• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ট্রাম্পের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা ও সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া

  • জি. কে. সাদিক
  • প্রকাশিত ০৪ জানুয়ারি ২০১৯

আকস্মিকভাবে গত ১৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইট বার্তার মাধ্যমে সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণার একদিন পরেই তিনি গত ১৯ ডিসেম্বর আফগানিস্তান থেকেও ৭ হাজার সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক আবহাওয়ার জন্য এটাকে ইতিবাচক খবর বলা যায়। তবে গোলপাক বেশকিছু জাগায়। কবে নাগাদ সেনা প্রত্যাহার হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। গোলকধাঁধার আরো কারণ, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা এর আগে ২০১২ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পুরোটা কার্যকর করেননি। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সেটা নির্বাচনের ফল নিজের অনুকূলে আনার একটা কৌশল ছিল মাত্র। তবে এ ঘোষণা ক্রিয়দাংশ বাস্তবায়ন করে ওবামা প্রশাসন আফগানিস্তানে সেনা সদস্য কমিয়ে ১৩ হাজারে নামিয়ে আনেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও স্বীয় নির্বাচনী প্রচারণায় আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের কথা বলেছিলেন। তবে ক্ষমতায় এসে তিনি বেঁকে বসেন। যুক্তি হচ্ছে, ইরাকযুদ্ধ শেষে সেনা ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার দরুন সেখানে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর জন্ম ও বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তেমনি আফগানিস্তান থেকেও যদি সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তখন আফগানিস্তানের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আরো শক্তিশালী হবে। তাই সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা নিয়ে একটা গোলকধাঁধার সৃষ্টি হয়েছে।

২.

সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার প্রেক্ষিতে বেশকিছু বিষয় সামনে আসে। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। সিরিয়ার মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে, তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত তেল আবিব অঞ্চলে ২১টি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। যুক্তরাষ্ট্র সে থেকেই বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করে। এবং মিত্র সৌদি আরবের পক্ষ হয়ে সহযোগী হিসেবে বেশকিছু বিদ্রোহী গ্রুপ— ওয়াইপিজে ও সৌদি সমর্থিত আর্মি অব ইসলামকে পুষছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে আইএস দমনের জন্য আমেরিকা সামরিক জোট গঠন করে। আর স্থানীয় সহযোগী হিসেবে কিছু সন্ত্রাসী সংগঠনকেও সঙ্গে নেয়। ওয়াইপিজে এদের মধ্যে অন্যতম। এখন যদি আমেরিকা সেনা প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে কি সামরিক ঘাঁটিগুলো সরিয়ে নেবে বা বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে প্রদত্ত সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেবে? এই গ্রুপগুলোর কার্যক্রম কি শেষ হয়ে যাবে? যুক্তরাষ্ট্র মূলত চেয়েছিল আসাদ সরকারের পতন এবং সিরিয়ায় স্বীয় অনুগত একটি গণতান্ত্রিক সরকার। কিন্তু আমেরিকা তা করতে পারেনি। ফলত এখানে আমেরিকা ব্যর্থ। তাই আমেরিকা কি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে বিদায় হবে? মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে ইরান ও তুরস্ক। রাশিয়া ও ইরানের সর্বাত্মক চেষ্টার ফলে আসাদ টিকেছেন। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি রাশিয়া ও জাতশত্রু ইরানের কাছে হার মানল? ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বেশি একটা নেই। বিশেষ করে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে শিয়া ধর্মগুরু মুকতাদা আল-সদরের নেতৃত্বাধীন সায়রুন ও ইরাকি কমিউনিস্ট পার্টি জয়লাভের পর। এমতাবস্থায় সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার মানে হচ্ছে ইরান-তুরস্ক-রাশিয়ার হাতে মধ্যপ্রাচ্যের সাম্রাজ্য ছেড়ে ঘরে ফেরা। সেক্ষেত্রে মার্কিন প্রশাসন কি সহজেই মস্তবড় হার মেনে নেবে? ২০১৪ সালে সিরিয়ায় আইএস দমনের জন্য আমেরিকা পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে জোট গঠন করে। এখন ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে বলছেন, আইএস দমন হয়েছে। কিন্তু মিত্ররাষ্ট্রগুলো ট্রাম্পের এ বক্তব্য মানছে না। আমেরিকা সেনা প্রত্যাহার করলেও ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়া সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে না বলে জানিয়েছে। সিরিয়ায় আইএস দমন হয়েছে তবে এখনো পুরো শঙ্কামুক্ত হওয়া যায়নি— এটা তাদের অবস্থানের কারণ। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তে দেশগুলো বিস্মিত হয়েছে বলেও জানিয়েছে। এ অবস্থায় সিরিয়া থেকে আমেরিকা সেনা প্রত্যাহার করে নিলে মিত্রদেশগুলোর অবস্থান কী হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। বেঁকে বসা মিত্রশক্তিকে একপাশে ঠেলে ট্রাম্প স্বীয় অবস্থানে কতটা দৃঢ় থাকবেন তা নিয়েও সংশয় দেখা দিচ্ছে। তা ছাড়া খোদ সিনেটেই ট্রাম্প বাধার সম্মুখীন হবেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিসের পদত্যাগের প্রধান কারণ সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে ট্রাম্পের খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত। তাই পরিস্থিতি বিচারে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা যথেষ্ট ঘোলাটে একটি বিষয়।

৩.

আমেরিকা সিরিয়ায় আইএস দমনের জন্য ওয়াইপিজেসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ তৈরি করেছিল। সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও সে গ্রুপগুলোকে দেওয়া অস্ত্র ও সাহায্যের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। ভবিষ্যতে এ গ্রুপগুলোর ভাগ্যে কী আছে বিষয়টি ঘোলাটে। তাছাড়া সিরিয়ায় অসংখ্য বিদ্রোহী গ্রুপ আছে, যার সবক’টিই আমেরিকান সমর্থনপুষ্ট নয়। কিছু আছে মার্কিনবিরোধী; কিন্তু তারাও আসাদ সরকারের পতন চায়। গ্রুপগুলো এখনো হাল ছাড়েনি। তাহলে সিরিয়ায় সন্ত্রাস দমন বলে যে কথা বিশেষ প্রচার পেয়েছিল, তা সফল হয়নি। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা বড় ধরনের গোলকধাঁধার জন্ম দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের সঙ্গে উপর্যুক্ত দ্বান্দ্বিক কারণগুলো বাদেও আরো কিছু বিষয় জড়িয়ে আছে। যেমন— মিত্র সৌদি আরব ও ইসরাইলের স্বার্থ এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির ভবিষ্যৎ। সিরিয়া থেকে চলে আসার বিষয়টি— কীভাবে সেনা প্রত্যাহার করে ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে পরবর্তী ধাপ ইত্যাকার বিষয়— আমেরিকা এখনো কিছুই স্পষ্ট করেনি। তাই চলে আসার ঘোষণা ঘিরে বিশ্লেষকদের মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহ ও নতুন চালের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সরব ও শক্ত অবস্থান মিত্র ইসরাইল ও সৌদি আরবের একান্ত প্রয়োজন। বিশেষত আমেরিকার স্বার্থরক্ষার জন্য এটা গুরুত্ব রাখে।

উপরন্তু ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে গোলান দখলের পর থেকে গোলানে ইসরাইল স্বীয় দখলদারিত্ব স্থায়ী করতে আমেরিকার স্বীকৃতির চেষ্টা চালাচ্ছে। গত ৬ ডিসেম্বর (২০১৭) আমেরিকার দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের ঘোষণার পর থেকে ইসরাইল আমেরিকার কাছে গোলানের স্বীকৃতি নিয়ে বেশ আশাবাদী। এ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের ওপর চাপও দিচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি আমেরিকা সিরিয়া থেকে সরে যায়, তাহলে গোলান প্রশ্নে ইসরাইলের মার খাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এ বিষয়টিও সামনে আসে।

রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কেনা, মানবাধিকার প্রশ্নে এবং তুরস্কে সৌদি দূতাবাসে সাংবাদিক জামাল আহামেদ খাশোগি হত্যাকাণ্ড ঘিরে সৌদি প্রশাসনের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্কের খানিক টানাপড়েন চলছে। এ অবস্থায় সৌদি প্রশাসন নতুন মিত্রের সন্ধানে নেমেছে। টার্গেট হিসেবে আছে লোহিত সাগরের উপকূলীয় অঞ্চল ও ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলের দেশগুলো। গত ১২ ডিসেম্বর রিয়াদে ওই অঞ্চলের মিসর, জিবুতি, সোমালিয়া, সুদান, ইয়েমেন ও জর্ডানের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়। যদিও বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, তবু বিশ্লেষকরা এটাকে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন চলাকালীন একটি বিশেষ কৌশল হিসেবে দেখছেন। বিশেষত ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ ও লোহিত সাগরের গুরুত্ব রয়েছে বিশ্ববাণিজ্য তথা তেলবাণিজ্যের ক্ষেত্রে। এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগর যুক্তকারী বাব আল-মানদেব প্রণালী দিয়ে দৈনিক ৩২ লাখ ব্যারেল তেল ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যায়। সম্প্রতি ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের নজর রয়েছে বাব আল-মানদেব প্রণালীর ওপর। তাই মধ্যপ্রাচ্যে স্বীয় স্বার্থ রক্ষার্থে ও সৌদি প্রশাসনের মন জোগাতে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অবস্থান সবসময় দরকার।

অন্যদিকে আমেরিকার সাহায্য ছাড়া আফগানিস্তানে বর্তমান প্রশাসন তালেবানের সামনে এক মাসও টিকে থাকতে পারবে না। পেন্টাগন প্রদত্ত তথ্যমতে, বর্তমানে দেশটির মাত্র ৫২ শতাংশ অঞ্চল আফগান প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা ২০১৫ সালে ছিল ৭২ শতাংশ। বিবিসির তথ্যমতে, আফগানিস্তানের ৪৪ শতাংশ তালেবানের নিয়ন্ত্রণে আছে। এমতাবস্থায় আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের মানে হচ্ছে তালেবানের নিশ্চিত জয়। ট্রাম্পের একার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে মার্কিন প্রশাসন কি এমন গো-হারা মেনে নেবে? কারণ আফগানিস্তান থেকে বিদায়ের মানে হচ্ছে চীনের হাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তুলে দেওয়া। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশের (উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কমিনিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান) ওপর অনেকটা স্থায়ী প্রভাবহানি ঘটবে। ইতোমধ্যে রাশিয়া ও ইরান কাস্পিয়ান সাগরকে ঘিরে এই দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

৪.

ট্রাম্পের সামনে এখন বহু বাধা। নিজ প্রশাসনের বিরোধাবস্থান, মিত্রশক্তির প্রতিকূলতা, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও কথিত সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দেওয়ার জোরালো সম্ভাবনায় ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা অনেকটা কঠিন হবে। তাই এ বিষয়ে বিশ্লেষকগণ চূড়ান্ত পরিণতির আভাস পাচ্ছেন না। বিশেষ করে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার কারণে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা নিয়ে আরো বেশি সন্দেহের সৃষ্টি করছে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads