• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

মূল কারণ ডলারের দাম বৃদ্ধি

ফের হুন্ডিতে আসছে রেমিট্যান্স

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৫ নভেম্বর ২০২১

ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে বেশি লাভজনক হওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে বাড়ছে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্তঃব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের রেট নির্ধারণ করে দেওয়ায় রেমিট্যান্সের জন্য ২ শতাংশ প্রণোদনা সত্ত্বেও ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডির মাধ্যমে আসা ১০০ ডলারের  রেমিট্যান্সে কমপক্ষে ৩৪৮ টাকা বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৭৫ পয়সা) রেমিট্যান্স গ্রহীতা ৮ হাজার ৫৮০ টাকার সঙ্গে সরকারের ২ শতাংশ প্রণোদনার ১৭১ টাকা ৬০ পয়সা যোগ করে সব মিলিয়ে ৮ হাজার ৭৫১ টাকা ৬০ পয়সা পান। আর যদি ওই প্রবাসী হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠান, তাহলে তার স্বজন ৯ হাজার ১০০ টাকার মতো তুলতে পারবেন। কারণ, খোলাবাজারে বর্তমানে ডলারের দর ৯১ টাকায় উঠেছে। এ কারণে প্রবাসীরা এখন আবার হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠাতে শুরু করেছেন, যেটা মহামারি করোনার কারণে গত দেড় বছরের বেশি সময় বন্ধ ছিল।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় অবৈধ পথে টাকা পাঠানো আবার পুনরায় সচল হয়েছে। আন্তঃব্যাংক লেনদেনের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য ৫ টাকার বেশি হওয়ায় অনেক প্রবাসী এখন হুন্ডির মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। আর এটা সরকারের হিসাবে থাকছে না; জমা হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশি মদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভে। ফলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি আর আগের উচ্চতায় নেই; ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

আর এ কারণেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস নেমেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক ও ব্যাংকাররা। নতুন করে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়া এবং মহামারির মধ্যে যারা দেশে এসেছিলেন, তারা ফিরে গিয়ে কর্মস্থলে যোগ দিতে না পারার কারণেও রেমিট্যান্স কমছে বলে মনে করছেন তারা।

করোনাভাইরাসের মধ্যেও অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪.৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ওই অঙ্ক ছিল আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বা ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। কিন্তু সেই জোয়ার আর নেই। এখন ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রতি মাসেই কমছে রেমিট্যান্স। গত অক্টোবর মাসে ১৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা এক মাসের হিসাবে গত দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। আর গত বছরের অক্টোবর মাসের চেয়ে কম ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক কমেছে ২০ শতাংশ। এই চার মাসে ৭০৫ কোটি ৫০ লাখ (৭.০৫ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৮৮১ কোটি ৫০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স।

বাংলাদেশে বরাবরই ব্যাংকিং চ্যানেলের পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান প্রবাসীরা। তবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের হিসাব পাওয়া গেলেও হুন্ডির মাধ্যমে যে অর্থ আসে, তার কোনো হিসাব কখনই পাওয়া যায়নি।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে একটি প্রাথমিক ধারণা দিয়ে বলেন, ‘গত অর্থবছরে ২৫ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড পরিমাণ যে রেমিট্যান্স এসেছিল, তা আসলে হুন্ডি বন্ধ থাকার কারণেই এসেছে। মহামারিকালে নানা ধরনের বিধিনিষেধের কারণে অর্থ লেনদেনের অবৈধ চ্যানেলগুলো বন্ধ ছিল।

‘সে কারণে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে কোনো অর্থ আসেনি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক; বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর অর্থ লেনদেনের অবৈধ চ্যানেলগুলো ফের চালু হয়েছে। তাই হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসছে। কমছে ব্যাংকিং চ্যানেলে।’

আহসান মনসুর বলেন, ‘গত কয়েক বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলো নানা পদক্ষেপ নেয়ার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের মতো রেমিট্যান্স এসেছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা রেমিট্যান্সের অঙ্কটা আসলেই এমনই; ১৬ থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে এক লাফে রেমিট্যান্স বেড়ে যে ২৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল, তা আসলে হুন্ডি বন্ধ থাকার কারণেই বেড়েছিল।

‘এ হিসাবে একটা ধারণা করা যেতে পারে যে, এখনও প্রতি বছর ৬ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো রেমিট্যান্স দেশে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি থাকায় তা আরো বেড়েছে’, বলেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম, রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন বেশি দিন থাকবে না। সেটাই হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, অনন্তকাল ধরে প্রবাসীরা বেশি অর্থ দেশে পাঠাবেন, এটার কোনো কারণ নেই। আর আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা বেশি দিন ধরে রাখা যায় না।’

আহসান মনসুর বলেন, ‘আমাদের একটা বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির বৈশ্বিক কোনো কারণ নেই। এখন সত্যিকার অর্থে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি পাঠানোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ অনেক শ্রমিক চলে এসেছেন। আবার যাওয়াও কমে গেছে। এভাবে চললে প্রবাসী আয় আরো কমে যাবে।’

দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা সোয়া কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ। দেশের জিডিপিতে সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।

ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে ৮৫ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণীসহ অধিকাংশ ব্যাংক সেই ডলার ৩ টাকা ৭৫ পয়সা বেশি লাভ রেখে ৮৯ টাকা ৫০ পয়সায় গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করেছে। আর খোলাবাজারে সেই ডলারের দাম উঠেছে ৯১ টাকায়। মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকগুলোর চেয়ে ৫০ পয়সা বেশি দরে ডলার বিক্রি করছে। তিন মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায়। ওই সময় ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করেছে ৮৬ টাকা থেকে ৮৬ টাকা ৫০ পয়সা দরে। খোলাবাজারে দর ছিল ৮৭ থেকে ৮৮ টাকার মধ্যে।

এদিকে, বাজারের চাহিদা বিবেচনায় প্রচুর ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১৯ আগস্ট থেকে বুধবার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৬৬ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। অথচ বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।

অর্থনীতির আরেক গবেষক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘করোনা মহামারির মধ্যে রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন অনেককেই বিস্মিত করেছিল। এ ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা হলো, সব ধরনের অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসছিল। যাতায়াতের বিধিনিষেধ ও বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি কার্যত বন্ধ থাকার কারণে হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিল না।’

কিন্তু এই অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর আবারো চালু হয়েছে। ফলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে।’

গত দেড় বছরে অনেক কর্মী বিদেশে যেতে পারেনি এবং এটি রেমিট্যান্সের ওপর একটি ‘সমষ্টিগত প্রভাব’ ফেলেছে মনে করেন সেলিম রায়হান।

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘সরকার রেমিট্যান্সের ওপর ৩ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। এটি করা হলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে।’

বাংলাদেশের বিদেশি মদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের নিচে নেমে এসেছে। গত ৪ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১১৩ কোটি ১০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা গত সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। বুধবার দিন শেষেও রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে অবস্থান করছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads