• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

ফাতেহায়ে দোয়াজদাহুম

মিলাদুন্নবী (সা.) ও সিরাতুন্নবী (সা.)

  • প্রকাশিত ০৬ নভেম্বর ২০২০

মুফতি শাঈখ মুহাম্মদ উছমান গনী

 

 

বিশ্বের বিস্ময়, নবী ও রাসুলগণের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ, বিশ্বনবী হজরত আহমাদ মুজতবা মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যাঁর গুণকীর্তনে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান এমনকি নাস্তিকরা পর্যন্ত পঞ্চমুখ। কাফির-মুশরিক ও জানের দুশমনরাও যাঁকে ‘আল-আমীন’ তথা মহাসত্যবাদী বা পরম বিশ্বাসী আখ্যায় আখ্যায়িত করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। যাঁর আবির্ভাবে কিসরা ও কাইসারের গগনচুম্বী রাজপ্রাসাদ ভূমিতে লুটে পড়ে। পারস্যের অনির্বাণ অগ্নিকুণ্ড চির নির্বাপিত হয়। দেবালয়ের প্রস্তরমূর্তি মর্তে কপাল ঠুকে। তাঁর সে শুভাগমনকে বিশ্ববিবেক ক্ষণিকের তরেও ভুলতে পারে না। বর্ষের তিন শত পঁয়ষট্টি দিবসই যদি তাঁর পবিত্র মহা মিলাদ বা জন্মস্মরণ করা হয় তথাপিও রোজ কিয়ামত পর্যন্ত এর প্রয়োজন ও গুরুত্ব বিন্দুমাত্র হ্রাস পাবে না। তাই তো সারা দুনিয়া প্রতি মুহূর্তে গাইছে : ‘সল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা।’ বালাগাল উলাবি কামালিহি, কাশাফাদ দুযাবি জামালিহি; হাছুনাত জামিউ খিছালিহি, সল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি। ‘সবার উপরে আসন যাঁর, তাঁর রূপের ঝলকে কেটেছে আঁধার। সবকিছুই সুন্দর তাঁর। দুরূদ তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে।’

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব দিবসটি আমাদের সমাজে ফাতেহায়ে দোয়াজদাহুম নামে পরিচিত। ‘ফাতেহায়ে দোয়াজদাহুম’ কথাটি ফারসি ভাষা থেকে আগত। দোয়াজদাহুম মানে বারো। ফাতেহায়ে দোয়াজদাহুম অর্থ হলো বারো তারিখের ফাতিহা অনুষ্ঠান। এ দিবসটি কালক্রমে মিলাদুন্নবী (সা.) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এর অর্থ হলো নবী (সা.)-এর জন্ম অনুষ্ঠান। ধীরে ধীরে এর সাথে ‘ঈদ’ শব্দ যোগ হয়ে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)’ রূপ লাভ করে। যার অর্থ হলো মহানবী (সা.)-এর জন্মোৎসব। এ দিবসে অনেকে জশনে জুলুছ বা শোভাযাত্রা ও আনন্দ র্যালিও বের করে থাকেন। এ পর্যায়ে আরেকটি পরিভাষাও প্রচলিত হতে থাকে ‘সিরাতুন্নবী (সা.)’। অর্থাৎ নবী (সা.)-এর জীবনচরিত বা জীবনী আলোচনা অনুষ্ঠান। এ মহামানবের জন্মতারিখ নিয়ে সিরাতগ্রন্থ, জীবনীকার, ইতিহাসবেত্তা ও জ্যোতির্বিদগণের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। তবে প্রায় সবাই এ বিষয়ে একমত যে, তাঁর জন্ম হয়েছিল রবিউল আওয়াল মাসের শুক্লপক্ষে সোমবার প্রত্যুষে বা ভোর বেলায় তথা ঊষালগ্নে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের মতে, সেদিন ছিল ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল। জ্যোতির্বিদদের হিসাব মতে এ দিন ১, ২ বা ৮, ৯ অথবা ১০, ১১ রবিউল আউয়াল হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। আর তিনি ইহধাম থেকে চিরবিদায় নেন রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ দ্বিতীয় সোমবার অপরাহ্নে বা গোধূলিলগ্নে। অনেকের মতে, নবীজি (সা.) ১৭ রবিউল আউয়াল শুক্রবার বসন্তের সুরভি ও অমিয় বারতা নিয়ে ধরাধামে শুভাগমন করেন এবং কৃষ্ণপক্ষের শেষ সোমবার ২৮ ছফর পৃথিবীকে শূন্য করে চিরবিদায় নেন। তবু তাঁর বেলাদাত ও ওফাত ১২ রবিউল আউয়াল প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তদুপরি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ও প্রস্থান একই দিনে একই সময়ে এ কথাও সর্বজনবিদিত। তাহলে এ দিনে জন্মোৎসব পালন করা হবে নাকি প্রস্থানের শোক পালন করা হবে? কথায় আছে—‘সৃষ্টির জন্য যাঁদের সৃষ্টি, তাঁরা চির অমর’। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজ দুনিয়ার বুকে নেই। সেটিই ভাববার বিষয়। উৎসব বা শোক পালন বড় কথা নয়। আসল কথা হলো-তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। কোরআন ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা। একমাত্র ইসলামকেই ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির অনন্য পথ হিসেবে গ্রহণ করা। তবেই আমাদের এ আনন্দ ও বেদনা উভয়ই সার্থক হবে।

অতীব পরিতাপের বিষয়, রবিউল আউয়াল মাস আসলে আমরা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করি। বাণী আর বিবৃতি প্রচার করি; কিন্তু ফরজ-ওয়াজিব আদায় করি না, হারাম সুদ পরিত্যাগ করতে পারি না, দুর্নীতি ও ঘুষ ছাড়তে পারি না, মিথ্যা বর্জন করতে পারি না, লোভ-হিংসা-মোহ মুক্ত হতে পারি না। এমন হয় কেন? তবে কি নবীপ্রেমের তাৎপর্য আমাদের অন্তরে স্থান পায়নি? মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। নবী-রাসুল প্রেরণের লক্ষ্য হলো মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তাই আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসুল (সা.)-এর পথ অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ রাসুল (সা.) যা যা করেছেন বা করতে বলেছেন, তা করতে হবে। আর যা করেননি বা করতে বারণ করেছেন তা বর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের ঘোষণা- ‘রাসুল (সা.) তোমাদের যা দিয়েছেন তা ধারণ করো; আর যা থেকে বারণ করেছেন, তা হতে বিরত থাকো।’ (সুরা হাশর : ৭)।

আল-কোরআনে আরো বলা হয়েছে— ‘বলুন (হে রাসুল সা.) যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমার অনুকরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)। হাদিস শরিফে আছে, ‘তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মুমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি হবো তার নিকট তার পিতা-পুত্র ও সব মানুষ (এবং যাবতীয় সবকিছু) হতে প্রিয়।’ এ আলোকে নিশ্চিত করে বলা যায়, রাসুল সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসা ঈমানের পূর্বশর্ত। আর এ ভালোবাসা তাঁর নির্দেশ পালন ও অনুকরণের মাঝেই প্রকাশ পাবে। আমরা যখন উৎসব বা দুঃখ প্রকাশ করি তখন কি আমরা সে প্রকৃত ভালোবাসা ও আনুগত্যের কথা চিন্তা করি? না আমরা মিষ্টি খাওয়া বা একটা আনুষ্ঠানিক প্রথাই পালন করি।

হ্যাঁ, মিষ্টি খাওয়াও সুন্নাত বটে! তবে কথা হলো আমরা বর্তমানে শুধু মিষ্টিজাতীয় সুন্নাতগুলো পালনে অতিমাত্রায় যত্নশীল হয়ে পড়েছি। কিন্তু কতকগুলো সুন্নাতের কথা আমরা একেবারেই ভুলতে বসেছি। যেমন- দুঃস্থ ও আর্তের সেবা করা, গরিব-দুঃখীর দেখাশোনা করা ও মানবকল্যাণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়া আরো বহু বিষয় রয়েছে যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন ও করতে বলেছেন। সেগুলো আমাদের জন্য সুন্নাত এমনকি অনেক ফরজও বটে। কিন্তু আমরা সে সম্পর্কে উদাসীন। যাও কিছু করি তাও কি পরিপূর্ণ করতে পারি? না; বরং শুধু যে কোনো একটা দিক নিয়েই আত্মপ্রসাদ লাভ করি। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ নিজের কর্মপরিধি বাড়ানোর পরিবর্তে অন্য সবার সমালোচনা করে তৃপ্তি লাভ করি। যার দরুন নিজের অসম্পূর্ণতা ও অন্যের অসহযোগিতার ফলে পরাভূত হই বার বার।

মিলাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো জন্মলগ্ন বা জন্ম সম্পর্কে আলোচনা। আমাদের পরিভাষায় মিলাদ বলতে বুঝি-প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম ও জীবনী আলোচনা এবং তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করা। এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারিমে বর্ণিত হয়েছে-‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতাগণ তাঁর প্রতি রহমতের দোয়া করেন, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা তাঁর প্রতি দুরূদ পাঠ ও যথাযথরূপে সালাম পেশ করো। (সুরা আহযাব, আয়াত : ৫৬)

এ বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কাব্যগ্রন্থ, পুথি-পুস্তক, গল্প-উপন্যাস, কল্পকাহিনী, ছড়া-ছন্দ, পদ্য-গান, লিখিত হয়েছে। লেখা হচ্ছে। আরো বহু লিখিত হবে। এর তাৎপর্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অরো হবে। তবুও এটা নিশ্চিত যে, সব ব্যাখ্যার সার ব্যাখ্যা, সব কথার সার কথা যাতে সবাই একমত যে, মিলাদুন্নবী (সা.)-এর মূল শিক্ষা হলো একমাত্র কালিমা তায়্যিবা ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মোহাম্মাদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রাসুল।’ এ কালেমার গূঢ়ার্থ হাজারো প্রকারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ অথচ অতি সংক্ষিপ্ত ও অতি নিখুঁত বিশ্লেষণ হলো ঈমানে মুজমাল—‘বিশ্ব প্রভু আল্লাহর প্রতি আমি ঈমান আনলাম, তাঁর সব আদেশাবলি মেনে নিলাম।’

মোদ্দাকথা মিলাদুন্নবী (সা.)-এর আসল শিক্ষা হলো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসার, কঠোর সাধনার পরিপূর্ণ ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম বা জীবনবিধান ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে সর্বস্তরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শান্তির ধর্ম ইসলামকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এটাই নবী বা রাসুল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য। যা পবিত্র কোরআনে বারবার বিবৃত হয়েছে—‘তিনি সে মহান প্রভু যিনি রাসুল প্রেরণ করেছেন, সঠিক পন্থা ও সত্য ধর্ম সহযোগে, যাতে সে ধর্মকে প্রকাশ করতে পারেন সর্বধর্মের শিখরে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৩৩; সুরা ফাতহ, আয়াত : ২৮)।

 

লেখক : চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্কলার্স ফোরাম বাংলাদেশ এবং

সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সূফিজম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads