প্রাণিজ খাদ্যে ভেজাল রোধে দেশে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রাণিসম্পদ উৎপাদন উপকরণ ও প্রাণিজাত খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি (কোয়ালিটি কন্ট্রোল বা কিউসি ল্যাব)। এই ল্যাব ইতিমধ্যে আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতিও অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
জানা যায়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) শীর্ষস্থানীয় গবেষণাগার কিউসি ল্যাব উদ্বোধন হয়েছে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রায় ১১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত এই ল্যাব চালু হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে অপার সম্ভাবনা দেখিয়ে চলেছে।
কিউসি ল্যাব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জব্দ করা ভেজাল প্রাণিজ খাদ্যপণ্যের মান যাচাই করা হয় এই ল্যাবে। অনেক সময় বিষাক্ত জিনিস থাকে, যা কেউ ইচ্ছাকৃত দেয়নি, কিন্তু খাবারের মধ্যে সেটি থেকে যাচ্ছে, সেটাও কিউসি ল্যাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। যেমন হ্যাভি মেটাল, বাংলাদেশে প্রচুর এসিড ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই লেড এসিডগুলো যেখানে সেখানে ফেলা হয়, সেটা আবার বৃষ্টির পানির মাধ্যমে মাঠেই যাচ্ছে। সেখানে যে ঘাস উৎপাদন হচ্ছে সেটা গরু খেলে সেই লেডটা দুধের মধ্যে আসছে। এছাড়া ফসলে কীটনাশক দেওয়া হয়, সেখানে ফসলে আগাছা জন্মায়। সেই আগাছা আবার গরুর খাদ্য, ফলে কীটনাশক দেওয়া ফসলের ঘাস খাওয়ায় গরুর মাংস ও দুধের মধ্যেও কীটনাশকের রেশ থেকে যায়। কৃষক ভালো ফসলের জন্য এটি দেন, কিন্তু সেটির ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে বিষাক্ত জিনিস খাদ্যে চলে আসছে। এসব বিষয়গুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে কিউসি ল্যাবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে এই ল্যাবের সেফটি ডিজাইন করা হয়েছে এবং এটি বিএসএল-২ ক্যাটেগরির একটি অত্যাধুনিক পরীক্ষাগার।
ঢাকা জেলার সাভারে ১.৬৪ একর ভূমির ওপর অত্যন্ত উন্নতমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে দৃষ্টিনন্দন ছয়তলাবিশিষ্ট মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি ভবন, চারতলাবিশিষ্ট ডরমিটরি ভবন ইত্যাদি মিলিয়ে কিউসি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া ল্যাবরেটরি ভবন ও ক্যাম্পাস এলাকার নিরাপত্তার জন্য অটোমেটেড ডিজিটাল নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও অ্যালার্ম সম্বলিত ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম বসানো আছে। ল্যাবরেটরির সব কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং চলাচলের সুবিধা ও নিরাপত্তার জন্য ইমারজেন্সি সিঁড়ি ও দুইটি লিফট সংযোজিত আছে। ছয়তলাবিশিষ্ট ল্যাবরেটরি ভবনের নিচতলায় বিশাল এলইডি মনিটর ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধাসহ একটি অত্যাধুনিক কনফারেন্স হল রয়েছে। দ্বিতীয় তলা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় ল্যাবরেটরির চারটি শাখা স্থাপন করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাণিসম্পদ উৎপাদন উপকরণের মান নিশ্চিত করা গেলে একদিকে যেমন গুণগত ও মানসম্পন্ন প্রাণিজাত খাদ্যের উৎপাদন বাড়বে, তেমনি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব হবে। ভালো বীজে ভালো ফসল; প্রাণিসম্পদ উৎপাদন উপকরণের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য, কারণ খাদ্যের গুণগত ও পুষ্টিমান ঠিক না থাকলে প্রাণিজাত পণ্য তথা দুধ, ডিম ও মাংসের উৎপাদন হ্রাস পায়। তাই কিউসি ল্যাবের মাধ্যমে উৎপাদন উপকরণের গুণগত মান নিশ্চিত করা হলে একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যয় কমবে, অন্যদিকে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে টেকসই প্রাণিসম্পদ উৎপাদনও সম্ভব হবে।
প্রাণিজ আমিষ তথা মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। দেশে মানসম্পন্ন প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন নিশ্চিত করতে মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন ২০১০, পশুখাদ্য বিধিমালা ২০১৩, পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১-সহ বেশকিছু আইন ও বিধিমালা রয়েছে। কিন্তু দেশে কোনো মানসম্পন্ন ল্যাব বিশেষ করে প্রাণিজাতপণ্য পরীক্ষা করার জন্য কোনো কিউসি ল্যাব না থাকায় এতদিন আইনগুলোর সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন খুবই দুরুহ ছিল।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং ডিম উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। ডেইরি সেক্টরে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং ডেইরি উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই দেশ দুধ উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রাণিসম্পদ খাতের এ উন্নয়ন অব্যাহত রাখার জন্য এবং দেশের প্রাণিসম্পদ উৎপাদন উদ্যোক্তাদের স্বার্থে প্রাণিজাতপণ্য বিদেশে রপ্তানি করার সময় এসেছে। বিদেশে রপ্তানির জন্য ‘মানসম্পন্ন ও নিরাপদ প্রাণিজাত পণ্য’ উৎপাদনের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে পথ দেখাবে কিউসি ল্যাব।
কর্মকর্তাদের মতে, আধুনিক প্রযুক্তির এবং পরিবেশবান্ধব সব সুবিধা কিউসি ল্যাবে সংযোজন করা হয়েছে। কিউসি ল্যাবের সেবা সারাদেশে সম্প্রসারণ করা গেলে মানুষের জন্য মানসম্পন্ন প্রাণিজ আমিষ নিশ্চিত করা যাবে এবং প্রাণিজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ তৈরি হবে।
সার্বিক বিষয়ে কিউসি ল্যাব স্থাপন প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মোস্তফা কামাল বলেন, আমরা মূলত প্রাণিসম্পদের যে উৎপাদন উপকরণ আছে, যেমন পশুপাখির খাদ্য, ওষুধ, মিনারেল এবং পশুপাখি থেকে আমরা যেসব প্রাণিজাত পণ্য পাই, যেমন দুধ, ডিম, মাংস; এগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানে করছি। এখানে আমাদের স্টেকহোল্ডারের মধ্যে রয়েছেন যারা পশুপাখির খাদ্য আমদানি করেন, যারা মাংস রপ্তানি করেন তারা। এই স্টেকহোল্ডাররা এ সমস্ত উপকরণের মান সংক্রান্ত পরীক্ষার জন্য আমাদের এখানে নমুনা নিয়ে আসেন। ইতোমধ্যে এই গবেষণাগারটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। কিউসি ল্যাবের ফলাফল এখন সারাবিশ্বে গ্রহণযোগ্য।
প্রাণিজাত খাদ্যের ভেজালরোধের কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রাণিজাত খাদ্যে ভেজালের একটি বিষয় রয়েছে। এটি রোধে সারাদেশে যে মোবাইল কোর্টগুলো হয়, সেটা প্রশাসনের সহায়তায় এবং প্রাণিসম্পদের জেলা ও উপজেলা অফিসের উদ্যোগে। সেই মোবাইল কোর্ট থেকে যে সন্দেহভাজন নমুনাগুলো সংগ্রহ করা হয়, তার স্যাম্পল এখানে পাঠানো হয়, এগুলো আসলে সঠিক কি না। আমরা এসব পরীক্ষা করে ফলাফল দিচ্ছি। মান নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত যে আইনগুলো রয়েছে সেগুলোর মাঠ পর্যায়ের ইমপ্লিমেন্টশনটা সহজ হয়েছে। প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট যেমন মাংস, দুধসহ অন্যান্য খাদ্যে ভেজাল রোধে বড় ভূমিকা রাখছি। আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল মূল সমস্যা, তাই আমাদের মূল টার্গেট ভেজাল দূর করা। এছাড়া আমরা উদ্ভাবনের কাজও করছি। একটি ল্যাব দিয়ে তো সারা দেশের ভেজাল দূর করা সম্ভব হবে না। আমরা নতুন নতুন পরীক্ষার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করছি।
কিউসি ল্যাবের মাধ্যমে রপ্তানির সম্ভাবনা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ প্রাণিজাত খাদ্য উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে প্রাণিসম্পদ উৎপাদন উপকরণ ও প্রাণিজাত খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে। আর্ন্তজাতিক মানের এই গবেষণাগারে একদিকে যেমন প্রাণিজখাদ্য উপাদান বিশ্লেষণ করা যাবে, অপরদিকে প্রাণী থেকে উৎপাদিত দুধ, ডিম, মাংস মানসম্মত কি না, পুষ্ট উপাদান সমৃদ্ধ কি না, স্বাস্থ্যসম্মত কি না এবং মানুষের খাদ্য হিসেবে নিরাপদ কি না সেটি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে।