• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

লুটপাটে ভেস্তে যাচ্ছে রেলের উন্নয়ন প্রকল্প

  • প্রকাশিত ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

রতন বালো :

 

রেলকে ঢেলে সাজাতে একের পর এক নেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা। এজন্য স্বাধীনতার ৫০ বছরে রেলের উন্নয়নে হাতে নেওয়া হয় চার শতাধিক প্রকল্প। কিন্তু এসব প্রকল্পের নামে লুটপাট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এমনকি খাতাপত্রেও কিছু প্রকল্পের মেয়াদ শেষও দেখানো হয়েছে। তাই কোনো সুফল পায়নি যাত্রীরা। অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ রেল কর্মকর্তা আন্তরিক হয়ে কাজ করছেন না। অথচ মাস শেষে বেতনসহ সরকারি সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। রেল কর্মকর্তাদের কাজের প্রতি আন্তরিক ছাড়া রেল উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন রেল বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেছেন, কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির কারণে রেলের ওপর  থেকে ‘শনি আছর’ দূর হচ্ছে না। বিগত ও বর্তমান সরকার নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে রেলের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। উল্টো বাড়ছে রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে ট্রেন দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রীরা। অন্যদিকে নতুন ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট-ডিইএমইউ (ডেমু) ট্রেন নিয়ে বিপাকে রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের সুবিধার জন্য এ কমিউটার ট্রেন নামানো হলেও এখন তা বিপাকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনা হয়। অথচ এ অর্থে ১০টি ইঞ্জিন ও ১২০টি কোচ কেনা সম্ভব হতো, যাতে নতুন ১০টি ট্রেন পরিচালনা করা যেত। এছাড়া ডেমু ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি সাধারণ ট্রেনের তুলনায় অনেক হালকা ও কম টেকসই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেছেন, রেল কর্মকর্তাদের আন্তরিক ছাড়া রেল উন্নয়ন সম্ভব নয়। সৎ কর্মকর্তারাই রেল সেবা বাড়াতে পারে। পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান  হতে হবে। তবেই রেল উন্নয়ন সম্ভব।

রেল বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, চেকআপবিহীন ট্রেন চলাচল ও জনবল সঙ্কটের কারণে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১ হাজার ৮টি ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৩০ জন। গবেষকরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় প্রতিরোধযোগ্য এসব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আর রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, দুর্ঘটনা রোধে রেলের অনেক বিধিবিধান রয়েছে, সেগুলো মানা হয় না বলেই বাড়ছে দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় চরম বিড়ম্বনায় পড়ছেন ট্রেন যাত্রীরা। বিপর্যয় দেখা দিয়েছে ট্রেনের শেডিউল। সারা দেশে ২ হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার রেলপথের অনুমোদিত ১ হাজার ৪১২টি ও অননুমোদিত ১ হাজার ৮৩টি অর্থাৎ মোট ২ হাজার ৪৯৫টি রেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৫৯টিতে গেটম্যান আছে। বাকি ২ হাজার ২৩৬টিতে কোনো গেটম্যান নেই।

জানা গেছে, রেলপথ রক্ষণাক্ষেণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান প্রকৌশলীর অধীনে পিডব্লিউআই (পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর), এপিডব্লিউআই (অ্যাসিস্ট্যান্ট পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর), মিস্ত্রি, চাবিম্যানসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকেন। প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার ১০ মিনিট আগে রেলপথ চেকআপ করার কথা থাকলেও সেটা হচ্ছে না। তাই দিন দিন ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ছে। পিডব্লিউআই সপ্তাহে একদিন এবং এপিডব্লিউআই সপ্তাহে তিন দিন এলাকাভিত্তিক রেলপথ পরিদর্শন করার কথা থাকলেও তারা তা করছেন না। অন্যদিকে মিস্ত্রির প্রতিদিন লাইন চেক করার এবং চাবিম্যানের প্রতিদিন লাইনের চাবি, ওয়াশার, নাট-বোল্টু চেক করার কথা থাকলেও তারা করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে রেল উন্নয়নে সরকার ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যাত্রা শুরুর পর দায়িত্ব নেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। দায়িত্ব পাওয়ার পরই তিনি দুর্বল রেল ব্যবস্থার ‘কালো বিড়াল’ খুঁজে বের করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী এ মন্ত্রী পাঁচ মাস না পেরুতেই অর্থ কেলেঙ্কারির বোঝা মাথায় নিয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।

এরপর দায়িত্ব দেওয়া হয় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে। তার দৃশ্যমান তৎপরতার কারণে পরের দিনগুলোতেও আলোচনায় থাকে এ মন্ত্রণালয়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠিত হয়। ২০১২ সালে ৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সরকারের মেয়াদ তিন বছর পূর্ণ হওয়ার ১৩ মাস বাকি থাকতে আলোচিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের এমপি মুজিবুল হক। তিনি রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই অঙ্গীকার করেছিলেন, রেলে এখন থেকে কোনো দুর্নীতি হবে না, শেষ সময়ে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন এবং নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। ট্রেনের শিডিউল রাখার জন্য সবধরনের ব্যবস্থা নেবেন।

এর পর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর  রেলপথ মন্ত্রণালয়ে  মো. নূরুল ইসলাম সুজন নিযুক্ত হন এবং ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শপথগ্রহণ করেন। তিনিও  রেলের উন্নয়নের নানা কথা বলছেন। তার পরেও লোকসানের ভারে নুয়ে পড়ছে রেলওয়ে। আয় নেই, খরচের খতিয়ান শুধু বাড়ছেই। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভর্তুকিও। তার মধ্যে ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নিম্নমানের ডেমু ট্রেন আরো বেকায়দায় ফেলেছে রুগ্ন রেলওয়েকে।

রেলকে সাজিয়ে-গুছিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়ে নেওয়া হয়েছে একের পর এক শত শত কোটি টাকার নানা পরিকল্পনা। এসব প্রকল্প ভবিষ্যতে কতটুকু বাস্তবসম্মত হবে সেদিকে লক্ষ্য না রেখে শুধু পরিকল্পনার সম্ভাব্যতা যাচাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর প্রকল্প কাজের নামে খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদন ও বাজেট বরাদ্দ পাওয়ার পরই থেমে গেছে সব দৌড়ঝাঁপ। অসাধু রেল কর্মকর্তা, কথিত কর্মচারী নেতা আর ঠিকাদাররা মিলে প্রকল্পের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন, নিজেরাই বনে গেছেন কোটিপতি।

বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও রেল বিভাগ থেকে দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করা যাচ্ছে না! ফলে রেল বিভাগ লাভজনক প্রতিষ্ঠান হতে পারছে না। রেল উন্নয়নে বর্তমান সরকার ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৬টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে কোনোটি ২০১১ সালের শেষ দিকে এবং কোনোটি পর্যায়ক্রমে আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে শেষ হয়েছে। এছাড়া ২০২০-২১ সালের মধ্যে বাকি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রেলের উন্নয়ন ও যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধি হয়নি।

রেল বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইতোপূর্বেও সরকার নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। কিন্তু অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাট আর নানামুখী সমস্যা থাকার কারণে সব উদ্যোগই ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে লাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে রেল। যদিও ১৯৮২ সালের আগে রেলওয়ের বোর্ড চালু থাকা অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ছিল না। রেলের ইনফরমেশন বুকের ২০০৫ এর তথ্যানুযায়ী ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রেল বিভাগ লাভজনক প্রতিষ্ঠানে ছিল। ১৯৯৯ সালে ১৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা মুনাফা করে। ২০০০ সাল থেকে পরিকল্পিতভাবে একে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়।

রেল বিশেজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ডিএফআইডিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার পরামর্শে রেল খাত ক্রমেই নানা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

এ বিষয়ে রেল কর্মকর্তাদের আন্তরিক ছাড়া রেলের উন্নয়ন সম্ভব নয় এ কথা স্বীকার করেন সাবেক রেলওয়ের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, রেল উন্নয়নের নামে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়, যদি সঠিক কাজ হতো রেল কর্তৃপক্ষ লাভের মুখ দেখতো। তিনি সকলে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান।

এ বিষয়ে জানার জন্য রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী রেলকে সচল করার জন্য আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। লাভ করার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ কাজ করছে না। যাত্রী সেবা দেওয়াই আমাদের মূল কাজ।

অতীতের মন্ত্রীদের মতো বর্তমান মন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনও রেল উন্নয়ন ও যাত্রী সেবা বৃদ্ধির অঙ্গীকারের কথা বলেন। তিনি অতীতের দুর্নীতি নিয়ে কিছু বলতে চান না। আগে কী দুর্নীতি হয়েছে না হয়েছে তা সবাই জানে। তবে, এখন থেকে রেলে আর কোনো দুর্নীতি হবে না। কোনো দুর্নীতিকে তিনি প্রশ্রয় দেবেন না। এখন টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করা, সঠিক সময়ে ট্রেন চলাচল ও ট্রেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা তার মূল লক্ষ্য। সাধারণের কোনো লাভ হয়নি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads