• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
চাহিদা ও জোগানে টানাপোড়েন!

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল ও ডলার সংকট

চাহিদা ও জোগানে টানাপোড়েন!

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০১ জুন ২০২২

করোনা মহামারির পরে বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতি চরম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলে। চরম আকার ধারণ করেছে ডলার সংকট। হুমকির মুখে পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আমদানির ব্যাপক চাহিদার বিপরীতে ডলার সরবরাহ করতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার অগ্রিম টাকা দিয়েও চাল পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট হয়েছে জ্বালানি তেলের সংকট। এজন্য পার্শ্ববর্তী দেশের কাছে পরামর্শ নিতে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এভাবে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদার বিপরীতে জোগান নিশ্চিতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে। এদিকে নিত্যপণ্যের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে শ্রমিক ও দিনমজুররা।

ডলারের উল্লম্ফনে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। বাধ্য হয়ে ব্যাংক রেটের চেয়ে সাত-আট টাকা বেশি দিয়ে ডলার সংগ্রহ করতে হচ্ছে। সব হিসাব-নিকাশ ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। ডলার বাজারের এই অস্থিরতা অর্থনীতিতেও ছড়িয়ে পড়ছে।

ইউক্রেন-রাশিয়া চলমান যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে আমদানি ব্যয়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বাড়ছে। ডলার মার্কেট স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত ৫.১১ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়েছে। এছাড়া গাড়িসহ বিলাস পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণে এলসি মার্জিন বাড়ানো হয়েছে। সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এখনই বাস্তবায়ন জরুরি নয়, এমন সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

বৈদেশিক মুদ্রার নিরাপদ রিজার্ভ ধরে রাখতে কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ ও বিলাসপণ্যের আমদানি সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকার যে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেবে, তা গত ১৭ এপ্রিল অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় স্পষ্ট করেন অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে ধরে রাখতে সরকার আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে সিরিজ অব মেজার্স নেবে জানিয়ে অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার ওইদিন বলেন, এ বিষয়ে ধারাবাহিক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছি। ইতোমধ্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ছোট ছোট আকারে কিছু পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে এবং এটি আস্তে আস্তে বাড়বে। আমাদের ম্যাক্রো ইকোনমি স্ট্যাবিলিটি নষ্ট হবে, এমন কোনো বিষয়ে আমরা কখনো কমেপ্রামাইজ করবো না।

এদিকে সংকট এড়াতে গত রোববার ডলারের দাম বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এখন থেকে প্রতি মার্কিন ডলার ৮৯ টাকায় বিক্রি হবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যংকের এই সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হতে পারেও বলে মনে করছেন অনেকে।

বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশ (এবিবি) প্রস্তাব অনুসারে এ রেট নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। এর আগে, ডলারের সংকট কাটাতে গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকের এবিবি ও বাফেদা সঙ্গে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সভায় অংশ নেওয়া একাধিক ব্যাংকার জানিয়েছেন, সংকট কাটাতে সভা ডাকা হয়েছিল। সভার সিদ্ধান্তে সংকট আরো বাড়বে। কারণ, এত কম দামে প্রবাসী আয় বৈধপথে দেশে আসবে না। ডলারের দাম কম হওয়ায় রপ্তানি আয়ও বাধাগ্রস্ত হবে। বাস্তবতাকে স্বীকার না করে এখনো ৯০ টাকার নিচে ডলারের দাম বেঁধে রাখতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও বাস্তবে ৯৫ টাকার ওপরে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে।

তবে আমদানিতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণেই যে ডরার সংকট সৃষ্টি হয়েছে এমনটা মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা; বরং ব্যাপকহারে  হুন্ডি ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের কারণেও ডলার সংকটের জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা।

একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক মইনুল ইসলাম বলেছেন, সাদাচোখে মনে হবে, শুধু পণ্য আমদানিতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলার সংকট তৈরি হয়েছে। আদতে তা নয়। এটা ঠিক, করোনা সংকট কাটিয়ে উঠার পর বিশ্বজুড়ে পণ্যের দাম বাড়তি ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর জ্বালানি তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), ভোজ্যতেল, গমসহ অনেক পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এতে পণ্য আমদানির খরচ বেড়ে গেছে। তবে ডলার সংকটের জন্য আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিকে এককভাবে দায়ী করা ঠিক হবে না। এখানে দুটি বিষয় কেউ বিবেচনা করে না। করোনার সময় হুন্ডি ব্যবসা বলতে গেলে একপ্রকার বন্ধ ছিল। করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার পর এখন আবার হুন্ডি ব্যবসা ব্যাপকভাবে চাঙা হয়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পুঁজি পাচার বেড়েছে। আবার বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নিয়ে ওভার ইনভয়েসিংয়ের (পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে অর্থপাচার) মাধ্যমেও পুঁজিপাচার বেড়েছে। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি ডলার সংকটের নেপথ্যে এই দুটিও বড় কারণ।

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় মেটাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আসছে বাজেটে জ্বালানি তেলের ভর্তুকির জন্য সরকারকে অনেক টাকা গুণতে হবে। অন্যথায় তেলের দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু তেলের দাম বাড়লে দ্রব্যমূল্য আরো বাড়বে।

এমন অবস্থায় রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও গম কিনতে ভারতের কাছে বাংলাদেশ পরামর্শ চেয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে এসব কিনছে। তাই আমরা তাদের কাছে পরামর্শ চাই। 

সম্প্রতি ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, রাশিয়া আমাদের কাছে তেল বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা আমাদের কাছে গমও বিক্রি করতে চায়। কিন্তু আমরা তো ওই নিষেধাজ্ঞার ভয়ে (রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা) ভারতের কাছে জানতে চেয়েছি তোমরা কীভাবে করেছ। তোমরা তো নিচ্ছে। সেটা তারা বলেছে। জ্বালানির ক্ষেত্রে যে সমস্যা, সেটা তো আমাদের জন্য সত্যিকারের একটি সমস্যা। এ নিয়ে আমরা ভয়ে আছি। তাই আমরা তাদের কাছে বুদ্ধি চাই। বিশেষ করে তারা সেটা (রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও গম কেনা) কীভাবে করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, এ নিয়ে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। তারা কীভাবে পরিস্থিতি (রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও গম কেনা) সামাল দিয়েছে। তারা বড় দেশ, তারা ম্যানেজ করতে পারে। তারা কোনো পদক্ষেপ নিলে কেউ তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় না। আমরা তো দরিদ্র, ছোটখাটো দেশ, আমাদের ওপর মাতব্বরি একটু বেশি।

যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য-শস্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষও এখন দিশেহারা। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশে তার চাহিদার ৮০ শতাংশ গম আমদানি করে। এর অর্ধেক আসে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে। কিন্তু সে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবার কারণে গমের দাম বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশ আটা-ময়দার দামও বেড়েছে। এই যুদ্ধের ফলে সার, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রেও সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এসব পণ্যেও চাহিদার বিপরীতে জোগান নিশ্চিত করতে ব্যস্ত সময় পার করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে সার আমদানি করে। সেটি ব্যাহত হলে ভিন্ন কোনো উৎস দেখতে হবে। এতে করে খরচ বাড়বে কৃষি খাতে। বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের দামও এখন লাগামছাড়া। একদিকে করোনাভাইরাস মহামারি-পরবর্তী শ্রমিক সংকটে কারণে বিশ্বে ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। পরবর্তীতে ইউক্রেন যুদ্ধ সে দাম আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে দেশের অসাধু ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বাণিজ্য।

এসব সংকটের মধ্যে বর্তমানে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ধান-চালের সংকট। ভরা মৌসুমেও হু হু করে বাড়ছে ধানের দাম। সেই সাথে বাড়ছে চালের দামও। অভিযোগ উঠেছে, ভোজ্যতেলের মতো চালের বাজারও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্টদের অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। তার নির্দেশের পর গতকাল মঙ্গলবার বিকেল থেকেই মাঠে নামে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আটটি টিম। কিন্তু টিম মাঠে নামার সংবাদে দোকান ছেড়ে পালায় ব্যবসায়ীরা।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফাহমিনা আক্তার এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের বাজারে আসার খবরে অনেক চাল ব্যবসায়ী দোকান থেকে পালিয়ে যান। পরে তাদের অনেক অনুরোধ করা হলেও তারা দোকানে ফিরে আসেননি। তিনি বলেন, দোকানিরা অভিযোগ বলছেন, তারা টাকা দিয়েও চাল পাচ্ছেন না। মিল মালিকরা তাদের বলছেন, ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে চালে। তাছাড়া অনেক ব্যবসায়ী অগ্রিম টাকা দিয়েও চাল পাচ্ছেন না। 

সার্বিক দিক বিবেচনায় মূল্যস্ফীতির চাপে এখন দিশেহারা সাধারণ মানুষ। সাধারণত মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির কিছুটা বেশি থাকে। অর্থনীতির সেই চিরায়ত প্রবণতায় উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে এখন। অর্থনীতিবিদদের মতে, মজুরি বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হলে মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। এখন বাংলাদেশে তাই হয়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যও তাই বলছে। সাধারণত মূল্যস্ফীতি ও মজুরি হার বৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য ১ শতাংশের মতো হয়। সরকারি হিসাবেই কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এখন তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে উঠেছে। যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু মজুরি সেই হারে বাড়ছে না।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads