• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা বন্ধ হচ্ছে!

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং সেবার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রাহকের তথ্য সুরক্ষার ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় এই সিদ্ধান্তের দিকে হাটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ ডিজিটাল ব্যাংকিংকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগের জন্য বাধা বলে মনে করছে ব্যাংকগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে দুটি ব্যাংকের আবেদন নাকচ করেছে, যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা চালু করতে চেয়েছিল।

সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো যদি ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ভাইবারের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব হবে। কারণ তাদের (ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক মেসেঞ্জার) বাংলাদেশে কোনো অফিস নেই।

বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) নীতিমালা অনুযায়ী, যে কোনো উৎপাদিত, সংগৃহীত এবং প্রক্রিয়াকৃত তথ্য দেশের অভ্যন্তরে তথ্য স্থানীয়করণের নিয়ম অনুযায়ী সংরক্ষণ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা মেসেজিং প্ল্যাটফরমগুলোর বাংলাদেশের মধ্যে তথ্য সংরক্ষণ করার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই গ্রাহকদের তথ্য পাচার হতে পারে। গ্রাহকদের আগ্রহ এবং আর্থিক তথ্য নিরাপত্তার জন্য এতে সম্ভাব্য হুমকি রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দেওয়া ব্যাংকিং পরিষেবা সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করতে বলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের এই ধরনের ব্যাংকিং পরিষেবা না দেওয়ার জন্য আরো একটি নির্দেশনা নিয়ে আসতে পারে।

বাংলাদেশের কিছু ব্যাংক ইতোমধ্যেই মেসেজিং প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে আর্থিক পরিষেবা প্রদান করছে, যা করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে।

মূলত হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকরা ব্যালেন্স অনুসন্ধান করতে পারেন, অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট পেতে পারেন, এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে তহবিল স্থানান্তর করতে পারেন, মোবাইল ফোন রিচার্জ এবং ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে পারেন।

অনলাইন ব্যাংকিংয়ের জন্য গ্রাহকদের ক্রমবর্ধমান পছন্দকে অগ্রাধিকার দিয়ে কিছু ব্যাংক ইতোমধ্যেই ডিজিটাল ব্যাংকিং সম্প্রসারণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্ল্যাটফরম তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও করেছে।

বেসরকারিখাতের মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) ২০২১ সালের জুনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং চালু করে এবং একমাস পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এমটিবির আবেদন গেল বছরের অক্টোবরেই বাতিল করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে ১১ হাজার গ্রাহক হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সেবা পেতে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্ল্যাটফরমে নিবন্ধন করেছেন।

এ বিষয়ে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে জনবল নিয়োগ করা হয়েছে।

বিশ্বের অনেক দেশ ব্যাংকগুলোকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে পরিষেবা প্রদানের অনুমতি দিয়েছে।

মাহবুবুর রহমান বলেন, তরুণ গ্রাহকরা এখন প্রথাগত ব্যাংকের পরিবর্তে ডিজিটাল ব্যাংকিং পছন্দ করেন তাই আমরা বিশ্ব মডেল অনুসরণ করে পরিষেবাটি চালু করেছি।

 বেসরকারিখাতের ঢাকা ব্যাংক ২০২০ সালে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যাংকিং চালু করে। এ বিষয়ে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক চৌধুরী বলেন,  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংকগুলোকে অন্তত ছোট পরিসরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেওয়া।

জানা গেছে, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড গত বছর দুই লাখের বেশি গ্রাহককে ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং ভাইবারের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা দিয়েছে।

প্রাইম ব্যাংক চার থেকে পাঁচ মাস আগে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যাংকিং চালু করেছিল এবং প্ল্যাটফরমটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্ল্যাটফরমের সঙ্গে নিবন্ধিত গ্রাহক ৭০ হাজারের কাছাকাছি।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, আইসিটি নীতিমালার তথ্য স্থানীয়করণের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের তথ্য দেশের অভ্যন্তরে সংরক্ষণ করতে হবে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, হোয়াটসঅ্যাপ ২০১০ সালে ভারতে একটি সার্ভার সেট করেছে, যাতে দেশে উৎপন্ন তথ্য স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করা যায়। তিনি আরো বলেন, ‘সরকার হোয়াটসঅ্যাপকে বাংলাদেশে একটি সার্ভার স্থাপনের অনুরোধ করতে পারে। যা এই সমস্যার সমাধান করবে।

বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সেবা প্রদান নিষিদ্ধ করা। কারণ গ্রাহকরা ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের ভারতের মডেল অনুসরণ করা উচিত এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত সামাজিক যোগযোগমাধ্যম প্ল্যাটফরমগুলোর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা। তিনি বলেন, হোয়াটসঅ্যাপ বাংলাদেশে সার্ভার স্থাপনে আগ্রহ দেখাতে পারে, কারণ এতে তাদের আয়ও বাড়বে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাইটের মাধ্যমে সেবা সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ ও সমাধানের অনুমতি দেয়।

এমটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা পরিচালনার জন্য তারা জনবল নিয়োগ করেছেন। অনেক দেশেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং সেবার অনুমোদন দিয়েছে।

তরুণরা প্রথাগত ব্যাংকিংয়ের পরিবর্তে ডিজিটাল ব্যাংকিং বেশি পছন্দ করছে উল্লেখ করে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা বৈশ্বিক মডেল অনুসরণ করেই সেবাটি চালু করেছি।’ ২০২০ সালে ঢাকা ব্যাংক হোয়াটসঅ্যাপ ব্যাংকিং সেবা চালু করে।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছোট আকারে হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা পরিচালনার অনুমতি দেওয়া।’

ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেড ফেসবুক মেসেঞ্জার ও ভাইবারের মাধ্যম ব্যবহার করে গেল বছর ২ লাখেরও বেশি গ্রাহককে ব্যাংকিং সেবা দিয়েছে।

প্রাইম ব্যাংক ৪ থেকে ৫ মাস আগে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্ল্যাটফরমটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই প্ল্যাটফরমে ইতোমধ্যে ৭০ হাজার গ্রাহক নিবন্ধন করেছেন।

বাংলাদেশে এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির জানান, আইসিটি নীতিমালা অনুযায়ী, সব প্রতিষ্ঠানকে দেশের ভেতর তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। তিনি ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে ২০১৯ সালে হোয়াটসঅ্যাপ তাদের সার্ভার স্থাপন করেছে, যাতে সেদেশের তথ্য স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করা যায়। আলমাস কবির বলেন, ‘সরকার হোয়াটসঅ্যাপকে বাংলাদেশে আলাদা সার্ভার স্থাপনের জন্য বলতে পারে। এতে সমস্যার সমাধান হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মী জানান, ডিজিটাল ব্যাংকিং-এ গ্রাহকরা ক্রমেই বেশি বেশি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন, এমন অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার করে ব্যাংকিং বন্ধ করা ঠিক হবে না’। তিনি বলেন, আমাদের উচিত ভারতের মডেল অনুসরণ করা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা। তিনি জানান, হোয়াটসঅ্যাপও বাংলাদেশে সার্ভার বসাতে আগ্রহী হতে পারে, কারণ এতে তাদের আয় বাড়বে।

গত বছর সেপ্টেম্বরে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংককে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রাহকদের অভিযোগ গ্রহণ ও তা সমাধানের অনুমোদন দেয়। যার অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের দৃষ্টিভঙ্গি ও সর্বশেষ নির্দেশের মধ্যে একটি গরমিল রয়েছে, বলে একজন ব্যাংকার মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত।’

সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন জানান, প্রতি মাসে তাদের ব্যাংক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রাহকদের ৯ হাজারের মতো সমস্যার সমাধান করে। তিনি বলেন, যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ধরনের সেবায় নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে ওয়েবসাইট বা গ্রাহক সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে এই সেবা দিতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads