• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

দৈনিক ইজারাতে বেশি আগ্রহ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৮ নভেম্বর ২০২১

ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পর বাসমালিকেদের দাবির মুখে ভাড়া বাড়িয়েছে বিআরটিএ। সেই সঙ্গে বন্ধ করা হয়েছে সিটিং সার্ভিস ও ওয়েবিলের নামে মালিকদের বাড়তি ভাড়া আদায়ের কৌশল। তবে বাস মালিকরা আগের মতো দৈনিক ফিক্সড টার্গেট বা দৈনিক ইজারা ভিত্তিতে বাস পরিচালনায় বেশি আগ্রহী। তাদের মতে, সিটিং সার্ভিস ও ওয়েবিল উঠিয়ে দেওয়ায় চালক-হেলপারদের বেতন দিয়ে বাস চালানো সম্ভব নয়।

এদিকে, বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করেও কোনোভাবে শৃঙ্খলা আনা যাচ্ছে না গণপরিবহনে। বাস পরিচালনায় বিআরটিএ শুধু ভাড়াই নির্ধারণ করে দেয়। বাস পরিচালনায় একদিকে যেমন মালিকরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী চলেন, তেমনি বহাল থাকে চালক-হেলপার-কন্ডাক্টরদের স্বেচ্ছাচারিতা।

কোম্পানির আওতাধীন রাজধানীর বিভিন্ন রুটের পরিবহনগুলো ট্রিপ হিসেবে চালক-হেলপারকে বেতন দিলেও লোকাল বাসগুলোর মালিকরা চালকদের দেন দৈনিক টার্গেট। অনেকটা দৈনিক ইজারা দেওয়ার মতো। দিন শেষে বাসমালিকের হাতে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা তুলে দিতে হবে। মালিকের হাতে নির্দিষ্ট টার্গেটের অর্থ তুলে দেওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, তা ভাগ করে নেন চালক ও হেলপার। বাসমালিকরা বলেন, কোম্পানিগুলো সিদ্ধান্ত নিয়ে ওয়ে বিল চালু করেছিল ড্রাইভার-হেলপারদের চুরি ঠেকানোর জন্য। ওয়ে বিলের আগে কোনোভাবেই তাদের কাছ থেকে সঠিক হিসাব পাওয়া যেত না। এমনও দিন যেত, তারা কোনো টাকাই দিত না। সে জন্য মালিকরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সিটিং সার্ভিস বাসগুলোতে ওয়ে বিল চালু করার। সে অনুযায়ী বিআরটিএতে একটা প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু সেটা আর কার্যকর হয় নাই। তারা আরো বলেন, সিটিং সার্ভিস চালু করা হয়েছিল যাত্রী-মালিক দুই পক্ষের কথা মাথায় রেখে। সিটিং সার্ভিসে আমরা মালিকরা যেমন ওয়েবিলের মাধ্যমে সঠিক হিসাবটা রাখতে পারতাম, তেমনি যাত্রীরা বসে আরাম করে তার গন্তব্যে যেতে পারত। তাছাড়া, দাঁড়িয়ে যাত্রী নিলে গাড়িতে অতিরিক্ত লোড হয়, সে জন্য তেল খরচ বেশি হওয়ার সাথে সাথে গাড়িরও ক্ষতি হয়। এ জন্য আমরা সিটিং সার্ভিসের পক্ষে ছিলাম। শুধু যাত্রীদের মাঝপথে নেমে গেলে বাড়তি ভাড়া দেওয়া লাগত। কিন্তু ওই যাত্রী কিছু টাকা বেশি দিলেও তো আরামে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারত, রাস্তায় রাস্তায় যাত্রী না তোলার কারণে তার সময়ও নষ্ট হতো না।

এখন সিটিং সার্ভিস না থাকলে ওয়েবিলও থাকবে না। তাহলে আমরা হিসাব রাখব কী করে? এখন বাধ্য হয়ে আমাদেরও দৈনিক টার্গেট হিসেবে চালকদের বাস দিতে হবে। তারা যাই করুক না করুক, দিন শেষে আমাদের টার্গেটের টাকা বুঝিয়ে দেবে।

চালকদের কাছে দৈনিক ইজারা দেন এমন একজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার বাস গাবতলী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যায়। এটি লোকাল বাস। তাই ওয়েবিলের সিস্টেম নাই। সে জন্য আমার মনিটর করার সুযোগ নাই, কতজন যাত্রী হলো। বাসের ড্রাইভার-হেলপার যা দেবে, তা নিয়েই আমার চুপ থাকতে হয়। ওরা ঠিকমতো টাকা দেয় না। তাই বাধ্য হয়ে টার্গেট দিয়ে দিয়েছি, প্রতিদিন ওরা যা-ই ইনকাম করুক, আমাকে ১৫ শ টাকা দেবে। সকালে আমি তেলের ট্যাংক ফুল করে দেই, রাতে গাড়ি জমা দেবার সময় তারাও পুরো তেল ভর্তি করে দেয়। আর রাস্তার ট্রাফিক মামলা, গাড়ির কাজ আমাকে করাতে হয়।

একাধিক লোকাল বাসের মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, রুটভেদে দৈনিক ইজারার পরিমাণ ভিন্ন হয়, যা চালকদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চালক বলেন, রুটভেদে ১৫শ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত মালিকরা টার্গেট বেঁধে দেন। এর মধ্যে তেল খরচ চালকের আর বাস মেরামত ও ট্রাফিক পুলিশের বিভিন্ন মামলার দায়িত্ব থাকে মালিকের ওপর। ইজারা বা দিন শেষে মালিকের টার্গেট যেভাবেই হোক দৈনিক পূরণ করতে হয়। ট্রিপ দিয়ে টার্গেটের টাকা উঠে না এলে চালক-হেলপারদের পকেট থেকে টাকা দিতে হয়।

‘শিকড় ট্রান্সপোর্ট’ ও ‘আকীক পরিবহনের’ সাবেক এমডি মাহমুদ হোসেন জানান, তার দুটি কোম্পানিতে ১২টি বাস ছিল। করোনা মহামারির কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা সামাল দিতে ১০টি বাস বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। এখন দুটি বাস মাসিক ৩৫ হাজার টাকা চুক্তিতে চালক-হেলপারদের ভাড়া বা ইজারা দিয়ে রেখেছেন।

মাহমুদ হোসেন আগে যখন সরাসরি এই পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তখন চালক-হেলপারদের ট্রিপ হিসেবে দৈনিক বেতন দিতেন। ‘শিকড়’ ও ‘আকীক’ কোম্পানির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি ট্রিপে চালক ও হেলপারকে দেওয়া হতো ৩০০ টাকা। এই টাকা তারা দুজন ভাগ করে নিতেন।

শিকড় পরিবহনের বাসগুলো মিরপুর ১২ নম্বর থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত চলাচল করত। মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ী গিয়ে আবার মিরপুরে ফিরে আসাকে একটি ট্রিপ হিসেবে ধরা হতো। দিনে সর্বোচ্চ চারটি ট্রিপ হতো। আর পুরো রাস্তায় কয়েকজন লাইনম্যানের মাধ্যমে ‘ওয়েবিল’ করে যাত্রীদের হিসাব রাখা হতো। এর বাইরে তেল খরচ, মেরামত খরচসহ আনুষঙ্গিক সব খরচের পর যা থাকত সেটা মাহমুদ হোসেনের হাতে আসত।

তখন দিন শেষে কত পেতেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করত যাত্রীর চাপের ওপর। যাত্রী বেশি হলে ১৫শ টাকা থেকে ২ হাজার টাকাও পাওয়া যেত, আবার কোনো দিন যাত্রী কম থাকলে ড্রাইভার-হেলপারকে নিজের পকেট থেকে দেওয়া লাগত।

মিরপুর এলাকা থেকে মাওয়া ঘাট পর্যন্ত চলাচল করে স্বাধীন পরিবহন। প্রতিষ্ঠানটির এমডি মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা ট্রিপ হিসেবে ড্রাইভার-হেলপারদের বেতন দিই। মাওয়া থেকে মিরপুর এলে ড্রাইভার পান ৪০০ টাকা আর হেলপার পান ৩০০ টাকা। এভাবে দিনে সর্বোচ্চ চারটা ট্রিপ হয়। ২ থেকে ৩ হাজার টাকা প্রতিদিন থাকে। যাত্রী না থাকলে কোনো কোনো দিন কিছুই থাকে না। তা ছাড়া গাড়ির কোনো কাজ লাগলে দেখা যায় একসঙ্গে অনেক টাকা খরচ হয়। যে মাসে গাড়ির বড় কাজে হাত দিতে হয়, ওই মাসে কোনো টাকাই আর আসে না বরং আরো পকেট থেকে যায়।

রাজধানীর ভেতরে বাস চালানোয় মালিকদের মিশ্র নিয়ম থাকলেও দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রে ইজারা ব্যবস্থা নেই। সেখানে প্রতি ট্রিপ হিসেবে টাকা পান চালক-হেলপার-‍সুপারভাইজার। ঢাকা-কুমিল্লাগামী তিশা এন্টারপ্রাইজে প্রতি ট্রিপে চালক পান ৫০০ টাকা, হেলপার আর ‍সুপারভাইজার পান ৩০০ টাকা করে মোট ৬০০ টাকা। ঢাকা থেকে কুমিল্লা গেলে এক ট্রিপ হিসাব করা হয়।

এভাবে ঢাকা থেকে কুমিল্লা গিয়ে আবার বিকেলে ঢাকা ফিরে এলে দিনে দুই ট্রিপ পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে সকল খরচ মালিক বহন করেন। সব খরচ শেষে প্রতিদিন ২৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা করে পান তিশা এন্টাপ্রাইজের একজন মালিক।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads