• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

সরকারি কর্মচারীদের প্রদত্ত সুবিধা ও প্রত্যাশা

  • নজরুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ০৮ জানুয়ারি ২০১৯

বিগত বছরের ৩০ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় ‘সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে গৃহনির্মাণ ঋণ প্রদান নীতিমালা, ২০১৮’ জারি করে। এ নীতিমালা ১ জুলাই ২০১৮ থেকে কার্যকর হয়। এ নীতিমালার আলোকে সরকারি কর্মচারীরা বেতন গ্রেড ও কর্মস্থল ভেদে ২০ লাখ থেকে শুরু করে ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা পাবেন। নীতিমালায় বলা আছে, সুদের হার সর্বোচ্চ ১০%, এটি হবে সরল সুদ এবং সুদের উপর কোন সুদ আদায় করা হবে না। ঋণগ্রহীতা কর্মচারী ব্যাংক রেটের সমহারে ৫% সুদ পরিশোধ করবে এবং সুদের অবশিষ্ট অর্থ সরকার ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে।  

এর আগে গত ২০ আগস্ট ২০১৮ মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’-এর অনুমোদন দেওয়া হয়। এই আইনের ৪১ ধারার উপধারা (১)-এ বলা আছে, “কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেপ্তার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে।”

এটা সত্য যে, সরকারি কর্মচারীরা সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের অপরিহার্য প্রতিনিধিত্বকারী। সময়ের আবর্তে আমাদের দেশে সরকারি কর্মচারীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেই বিবেচনায় তাদের কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতেও একটা মাত্রা ও ভারসাম্য থাকা উচিত। প্রজাতন্ত্রে একটি বিশেষ শ্রেণিকে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা সমাজে বসবাসকারী অন্য শ্রেণিদের সঙ্গে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি করে। এটি রাষ্ট্রের অন্য পেশাজীবীদের মধ্যে হতাশা এবং ‘ইনফিরিঅরিটি কমপ্লেক্স’ সৃষ্টি করতে পারে।

বিগত বছরগুলোতে সরকারি কর্মচারীদের জন্য সরকার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছে। ২০১৫ সালে সরকারি কর্মচারীদের নতুন পে-স্কেল দেওয়া হয়েছে, যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ। এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের কল্যাণে শিক্ষা অনুদান ও চিকিৎসা অনুদান রয়েছে। বর্তমানে আমাদের যে সকল শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যতের দিকে চোখ রাখছে, তাদের মধ্যে অনেকেই এমন একটি কর্মজীবন বেছে নিতে চাইবে যেখানে থাকবে পেশাগত ক্ষমতা ভোগ করার অবাধ সুযোগ এবং একই সঙ্গে নানামুখী অর্থনৈতিক সুবিধা। কিন্তু প্রজাতন্ত্রে যদি শুধু সরকারি কর্মচারীরাই পেশাগত ক্ষমতা আর নানামুখী অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করেন, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম শুধু সরকারি কর্মচারীই হতে চাইবে— অন্য কিছু নয়!

বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক পড়াশোনার তুলনায় বিসিএস প্রস্তুতির পড়া বেশি পড়ে। যারা বিসিএস ক্যাডার হতে পারে না, তারা যে কোনো ভাবেই হোক একটা সরকারি চাকরি চায়। আমরা যদি আমাদের চারপাশে তাকাই, তাহলে দেখবো বর্তমানে যারা স্কুল-কলেজে পড়ে তারা কেউ উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন দেখে না। তারা সবাই ভবিষ্যতে চাকরিজীবী হবার স্বপ্ন দেখে। অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য চাকরি চান। আর সেটা যে সরকারি চাকরি, তা বলাই বাহুল্য।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে বিজ্ঞানে আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ইউজিসি-র ২০০৬ সালের হিসাব অনুযায়ী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল ১৭ শতাংশ। কিন্তু ২০১৬ সালে তা কমে হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ! অনেক শিক্ষার্থী মনে করে, বিজ্ঞান-শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা চাকরির সুযোগ সীমিত। তাহলে আর বাড়তি পরিশ্রম, অর্থ, সময় ব্যয় করে বিজ্ঞান পড়া কেন? অর্থাৎ, এখানেও শিক্ষার উদ্দেশ্য অভিন্ন— চাকরি করা!

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ এবং পর্যায়ক্রমে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনের পথে আমাদের নীতিনির্ধারণী, গবেষণা, উৎপাদন ও সৃষ্টিশীল পর্যায়ে মেধাবী ও দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। যারা রাষ্ট্রের উন্নয়নে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ও গবেষণা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, অর্থনীতি ও ব্যবসা, সামাজিক উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের মেধাকে কাজে লাগাতে সক্ষম।

বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করে সরকারি চাকরি আকর্ষণীয় করা হয়েছে। সব সরকারের সময়েই সরকারি কর্মচারীদের অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করা হয়, কিন্তু তাতে পুরনো সুবিধা কমার নজির খুব একটা নেই। ফলাফলস্বরূপ, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে এসে সেই ধারাবাহিক সুবিধাগুলোর কারণে এখন রাষ্ট্রের অন্য সকল শ্রেণি এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে একটা ব্যাপক বৈষম্য চোখে পড়ে। 

আর এই বাস্তব চিত্র আমাদের মেধাবী তরুণদের মনে স্বপ্ন তৈরি করেছে সরকারি চাকুরে হবার। উৎপাদন বা সৃষ্টিশীল পেশার প্রতি অনীহা। এর ফলে ভবিষ্যতে কোনো নীতিনির্ধারক বা উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে না। একটি দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্যে এটি ক্ষতিকারক। রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই আমাদের এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নতুন বছরে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

 

লেখক : শিক্ষক, দ্য কার্টার একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চাঁদপুর

হধুৎঁষ.ৎঁংংবষষ—মসধরষ.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads