• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

উৎপাদনে উদ্বৃত্ত তবুও বিভ্রাট

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ২৫ এপ্রিল ২০২২

রমজান মাস শুরুর আগেই সারা দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার রেকর্ড সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। গত ২১ মার্চ শতভাগ বিদ্যুতায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক পায়রা তাপ বিদ্যুকেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন তিনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে পাঁচ গুণ।

আগামী ২০২৫ সালে ২৫ হাজার ১৯৯ আর ২০৩০ সালে ৩৩ হাজার ৭০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট, আর চাহিদা রয়েছে ১২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। চাহিদার হিসাবে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার মেগাওয়াট। এত বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত তার পরও দেশের শহর, গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে চলতি বোরো মৌসুমে শঙ্কায় ভুগছে কৃষকরা।

রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে অবশ্য বিভ্রাটের পরিমাণ কম। এর মূল কারণ বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনে সমস্যা। বিগত বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ট্রান্সফরমার এবং লাইনের সক্ষমতা সেই হারে বাড়ানো হয়নি। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা উদ্বৃত্ত হলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। গরম যত বাড়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাটও বৃদ্ধি পায়। তবে বিদ্যুতের এই ভোগান্তি লোডশেডিং বা উৎপাদন ঘাটতির জন্য নয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে কারিগরি ত্রুটির কারণে এই বিভ্রাট বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।

গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ১১টায় বিজয় নগরের শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকে গিয়ে দেখা গেল বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে ব্যাংকের সার্ভারও বন্ধের কথা জানান ব্যাংক কর্মকর্তারা। জেনারেটর চালিয়ে ব্যাংকের কার্যকম পরিচালনা করতে হচ্ছে। প্রায় ৩০ মিনিট বিদ্যুৎ না থাকার কারণে গ্রাহকরাও হয়রানির শিকার হন। এরপর দুপুর সাড়ে ১২ টাকা থেকে দিলকুশা এলাকায়ও বিদ্যুৎ নেই। ফলে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্টাস্ট্রিট কররোরেশন (বিসিআইসি) ভবনে গতকাল সারা দিন নেটওয়ার্ক ছিল না।  নেট না থাকায় বিভিন্ন অফিস ও বিভিন্ন পত্রিকার কাজও করতে পারেনি অনেকেই।

বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে, গ্রাহক বেড়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে সঞ্চালন সক্ষমতাও। তবে বিতরণ লাইনের সক্ষমতা যে হারে বাড়ানোর দরকার ছিল, সে হারে হয়নি। কারণ, ব্যাপক হারে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বিতরণ লাইনও টানা হয়েছে। ট্রান্সফরমারের ক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। এজন্য বহু স্থানে গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। পাচ্ছেন না মানসম্মত সেবাও। শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এখনো স্বাভাবিক হয়নি। শহরে বিদ্যুতে স্বস্তি থাকলেও পল্লী অঞ্চলে এখনো দুর্ভোগ  রয়েছে। বিশেষ করে আবহাওয়া একটু বিরূপ হলেই বিদ্যুৎ চলে যায়।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, উৎপাদনে ব্যাপক মনোযোগ থাকলেও মানসম্মত বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ থাকলেও তা গ্রাহকের ঘরে নিরবচ্ছিন্নভাবে পৌঁছানো যাচ্ছে না। দেরীতে হলেও এদিকে মনোযোগ দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কয়েক বছরের মধ্যে বিতরণ ব্যবস্থাও ভালো হয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিদিন গড় বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় ১২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট।  ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২  মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা  থেকে বর্তমানে (২০২০-২১)  ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৩৪০  মেগাওয়াটে।

চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। তারপরেও  রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় দিন-রাতে  এক-দুই বার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ বিভ্রাট সাধারণ মানুষকে অবাক করছে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে বেশি। এ কারণে চলতি বোরো মৌসুমে শঙ্কায় ভুগছে কৃষকরা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বসুন্ধরা, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, মাতুয়াইল, দনিয়া,  ডেমরা, খিলগাঁও, বাসাবো, রামপুরা, বনশ্রী, মুগদা, বনগ্রাম, ওয়ারীসহ পুরান ও নতুন ঢাকার অনেক এলাকা  থেকেই গত এক মাসে দিন-রাতে কয়েকবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এছাড়াও  দেশের বিভিন্ন  জেলা পর্যায়ের গ্রাহকদের অভিযোগ আরো  বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, সমপ্রতি সারা দেশে বোরো আবাদ শুরু হওয়ার কারণে কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটেছে। তবে গ্রাহকদের অভিযোগ, ঝড়-বৃষ্টি ছাড়া ভালো আবহাওয়াতেও বিদ্যুৎ যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

দনিয়া রোডের বাসিন্দা আসলাম হোসেন বলেন, গত পরশু রাত সাড়ে ১১টায় সাহারি খাওয়া শেষ করে ঘুমানোর আয়োজন করছি। এরমধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেল। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর বিদ্যুৎ এলো। তিনি জানান, সমপ্রতি ওই এলাকায় প্রতিদিন দুই  থেকে তিনবার বিদ্যুৎ চলে যায়। কখনো ১০-১৫ মিনিট পর চলে এলেও কখনো আবার আসতে  দেরী হয়।

পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা আয়নাল ফকির জানান, সব সময় বাসায় থাকা হয় না। তাই ২৪ ঘণ্টার হিসাব  নেই। তবে সকাল ও রাত মিলিয়ে যেটুকু সময় বাসায় থাকা হয়, মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে আগের মতো নয়।

কারওয়ান বাজার বাসিন্দা জয়নাল মিয়া বলেন, প্রতিদিন বিকেলে দুই থেকে তিনবার পর্যন্ত বিদ্যু চলে যায়। এ সময় কয়েকটি টিভি চ্যানেল, ১০ থেকে ১২ টি বিভিন্ন শ্রেণির দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল এর কাজে ব্যাঘাত ঘটে। বিদ্যুৎ চলে গেলে ইন্টারনেট লাইনও চলে যায়। সবমিলিয়ে পত্রিকা লাইনের কাজে বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করে।

বড়মগবাজার এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, প্রায় প্রতি দিনই বিদ্যুৎ যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। কখনো ১০ মিনিট, কখনো আধা ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ আসে। ঢাকার বাইরে  দেশের বিভিন্ন  জেলা  থেকেও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে,  বেশিরভাগ  জেলা-উপজেলায় প্রায় প্রতিদিনই এক-দুবার বিদ্যুৎ যায়।

এদিকে বর্তমানে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে দাবি করেছেন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন  কোম্পানির (ডিপিডিসি) পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী এটিএম হারুন অর রশীদ। তিনি জানান, রাজধানীর অধিকাংশ বিতরণ লাইন দীর্ঘদিনের পুরনো। এছাড়া লাইনের ওপর গাছপালা রয়েছে। ঝড় হলে বা অনেক সময় একটু  বেশি বাতাস হলেও ডালপালা এসে লাইনের ওপর পড়ে। তখন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটে বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, আগামী অর্থবছরে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা জোরদার করে গ্রাহকের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে ৩০ হাজার ৭৩৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তার মন্ত্রণালয়। তবে প্রত্যাশার চেয়ে কম বরাদ্দ পেয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, বর্তমানে ১৬ হাজার ৮৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৪৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। দুই হাজার ৭৮৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া ৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জানান। ভবিষ্যতে আরো ১৯ হাজার ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও বলেন তিনি।

বিদ্যুৎখাতের মেগাপ্রকল্পগুলোর তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল প্রজেক্ট, মাতারবাড়ি ১২শ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল প্রজেক্ট এবং পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। যৌথ বিনিয়োগে মহেশখালীতে ১০ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে বলে প্রতিমন্ত্রী জানান।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, দেশের মানুষের আয় বেড়েছে। বেড়েছে বিদ্যুতের গ্রাহক। উৎপাদনও বেড়েছে। আয় বাড়ার কারণে জনগণ দৈনন্দিন কাজে টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটরের পাশাপাশি অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যেমন এসি, রাইস কুকার, ওভেন ব্যবহার করছেন। এজন্য হঠাৎ করে বিদ্যুতের লোড চাহিদা বাড়ছে। সে অনুসারে বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। ফলে লাইন ও ট্রান্সফরমার ওভারলোড হয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads