের প্রকল্পটির মেয়াদ চার বার বাড়িয়ে ১০ বছরেও শেষ করা যায়নি।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ। এই বিভাগের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, প্রকল্পটি ২০১১ সালে হাতে নেওয়া হলেও এর কাজ শুরু হতেই লেগে যায় দুই বছর সময়। অর্থাৎ ২০১৩ সালে এর কাজ শুরু হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় জমি অধিগ্রহণ নিয়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরে যায় অর্থায়ন। পাবলিক পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় নির্মাণের কথা থাকায় যথাসময়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু করা প্রয়োজন ছিল, যা সম্ভব হয়নি।

জানা যায়, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ ব্যয়ের ২৭ শতাংশ বহন করবে সরকার। বাকি ৭৩ শতাংশের বিনিয়োগ বিদেশি কোম্পানির। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি রয়েছে উড়াল সড়ক নির্মাণের দায়িত্বে। কিন্তু প্রকল্পের মূলকাজ শুরু করতে করতে এত দেরি হয়েছে যে ২০১১ সালে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হলেও ২০১৩ সালে গিয়ে ইতাল-থাই কোম্পানির সঙ্গে নতুন করে সরকারকে চুক্তি করতে হয়। পরে যে সমস্যা দেখা দেয়, তা সমাধানে লেগে যায় আট বছরের বেশি সময়। ইতাল-থাই অর্থের সংস্থান করে নতুন করে গত বছর থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করেছে প্রকল্পটির। আর এত দেরি হওয়ায় নকশাও পরিবর্তন আনতে হয়েছে এ প্রকল্পে।

বর্তমান অবস্থা : তিন ধাপে নির্মীয়মাণ উড়াল সড়ক প্রকল্পের প্রথম অংশটি আগামী বছরই চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে চায়। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে বনানী রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত এই অংশের দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। সে লক্ষ্যে এখন পুরোদমে চলছে এই প্রকল্পের কাজ। সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি সাইটেই কাজে গতি এসেছে। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রথম ধাপের ভৌত অগ্রগতি শতকরা ৬৬ দশমিক ২৫ ভাগ, দ্বিতীয় ধাপের ভৌত অগ্রগতি শতকরা ২১ দশমিক ৫০ ভাগ এবং তৃতীয় ধাপের ভৌত অগ্রগতি শতকরা ২ দশমিক ৩৩ ভাগ। সব মিলিয়ে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৩০ দশমিক ৫০ ভাগ।

জানা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশের জন্য প্রয়োজনীয় ১ হাজার ৪৪২টি পিলারের মধ্যে বসানো হয়েছে ১ হাজার ৪৩০টি পিলার। এসব পিলারের ওপরে এরই মধ্যে আই গার্ডারও বসানো হয়েছে।

এছাড়া বনানী রেলওয়ে স্টেশন ও তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডসহ বেশকিছু অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। পাঁচটি স্থানে টেস্ট ফাইল নির্মাণের কাজও শেষ। চলমান আছে পাইলিং, পাইল ক্যাপ ও কলাম নির্মাণের কাজ। কুড়িল এলাকায় সেন্ট্রাল কন্ট্রোল বিল্ডিংয়ের পাইল ড্রাইভিং শেষ। এখানে পাইল ক্যাপের কাজ চলছে। তবে পিছিয়ে রয়েছে মগবাজার রেল ক্রসিং থেকে কুতুবখালি পর্যন্ত অংশের কাজ। এই অংশে জমি অধিগ্রহণ করা হলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ২০১০ সালে যখন এ প্রকল্প সরকার হাতে নেয়, তখন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকা দুইটি প্রকল্পের মধ্যে এটি ছিল একটি। অন্য প্রকল্পটি ছিল পদ্মা বহুমুখী সেতু। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চিন্তাটা তখন এ কারণে এসেছিল যে এসটিপিতে অনেকগুলো প্রজেক্ট ঢাকায় করতে বলা হয়েছিল। এগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে যে উন্নয়ন যন্ত্রণা, তাতে বিকল্প দিতে হবে। সরকার কারো না কারো পরামর্শে তখন বলল রেলের জমি আছে অধিগ্রহণ লাগবে না। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, পিপিপি প্রজেক্টের ফ্রেমওয়ার্কে যে ধরনের পৃষ্ঠপোষতা ছিল, সেটা ছিল না এখানে। সরকারের তরফ থেকেও ছিল না। যে কারণে ভূমি অধিগ্রহণে বড় ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। কিন্তু এ সমস্যা দ্রুত সমাধান করে বিনিয়োগকারীকে দেওয়াটা জরুরি ছিল।

তিনি বলেন, বিনিয়োগকারী প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে তার দেশ থেকে ব্যাংক ঋণ নিয়ে। নিয়ম হচ্ছে, ঋণটা সে নেবে ৪২ মাসের জন্য। এখন সে ৪২ মাস যদি হয়ে যায় ১০ বছর, তাহলে পিপিপি প্রজেক্টের ফ্লেভার থাকে না। যে কারণে এখানে সরকারও ঠিকমতো জমি বুঝিয়ে দিতে পারেনি। ফলে সম্ভাব্য অর্থায়নকারীরাও দেখেছে, প্রকল্পের ভবিষ্যত খুব খারাপ। ফলে ব্যাংক থেকে ইক্যুইটি মেলেনি। ফলে প্রকল্পটি পেছাতে পেছাতে এখন এমন অবস্থায় চলে এসেছে, যখন অন্যান্য সংস্থাগুলো অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেসব প্রকল্পের সঙ্গে এখন এই প্রকল্প সাংঘর্ষিক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এখন এ জট ছোটানো অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পরিচালক এম এস আকতার বলেন, এ প্রকল্পের যেসব সমস্যা ছিল, তা এখন কেটে গেছে। জমি অধিগ্রহণ কিংবা অর্থায়ন কোনোটিরই সমস্যা নেই। আমরা তিন ভাগে ভাগ করে প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে প্রথম ধাপে বনানী পর্যন্ত ৬৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে গত আগস্ট পর্যন্ত। এর সঙ্গে আমরা সেকেন্ড ধাপেরও কিছু অংশ চালু করব। তেজগাঁও রেল স্টেশন পর্যন্ত মোট ১১ কিলোমিটার প্রথমে চালু হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads