• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা

ভালো নেই রেলের কুলিরা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর ২০২১

পরিবার নিয়ে কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন কমলাপুর রেল স্টেশনের দুই শতাধিক কুলি। একদিকে যাত্রীর আনাগোনা কম থাকায় কমে গেছে কাজ, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা তারা। বর্তমানে ২১০ জন কুলি রয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় রেল স্টেশন কমলাপুরে। এদের কেউ এসেছেন বাড়ি থেকে পালিয়ে, কেউ অভাবের তাড়নায়, আবার কেউ নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে, কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে স্টেশনেই কুলির জীবন বেছে নিয়েছেন।

কুলির নম্বর দেন স্টেশন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালন করেন না তারা। তাদের নিয়োগসহ সবকিছু দেখার দায়িত্ব থাকে কুলি সরদারের হাতে। তবে কুলি সরদার নির্বাচন করেন  কমলাপুর রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার। এ বিষয়ে কমলাপুরের স্টেশনমাস্টার মো. আফছার উদ্দিন বলেন, সরদার নিয়োগ ছাড়া আমাদের সঙ্গে কুলিদের তেমন কাজ নেই। তবে কোনো বিশৃঙ্খলা বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হলে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও তা মীমাংসা করার জন্য বলি। রেলের প্রায় সব কুলির জীবনই কাটে ট্রেনে যাতায়াত করা যাত্রীদের লাগেজ বহন করে। যখন হুইসল বাজিয়ে স্টেশনে ট্রেন ঢুকে তখনই শুরু হয় তাদের আসল যুদ্ধ। গতকাল সোমবার দুপুরে সরেজমিনে কমলাপুর রেল স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, বসার স্থানে নিজেদের জীবিকা বহনকারী ট্রলি পাশে রেখেই ঘুমিয়ে আছেন ক্লান্ত অনেক কুলি। আবার কেউ কেউ হালকা শীতের রেশ দূর করছেন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে। কয়েকজন আবার কাজ শেষে ক্লান্তি দূর করতে মোবাইলে খেলা জমিয়েছেন।

তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছেলেমেয়ের পড়ালেখাসহ পরিবার নিয়ে থাকা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে তাদের পক্ষে। কেউ কেউ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দিন পার করছেন এই প্ল্যাটফরমেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কুলি জানান, বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পড়ালেখা না করেই ১৯৯০ সালে রাগ করে ঢাকায় আসলাম। আগে স্টেশনে অনেক কাজ ছিল, এখন নেই। খরচ বাড়লেও বাড়েনি আয়। তিনি বলেন, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য প্রতি মাসে ১২০০ টাকা বেতন দিতে হয়। প্রাইভেট খরচ ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ এখন মাত্র ১২-১৫ হাজার টাকার কাজ করতে পারি। ৪০ হাজার টাকা ঋণ করেছি।

আগে ঢাকায় রিকশা চালাতেন কুলি মো. সুমন। পরিশ্রম বেশি হওয়ায় এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহায়তায় এখানে কাজের ব্যবস্থা করেন। আগে ৭০০-৮০০ টাকার কাজ করতে পারলেও এখন ২০০-৩০০ টাকার কাজ করতেই কষ্ট হয় তার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকাল ৮টায় আসলাম, ১২টা পর্যন্ত এখনো কোনো কাজ পেলাম না। কোনো টাকা আয় করতে পারি নাই। অথচ নাস্তাসহ খরচ ঠিকই হইছে।

পাশে থাকা আরেক কুলি বলেন, যাত্রী আসলে যাত্রীদের মালামাল নিয়া যাই। যাত্রীরা খুশি হইয়া যা দেয় তাই নিই। কম হয়ে গেলে কিছু চাইয়া নিই।

জীবিকার তাগিদে ১০ বছর বয়সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় আসেন মোহাম্মদ আলী। ২৫ বছর ধরে স্টেশনে কুলির কাজ করা মোহাম্মদ আলী বলেন, আগে আমার যেখানে ৫০০-৬০০ টাকা আয় হতো, এখন ৩০০-৫০০ টাকাও আয় হয় না। সবকিছুর খরচ বাড়ায় এখন খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। আগে ১০০ টাকায় যা পেতাম এখন ৫০০ টাকায়ও পাই না। পরিবারকে নিয়ে আগেই ভালো ছিলাম।

দিনাজপুরের মো. ইসমাঈল জানান, ৮-৯ বছর ধরে এখানে কাজ করি। গতকাল সন্ধ্যায় আসলাম, দুপুর ১টায় ৫০০ টাকাও হয়নি। তিন হাজার টাকা বাসা-ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। আমাদের এত টাকা বাসা-ভাড়া দিয়ে যদি না থাকা লাগতো তাহলে চাপটা কম হতো।

কাজের বাইরেও কুলিদের নানা সমস্যা রয়েছে। দিনমজুর এসব কুলিরা বলছেন, এতগুলো মানুষ আমরা। কোনো থাকা-খাওয়া, গোসল, চিকিৎসা এসবের কোনো ব্যবস্থা নাই। এসব সমস্যা কেউ বলেও না। রেল থেকে কোনো সহায়তাও পাই না।’

এ বিষয়ে কুলি সরদার মো. নুরু মিয়া বলেন, এসব বিষয়ে আমাদের দাবি করার সুযোগ নেই। কোনো সহযোগিতাও রেল থেকে পাই না। ৪২ বছর ধরে কাজ করছি এখানে। মেডিকেল সহায়তাসহ কোনো সহায়তা পাই না আমরা।

এছাড়া কুলির কাজ করতেও কেউ কেউ টাকা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কুলি জানান, ৫০ হাজার টাকা দিয়ে এখানে কাজ পেয়েছে এমনও আছে। কিন্তু কেউ বলবে না। কারণ কিছু বললেই তার সমস্যা হবে। এখানে হয়তো কাজই করতে পারবে না।

জানতে চাইলে কুলিদের সরদার মো. নুরু মিয়া বলেন, স্টেশন কর্তৃপক্ষ সরদার নিয়োগ দেয়। বাকিদের আমরা নিয়োগ দিই। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো টাকার লেনদেন হয় না। কয়েকদিন কাজ করলে ভালো কি মন্দ এসব ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করি আমরা। তারপর তাকে একটা নম্বর দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads