• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯
ওজনযন্ত্রে ভূত, ফেরির সর্বনাশ!

ফাইল ছবি

জাতীয়

ধ্বংসের মুখে বিআইডব্লিউটিসি

ওজনযন্ত্রে ভূত, ফেরির সর্বনাশ!

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ০১ মে ২০২২

পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ঘাটের উভয় প্রান্তে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ডিজিটাল ওয়েব্রিজ  স্কেল (গাড়ির ওজন মাপার যন্ত্র) দুটি এখন নড়বড়ে। বেশিরভাগ সময়ই তা অচল থাকে। অনেকে বলেছেন, অচল করে রাখা হচ্ছে। সরকারকে ফাঁকি দিয়ে লাখ লাখ টাকা চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের পকেটে। বিশেষ করে আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে সিন্ডিকেটের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অতিরিক্ত পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করায় ফেরি, পন্টুন ও সড়কসহ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ওয়েব্রিজ  স্কেল দুটোর রাস্তায় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। ওয়েব্রিজের উভয়পাশের  রেলিংও ভেঙে গেছে। অবস্থা এখন লক্কর-ঝক্কর।

এসব কারণে আসন্ন ঈদে ফেরিতে ওভারলোডেড ট্রাক পারাপার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। একটি  রো  রো  ফেরি ২শ টন ওজন ক্ষমতা ধারণ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ৩শ  থেকে ৪শ টন পর্যন্ত বহন করা হচ্ছে। এসব অতিরিক্ত পণ্যবাহী ট্রাক পারাপারের কারণে  ফেরি র্যাম্প দুর্বল হওয়া, ইঞ্জিনে লোড পড়া, নৌ-চ্যানেল গভীরতা সংকট  দেখা  দেওয়া, ট্রিপের সময় বেশি লাগা, জ্বালানি  তেল  বেশি অপচয়সহ নানা অবকাঠামোগত সমস্যার শিকার হচ্ছে সব  শ্রেণির  ফেরি। ফলে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব, অন্যদিকে ধ্বংস হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ।

এদিকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, পণ্যবাহী ট্রাক মাওয়া-শিমুলিয়া নৌরুটের ফেরিতে চলাচল করাকে না করেছেন। বিশেষ করে পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া নৌপথে চলাচল করতে বলেছেন। প্রতিমন্ত্রীর এই খবরে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিতে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই সুযোগে ঘাটের উভয়প্রান্তে ওয়েব্রিজ স্কেল অবৈধ চাঁদাবাজদের দাপটও বেড়েছে।

এ সব বিষয়ের ওপর গত কয়েকদিন পাটুরিয়া ও  দৌলতদিয়া ঘাটের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া  গেছে। সরেজমিনে জানা গেছে,  ফেরিতে ওভারলোড ট্রাক পারাপার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে পাটুরিয়ায় একটি এবং দৌলতদিয়া ঘাটের ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে  গোয়ালন্দ পয়েন্টে আরেকটি ওয়েব্রিজ  স্কেল স্থাপন করা হয়। ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন সাবেক  নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান।

নিয়ম হলো-ছোট-বড়  যেকোনো পণ্যবাহী যানবাহন ওয়েব্রিজ দিয়ে  যেতে হবে এবং ওয়েব্রিজ  স্কেল কাউন্টার  থেকে ওই যানবাহনের ওজনের একটা স্লিপ দিবে। এই স্লিপ  ফেরিতে  দেখালে সংশ্লিষ্ট  ফেরির মাস্টার স্লিপে  লেখা ওজন অনুযায়ী টিকিট  দেবেন। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা  গেছে, ভিন্ন চিত্র। স্লিপ ছাড়াই  বেশিরভাগ যানবাহন পারাপার হচ্ছে। ১০ টনের একটি পণ্যবাহী ট্রাকের ভাড়া ১ হাজার টাকা। কিন্তু  সেখানে ৩০ টনের ওজনের ট্রাককে  ছোট সাইজের দেখানো হয়। ৩০  থেকে ৪০ টনের কন্টেইনারের ভাড়া ৪  থেকে ৫ হাজার টাকা। ওয়েব্রিজের সঠিক স্লিপ না থাকায় তাকে ১০ টন ওজনের ট্রাক  দেখিয়ে মনগড়া টিকিট দেওয়া হয়।

এদিকে জানা  গেছে, উদ্বোধনের পর কিছু দিন ভালো চললেও মাত্র মাস খানেকের মাথায়  গোয়ালন্দ পয়েন্টের ওয়েব্রিজ অচল হয়ে যায়। আর এই অজুহাতে পাটুরিয়া ও  দৌলতদিয়া  ফেরি  সেক্টরে তাদের সৃষ্ট আনবুকড গাড়ি পারাপার, কন্টেইনার মুভারসহ বড় গাড়ির সাইজ হ্রাস করে  ফেরি পারাপারের টিকিট প্রদান করা শুরু করে। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অতিরিক্ত  লোড করে  ফেরি পারাপার অব্যাহত  রেখে চলেছেন ঘাট সংশ্লিষ্টরা। অতিরিক্ত  লোড করে  ফেরি চলাচলের কারণে ঘন ঘন  ফেরি অচল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি অচল  ফেরি  মেরামতের নামে  কোটি  কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হচ্ছে।

এছাড়া পাটুরিয়া ঘাট বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা  গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৮  কোটি ৯৫ লাখ ২১ হাজার ১৮ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৯ কোটি ৫২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৬ কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ কোটি ৪৩ লাখ ২৬ হাজার, ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে ১০ কোটি ৮০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এভাবে  ফেরি  সেক্টর  থেকে  কোটি  কোটি টাকা  লোপাট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থ বছরের আয় ব্যয়ের হিসাব দেখতে চাইলে পাটুরিয়া ঘাটের সংশ্লিষ্ট দেখাতে ব্যর্থ হন।

জানা গেছে, ওয়েব্রিজ  স্কেল দুটো চালুর আগে ২০১৪ সালের ৩ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় একটি ও মাদারীপুরে চরজানাজায় একটিসহ দুটি ওয়েব্রিজ  স্কেল বসানো হয়। যার ব্যয়  দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে জানা গেছে, এ দুটো  স্কেলের অবস্থাও একই। এতোসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ৩  কোটি ৯৬ হাজার টাকা ব্যয়ে আরো দুটি ওয়েব্রিজ  স্কেল তৈরি করা হয়। এ দুটি  স্কেল চাঁদপুর ও শরীয়তপুরে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বসানো হয়েছে বলে বিআইডব্লিউটিসির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানান।

বিআইডব্লিটিসির সাবেক জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত সরদার জানান, আমরা জানি স্থাপন করা ওয়েব্রিজগুলো সচল আছে এবং সুষ্ঠু সুন্দরভাবে চলছে। পাটুরিয়া ঘাটের মাঝ পদ্মায় ভাষা শহীদ বরকত  ফেরিতে কথা হয়  ফেরির মাস্টার আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ওয়েব্রিজ স্কেল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের ম্যানেজমেন্টের  কোনো সমস্যা নেই। ওভারলোড হয়ে  ফেরি চলতে পারবে না। আর চললেও  ফেরির স্থায়িত্ব থাকবে না। তিনি বলেন, আগে নিয়ম ছিল রাত ১০টার পর শুধু যাত্রীবাহী পরিবহন পারাপার হবে। এখন শুধু পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করায়। তখন ফেরির ধারণক্ষমতা ঠিক থাকে না।

রো  রো  ফেরি খান জাহান আলীর মাস্টার শামছুল হক বলেন, ঘাট নিয়ন্ত্রণকারীরা  ফেরিতে  যে যানবাহন প্রবেশ করাবে, আমরা তা পারাপার করতে বাধ্য। ওয়েব্রিজ  স্কেল ঠিকঠাক মতো কাজ করে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুনেছি  বেশিরভাগ সময় অচল থাকে। আসলে  কোনটা সত্য তা একমাত্র বলতে পারবেন ওয়েব্রিজ  স্কেলের ম্যানেজার।

পাটুরিয়া ঘাটের ওয়েব্রিজ  স্কেলের ইনচার্জ  তৌহিদুল ইসলাম এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সব ওয়েব্রিজ সচল আছে।’ তার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে শ্যামলী পরিবহনের চালক  মো. আবুল বাশার বলেন, অনিয়মটা হয় ওয়েব্রিজ  স্কেল থেকে। ৩০ টনের  কোনো পণ্যবাহী ট্রাককে ১০ টন ওজনের স্লিপ  দেওয়া হয়। আবার ৫০ টনের কন্টেইনারকে ২০ টনের কন্টেইনার দেখানো হয়। এসব কারণে আমাদের উভয় পারে অনেক সময় যানজটে আটকে পড়ে থাকতে হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads