• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

সিন্ডিকেটে জিম্মি কৃষকের সার

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৮ নভেম্বর ২০২১

চলতি বছর নন-ইউরিয়া সার আমদানিতে ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয় সরকার। ভর্তুকি পাওয়া এই ৩২টি কোম্পানির মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানেরই মালিক শেখ জাসিম উদ্দিন। তিনটি প্রতিষ্ঠানের মালিক সাদিকুর রহমান। দুটি করে কোম্পানি রয়েছে নাজনীন হোসাইন, আমিনুর রশিদ খান ও ফয়জুর রহমানের নামে। তালিকায় এসব ব্যক্তির মোবাইল নম্বরও একই দেখা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, মূলত এসব প্রতিষ্ঠানের কবজায় জিম্মি সারের বাজার। আর সারের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে আমদানিকারকদের ‘সিন্ডিকেট’কেই দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, চলতি বছর নন-ইউরিয়া সার আমদানিতে যে কয়েকটি কোম্পানি সরকারের ভর্তুকি পাচ্ছে, সেই তালিকায় একই ব্যক্তির নামে রয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠান।

ডিলাররা জানান, আমদানিকারকদের এই সিন্ডিকেটের কারণে তাদের ভুগতে হচ্ছে। হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তিই নন-ইউরিয়া সার আমদানি করে থাকে বলে জানিয়েছেন সার কোম্পানিতে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। এদিকে, ডিলাররা কৃষকদের কাছ থেকে সারের দাম বেশি রাখছেন এমন অভিযোগ থাকলেও তা অস্বীকার করেছেন তারা। তারা এজন্য সাব-ডিলারদের দায় করেন। এ ছাড়া সরকার সারের বাজারে কোনো সিন্ডিকেট দেখছে না অভিযোগ করেন তারা। তবে মজুত পরিস্থিতি ঠিক থাকায় বাজারে বাড়তি দামে সার বিক্রি হচ্ছে না বলে দাবি সরকার পক্ষের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সার কোম্পানিতে কর্মরত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই সময়ে নন-ইউরিয়া সারের চাহিদা বেশি থাকে। যারা সার আমদানি করে, তারা গুদামজাত করে সারের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ১০ থেকে ২০ জনের মতো আমদানিকারক রয়েছেন। মূলত তারাই সারের দাম বাড়িয়েছেন। কোনো ছোট ডিলার যদি দাম বাড়াত, তাহলে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সারের দাম বাড়ত। কিন্তু সারা দেশেই যেহেতু সারের দাম বেড়েছে, এই দাম বৃদ্ধির পেছনে আমদানিকারক ছাড়া অন্য কারো হাত নেই। বর্তমানে নন-ইউরিয়া সারের দাম বেশি। ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকার এমওপি এখন বিক্রি হচ্ছে ৮২০ টাকা বস্তায়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিভাগের এক ডিলার বলেন, ‘টাকা দেওয়ার পরও আমদানিকারকরা ডিলারদের দুই থেকে তিন দিন সময় নষ্ট করে। উপজেলাগুলোতে ডিলারদের সমান বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই কাগজ নিয়ে গুদামে গেলে আমদানিকারকরা নানাভাবে হয়রানি করে। টাকা পায়নি এমন অজুহাত দেখায়। হেড অফিস থেকে ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ার অজুহাতও দেখায়। অনেক সময় ডিলারদের মোকামে যেতে বাধ্য করা হয়। তাদের দেখার কথা, তারা কাগজ পেয়েছে কি না। কিন্তু তারা কাগজ পেলেও সার ডেলিভারি দেয় না।’

তিনি আরো বলেন, ‘ধরেন একদিনে ১০ থেকে ২০টি কাগজ (ডিও লেটার) গেল। তারা সেদিন সার না দিয়ে একসঙ্গে ৫০টি কাগজের সার দেয়। এতে মোকাম এলাকায় ট্রাকের সংকট দেখা দেয়। শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যায়। রাস্তায় যানজট তৈরি হয়। এ কারণে আমাদের ভুগতে হয়।’

নীলফামারীর একজন ডিলার ওয়াহেদ বলেন, ‘কৃষি অফিসের দেওয়া বরাদ্দপত্র নিয়ে আমদানিকারদের কাছে আমাদের যেতে হয়। এর আগে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে হয়। এখন পে-অর্ডার নিয়ে গেলে দ্রুত সার ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে।’ খুলনার ডিলার নাছির বলেন, ‘আমরা টাকা জমা দিলেও বরাদ্দপত্রসহ বিভিন্ন কাগজ তারা ভেরিফাই করে। সাধারণত তারা নির্দিষ্ট সময়ে সার ডেলিভারি দিয়ে দেয়। কিন্তু ক্রাইসিস থাকলে ভেরিফাইয়ের নাম করে দুই-তিন দিন দেরি করে। আবার অনেক সময় আমি ডিএসপি সার আনতে গেছি, কিন্তু তারা আমাদের এমওপি সারও আনতে বাধ্য করে। অর্থাৎ এক সারের সঙ্গে আরেকটি ট্যাগ করে দেয়।’ এক প্রশ্নের উত্তরে এই ডিলার বলেন, ‘একই মালিকের দুই-তিনটি কোম্পানি থাকতে পারে। আমদানিকারদের মাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনেক সিস্টার্ন কনসার্নও থাকতে পারে।’

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) তালিকাভুক্ত ৩২টি প্রতিষ্ঠান নন-ইউরিয়া সার আমদানি করবে। এসব প্রতিষ্ঠান সার আমদানিতে সরকারের ভর্তুকি পেয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো নোয়াপাড়া ট্রেডিং, সুফলা ট্রেডিং করপোরেশন, দিপা এন্টারপ্রাইজ, সফিউল্লাহ গালফ, নোয়াপাড়া ট্রেডার্স, তায়িবা শফিউল্লাহ (জি এল), ফয়েজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আলিফ ট্রেডিং, নওয়াজ ট্রেডার্স, কামরু এন্টারপ্রাইজ, ফয়েজ ট্রেডিং করপোরেশন, ডেইলি ট্রেডিং কোম্পানি লি., বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড, এশিয়া ওয়ান ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, ডিরেক্ট ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, ইউরেশিয়া ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, আকন এন্টারপ্রাইজ, এরাইজিং ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, সান সাইনিং লিমিটেড, আফরোজ ট্রেড এজেন্সি, আশফাক এন্টারপ্রাইজ, রত্না এন্টারপ্রাইজ, আজমাইন ট্রেডার্স, দিশা ইন্টারন্যাশনাল, মোশারফ অ্যান্ড ব্রাদার্স, এন এইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ও এম এন্টারপ্রাইজ, নাজনীন এন্টারপ্রাইজ, ইসলাম ব্রাদার অ্যান্ড কোং, দেশ ট্রেডিং করপোরেশন, উত্তরা ট্রেডার্স (প্রা.) লিমিটেড ও বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।

ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েন থেকে পাওয়া ওই তালিকায় দেখা গেছে, নোয়াপাড়া ট্রেডার্স, সাইফুল্লাহ গালফ ও তায়িবা সাইফুল্লাহ নামের প্রতিষ্ঠান তিনটির মালিক সাদিকুর রহমান একাই। অন্যদিকে ডেইলি ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড, এশিয়া ওয়ান ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, ডিরেক্ট কোম্পানি লিমিটেড ও ইউরেশিয়া ট্রেডিং কোম্পানি, এই পাঁচটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক শেখ জসিম উদ্দিন।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) চেয়ারম্যান কামরুল আশরাফ খান পোটন বলেন, ‘একই মালিক ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির নামে দরপত্রে অংশ নিতে পারেন। ভর্তুকি পাওয়া কোম্পানিগুলোর মালিক এক হতে পারে। এখানে আমাদের হাত নেই। আমাদের কোনো এখতিয়ার নেই। দরপত্রের পুরো বিষয়টি কৃষি মন্ত্রণালয় দেখে থাকে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদানিকারকদের মধ্যে সিন্ডিকেট আছে বাইরে থেকে আমরাও এটি শুনি। কিন্তু সরকারি কোনো প্রতিবেদন বা অন্য কোনো সংস্থার কাছে এমন কোনো প্রতিবেদন নেই। দরপত্রে অংশ নিতে গেছে, ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন কোনো অভিযোগও নেই। দরপত্রে অংশ নিতে আমাদের মেম্বারশিপ লাগে। আমরা আমাদের সব সদস্যকে দরপত্রে অংশ নিতে উৎসাহিত করি।’

এসব বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ উইং) মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ‘সার নিয়ে সমস্যা নেই। জেলা পর্যায়ে কোনো সমস্যা নেই। আপনারা বলছেন সমস্যা, আমাদের তথ্য বলছে কোনো সমস্যা নেই। সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ীই সবাই বরাদ্দ পাচ্ছে।’

একই মালিকের নামে একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ‘একাধিক প্রতিষ্ঠান একই মালিকের হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিটি কোম্পানি ভিন্ন নামের।’ বিএফএ থেকে দেওয়া তালিকাতেই একই ব্যক্তির নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কোনো সদুত্তর দেননি তিনি।

সার নিয়ে কোনো ধরনের সংকটের তথ্য স্বীকার করছে না কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরও। সংস্থাটির মহাপরিচালক আসাদুল্লাহ বলেন, ‘সারের মজুতের ঘাটতি নেই। দেশে সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। রবি মৌসুম ও আগামী বোরো মৌসুমে সারের কোনো সংকট হবে না। চাহিদা অনুযায়ীই সার পাওয়া যাবে।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সারের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে কোনো এলাকা থেকে এমন খবর এলে সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। আমরা নানাভাবে বাজার মনিটরিং করছি।’

জানা গেছে, দেশে ইউরিয়া সার সরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়ে থাকে। আর নন-ইউরিয়া সার সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে ৬০ শতাংশ ও বেসরকারি পর্যায়ে ৪০ শতাংশ সার আমদানি হয়ে থাকে। দেশে প্রতিবছর ইউরিয়া সারের চাহিদা ২৬ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ১০ লাখ টনের মতো। বাকিটা সরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়ে থাকে। টিএসপি সারের চাহিদা ৭ লাখ ৫০ হাজার টন। এর মধ্যে বিসিআইসি উৎপাদন করে ১ লাখ টন। বাকি ৬০ শতাংশ আমদানি করে বিএডিসি ও ৪০ শতাংশ আমদানি হয় বেসরকারি পর্যায়ে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads