• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

রাতের আতঙ্ক ডাকাত

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

রাজধানী ও আশপাশের সড়ক-মহাসড়কে ওঁৎ পেতে আছে ভয়ংকর ডাকাত। কখনো যাত্রীবেশে, কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া ডিবি-র্যাব সেজে এসব ডাকাতচক্র সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের। এমনকি বাধা দিলে খুনের মতো ঘটনা ঘটাতেও দ্বিধাবোধ করছে না। আর এতে রাতের রাজধানীতে বাড়ছে আতঙ্ক।

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বহুরূপী ডাকাতদলের অন্তত ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে ডাকাতি কাজে ব্যবহূত সরঞ্জাম ও ডিবির পোশাক জব্দ করা হয়। কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এ সব ডাকাতদলের সন্ধান পায় তারা। এমন অবস্থায় রাজধানীজুড়ে টহল জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম।

জানা যায়, সম্প্রতি রাজধানীর ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অধ্যয়নরত দুই ভারতীয় ছাত্র ছিনতাইয়ের শিকার হন। এ ঘটনার তদন্ত করতে দুর্ধর্ষ এক ডাকাতদলের সন্ধান পায় গোয়েন্দা পুলিশ। পরে অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মো. ফখরুল ইসলাম ওরফে ফকু, মো. আলমাস, মো. মামুন, মো. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ আহম্মেদ ওরফে আসিক, মো. শাহিন, মো. বাবু ও মো. শফিকুল ইসলাম। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি প্রাইভেট কার ও লুট হওয়া মালামাল উদ্ধার করা হয়।

ডিবি বলছে, চক্রটি অন্যের কাছ থেকে প্রাইভেট কার ভাড়া করে নম্বর প্লেট ঢেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দাঁপিয়ে বেড়াত। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পথচারীর সর্বস্ব লুটে মুহূর্তে সটকে পড়ে। ২৩ জানুয়ারি ভোরে শিক্ষা ছুটি পেয়ে আসাম যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়ে রাজধানীর পশ্চিম মালিবাগে ছিনতাইয়ের শিকার হন দুই ভারতীয় শাহীল আহমেদ (২০) ও আসিফ ইকবাল (২২)। পরে রমনা থানায় মামলা করেন শাহীল আহমেদ।

গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন অ্যান্ড ডিবি-দক্ষিণ) মো. মাহবুব আলম জানান, ছিনতাই মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে তারা সাত সদস্যের একটি ডাকাতদলের সন্ধান পান। যদিও ঘটনার সময় চারজন উপস্থিত ছিল। চক্রটি গাড়ি ভাড়া নিয়ে রাতভর ডাকাতি করে। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে গাড়ির নম্বর প্লেট ঢেকে রাখত। চক্রটি সপ্তাহে একদিন ডাকাতি করত। তাদের প্রত্যেক সদস্যের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তবে মূলহোতা আসিকের বিরুদ্ধে আটটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। ঘটনার পরে ছিনতাই মামলা হলেও এটি এখন ডাকাতি মামলায় রূপান্তর হবে বলে জানান তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব আলম বলেন, টহল পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও নজর রাখছেন। সবার চোখ ফাঁকি দিয়েই ছিনতাইকারীরা এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনতে ডিবি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

সম্প্রতি রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভারে এক মাছ ভ্যবসায়ীকে লেগুনা থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। আর এ হত্যার সঙ্গে খোদ লেগুনার চালক ও হেলপার জড়িত ছিল। মাছ ব্যবসায়ী লেগুনা উঠার পর তার কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় বাধা দিলে তাকে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়। আর এ কারণে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ওই মাছ ব্যবসায়ীর। পরে পুলিশ অনুসন্ধান করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। আর ওই ৪ জনই একটি ডাকাতদলের সক্রিয় সদস্য বলে পুলিশ জানায়। 

এদিকে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে মহানগর ও আন্তঃজেলা দুর্ধর্ষ ডাকাত দলের মূলহোতাসহ ৮ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ। গত ৩১ জানুয়ারি এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো মো. মোজাম্মেল হোসেন আপেল ওরফে হাজী, জাহাঙ্গীর আলম, মো. জমির খান, মজিবর রহমান মজিদ ওরফে মোক্তার, মাসুম গাজী, শফিকুল খরাদী, কুদ্দুস আলী ও কাউছার মিয়া।

এই সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের কবলে পড়েছিলেন বাসের যাত্রী এক চিকিৎসকসহ বেশ কয়েকজন। ভয়ংকর এ ডাকাতদলের সদস্যরা ১৪ ঘণ্টা বাসে ঘুরিয়ে পরে সাইনবোর্ড এলাকায় বাস রেখে যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নিয়ে চলে যায়।

তাদের গ্রেপ্তারের ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এম হাফিজ আক্তার বলেন, কিছু লোক মোহাম্মদপুর থানার বসিলা এলাকায় তিন রাস্তার মোড়ে নূর বিরিয়ানী দোকানের সামনে ১টি হাইয়েস মাইক্রোবাস ও ১টি প্রাইভেটকার নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর সময় তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় ডাকাতির কাজে ব্যবহূত একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস জব্দ করা হয়। পরবর্তীতে মাইক্রোবাসটি তল্লাশি করে ১টি বাটযুক্ত ব্যারেল কাটা দুনালা বন্দুক, ১টি ওয়্যারলেস সেট, ১টি হ্যান্ডকাফ, ২টি ডিবি লেখা জ্যাকেট, ২টি লোহার চাপাতি ও ২টি লোহার ধারালো ছুরি উদ্ধার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, কয়েক মাসে এ দুর্ধর্ষ ডাকাত দলটি টাঙ্গাইল, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ ঢাকা মহানগরের আশপাশ এলাকায় বেশ কয়েকটি ডাকাতি সংঘটিত করেছে। এ চক্রের সাথে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা ও সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিচ্যুত বেশ কিছু সদস্য সম্পৃক্ত।

গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলার তথ্য পাওয়া যায়। এ পেশাদারচক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে মর্মে পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ডাকাতদলের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো-এফ এম সাজ্জাদ হোসেন ওরফে সাগর, মো. জাবেদ হোসেন, মো. ওয়াসিম আকরাম, মো. সাইদ হোসেন, দীপঙ্কর বিশ্বাস ও মো. শাহীন হোসেন। এসময় তাদের হেফাজত থেকে ৪টি চাকু উদ্ধারমূলে জব্দ  করা হয়।

ডাকাতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে ডিবি জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিশেষকরে গণপরিবহনে, মার্কেট এলাকায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জনসমাগমস্থলে ডাকাতি করত। গ্রেপ্তারকৃতদের আয়ের কোনো বৈধ উৎস না থাকলেও ঢাকা শহরে বিলাসী জীবনযাপন করে।

সূত্র জানায়, রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর, আব্দুল্লাহপুর, যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ড, মহাখালী, গুলিস্থানসহ বিভিন্ন টার্মিনালে এক শ্রেণির ডাকাতচক্র সক্রিয় থাকে। যাত্রীবেশে তারা গাড়িতে উঠে ড্রাইভার হেলপারসহ অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয়। আবার কখনো ডাকাতদলের সঙ্গে চালক হেলপারের সঙ্গেও সম্পর্ক থাকে। এর বাইরেও রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরে চেকপোস্ট বসিয়েও ডাকাতি করছে একটি চক্র। রাস্তায় চলাচলরত বিভিন্ন গাড়িকে সিগন্যাল দিয়ে আটকিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে লুটপাট চালায়। রাজধানীর বাইরেও বিভিন্ন মহাসড়কেও অতিসম্প্রতি ডাকাতচক্রের তৎপরতা আশংকাজনকহারে বেড়েছে।

এদিকে রাজধানীতে চুরি-ছিনতাই ও যাত্রীবাহী পরিবহনে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এর জের ধরে ঢাকার প্রতিটি থানায় টহল ও চেকপোস্ট বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাজারবাগের পুলিশ অডিটোরিয়ামে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ডিএমপির ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং আটটি অপরাধ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এই নির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম।

সভায় উপস্থিত বিভিন্ন পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে টহলের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। টহল নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন কমিশনার। কর্মকর্তারা বলেন, একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিদিন না থেকে, ঘুরে ঘুরে টহল দিতে হবে। চেকপোস্টগুলোতে সক্রিয় থেকে গাড়ি তল্লাশি করতে হবে।

সহকারী উপ-পরিদর্শকের (এএসআই) পরিবর্তে উপ-পরিদর্শকের (এসআই) নেতৃত্বে টহল পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সভায় উপস্থিত কর্মকর্তারা। ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, চুরি-ছিনতাই প্রতিরোধে ডিএমপির অপরাধ ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads