• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলাম মানবতার ধর্ম

  • প্রকাশিত ০৯ নভেম্বর ২০২০

মুফতি শরিফুল ইসলাম

 

মানবজাতির সঠিক রাহনুমায়ির জন্য, সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহতায়ালা আসমানি কিতাব পাঠিয়েছেন। যে যুগে আসমানি কিতাবের আইনব্যবস্থা যত শক্তভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, সে যুগের মানুষ তত বেশি সুশৃঙ্খল ছিল এবং সভ্য ছিল। হযরত ঈসা (আ.) কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়ার পর থেকে প্রায় পাঁচশত বছর কোনো নবী দুনিয়াতে আসেন নি। ততদিনে ঈসা (আ.)-এর খ্রিস্টান ধর্ম বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। মানুষ নানা পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। যে যুগকে আমরা ইসলামপূর্ব জাহেলিয়াতের যুগ বলে জানি। তখনকার সময়ে কত অশান্তি অরাজকতায় ভরপুর ছিল সারা বিশ্ব। মুর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল সারা বিশ্ব। মানুষের পরস্পরের অধিকার কী তা জানতই না। আসলে ‘মানবতা’ শব্দটাই কেউ জানত না তখন। তাদের ভারসাম্যহীন সমাজব্যবস্থা, সামান্য বিষয় নিয়ে শতবর্ষীব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত থাকা, অন্যায় অশ্লীল ও বেহায়াপনায় ভরপুর আচার আচরণ দেখে ঐতিহাসিকগণ সে যুগের নাম দিয়েছেন ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বা ‘অন্ধকার যুগ’। এ পথভ্রষ্ট, উদ্ভ্রান্ত, অপরাধী মানুষদেরকে সুপথে আনার জন্য মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে এ দুনিয়ায় প্রেরণ করলেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশুকাল থেকেই ভাবতেন সমাজের মানুষদের নিয়ে। সমাজব্যবস্থা নিয়ে। এই প্রথম একজন মানুষ ভাবলেন মানুষের অধিকার নিয়ে। যুবক বয়সে গঠন করলেন ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক সামাজিক সংগঠন, এবং বন্ধ করে দিতে সামর্থ্য হলেন শতবর্ষব্যাপী রক্তক্ষয়ী ‘হারবুল ফিজার’ বা ‘হারবুল ফুজ্জার’। ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্তির পর থেকেই শুরু হয় ইসলাম প্রচার। তাওহীদের ডাক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে রাত-দিন অক্লান্ত মেহনত করেন। তার ওপর নাযিল হয় মানুষের জীবনের সব বিষয়ের সমাধান সম্বলিত ঐশীগ্রন্থ আল  কোররআন। মানবতার নবী হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ধর্ম প্রচার প্রসার করেন তার নাম হলো ইসলাম।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর এমন দুঃসময়ে এ ধরার বুকে রাব্বুল আলামিনের একত্ববাদের ডাক দেন যখন সারা পৃথিবীতে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ বিরাজ করছিল। সেখানে কোনো ধর্ম-মত ছিল না। কিছু মানুষ একত্ববাদের বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তারা সংখ্যায় একেবারে নগণ্য ছিলেন। এমনকী সেখানে মানুষদেরকে মানুষই মনে করা হতো না। সে যুগে নারীদের অবস্থা জন্তু-জানোয়ার থেকেও নিম্নমানের ছিল। আর দাসদের অবস্থা আরো নাজুক ছিল। এই যখন পৃথিবীর অবস্থা তখন ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব। ইসলাম ধর্মই প্রথম সুর তুলে মানুষের অধিকার নিয়ে। ইসলামই প্রথম উত্থাপন করে নারীরা যে মানুষ তাদেরও যে পুরুষের মতোই পৃথিবীতে  বাঁচার-খাওয়ার অধিকার আছে। ইসলামই প্রথম দাসপ্রথার বিলোপ করে। যেখানে মানুষের অবস্থা এতো করুণ ছিল, বিভৎস ছিল মানবতা। সেখানে ইসলামই প্রথম ‘মানবতা’ নামের একটি অপরিচিত শব্দের আবিষ্কার করে। কত শত কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করে, বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে, বাধার প্রাচীর ভেঙে, ইসলাম আরব থেকে ছড়িয়ে পৃথিবীর সব প্রান্তরে। আমাদের ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর শেষ সীমানা আমেরিকা মহাদেশ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে ইসলামের বাণী, মানবতার বাণী। সারা পৃথিবীতে মানবতার জয়গান ফেরি করে বেড়িয়েছে ইসলাম ও তার ধারক বাহকরা। ইসলামের বাহকগণ সারা পৃথিবীর মানুষদের মানবতা শিক্ষা দিয়েছেন।

যে সব মানুষ ইসলামপূর্ব সময়ে অন্যায়-অবিচারের সাথে সম্পৃক্ত ছিল সেই মানুষগুলোই সোনার মানুষে পরিণত হলো। একসময় যারা ছিল ভক্ষকশ্রেণি, তারাই ইসলামের ছোঁয়াতে রক্ষকের বেশে আবির্ভূত হলো। বেশি দূর চিন্তার প্রয়োজন নেই আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশ নিয়ে চিন্তা করলেই বুঝা যাবে   গোটা পৃথিবী কী ছিল? আর ইসলাম কীভাবে গোটা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। ইসলাম আগমনের পূর্বে আমাদের এ উপমহাদেশে বর্ণবাদ তথা নিম্নবর্ণের লোকদের ওপর উচ্চবর্ণের লোকদের মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার চলছিল। নিম্নবর্ণীয় লোকদেরকে মানুষ বলেই বিবেচনা করা হতো না। কিন্তু ইসলাম এ সব বর্ণবাদ ছিন্ন করে সমতার আহ্বান নিয়ে আগমন করে। ইসলাম ধর্ম আগমনের ফলে আমাদের উপমহাদেশ এক নবজীবন পায়। মানুষের অন্তরে ইসলাম ধর্মের সুমহান বাণী মন্ত্রের ন্যায় আঘাত করে। তাছাড়া এর বাহকগণের নিষ্কলুষ চরিত্র, অপরিসীম সহনশীলতা, মানবতাবোধ সবকিছুই উন্নত রুচিবোধসম্পন্ন ছিল। যা ইতোপূর্বে মানুষ অন্য কোথাও খুঁজে পায়নি। তাই দলে দলে মানবতার জয়গান গাইতে গাইতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়া শুরু করে।

ইসলাম হলো শাশ্বত জীবনব্যবস্থা। যার বিধি বিধানে মানুষের কোনো হাত নেই। সবকিছু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। তাই ইসলাম হলো স্বভাবজাত ধর্ম। আর আল্লাহতায়ালা এ ধর্মকেই নির্বাচন করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো জীবনব্যবস্থা অন্বেষণ করবে তা কখনই গ্রহণ করা হবে না। এজন্যই দ্রুত সময়ে ইসলাম মানুষের মনে জায়গা করে নেয়। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের জয়গান। মানুষ হুমড়ি খেয়ে গ্রহণ করে মহান আল্লাহর নির্বাচিত এই ধর্ম। তবে যাদের কপালে হেদায়াত নামক মহাদৌলত নেই, তাদের কথা ভিন্ন। নববী যুগে নবী মোহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সরাসরি পেয়েও আবু জাহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়বা নামক নর্দমার কীটরা হেদায়াত লাভ করতে পারে নি; বরং মানবতার এই ধর্মের বিরোধিতা করেছে। তাদের চেলা-চামাণ্ডারাও পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারাও তাদের পূর্বসূরীদের মতো ইসলামকে সহ্য করতে না পেরে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। তারা প্রোপাগাণ্ডা ছড়ায়, ইসলামী আইনকে মানবতাবিরোধী বলে। ইসলাম নারীদেরকে আবদ্ধ রাখতে চায়, এমন সব অর্বাচীন কথা-বার্তা বলে বিদ্বেষ ছড়ায় তারা। অথচ মানুষের অধিকারের কথা সর্বপ্রথম পৃথিবীব্যাপী ফেরি করে বেড়িয়েছে ইসলাম। প্রথম যুগের মুসলিমরা কত অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে ইসলাম নামক এ জীবনব্যবস্থাকে মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন।

যারা ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করেন তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ, বিকৃত মনোভাব পরিত্যাগ করে সুস্থ ও নিরপেক্ষ মস্তিষ্কে একটু চিন্তা করুন, ইসলামের কোন বিধানটা মানবতাবিরোধী? আপনি সারাজীবন চিন্তা করেও ইসলামের কোনো বিধান মানবতার পরিপন্থী বলে প্রমাণ করতে পারবেন না। এ মহান ধর্মের কোনো একটি বিষয়ও মানবতাবিরোধী নয়; বরং প্রত্যেকটা বিষয়েই মানবতার জয়গান উচ্চারিত হয়েছে। আজ যদি পৃথিবীতে ইসলামী আইন কায়েম হয়, তাহলে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার হার একেবারে কমে যাবে। যার জলন্ত প্রমাণ আমরা দেখেছি হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে এবং দ্বিতীয় উমর নামে খ্যাত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ.)-এর শাসনামলে। তাঁদের শাসনামলে যেমন বাঘ আর ছাগল একঘাটে পানি খেত। সর্বত্র সুখ-শান্তি বিরাজমাম ছিল। আজও সর্বত্র শান্তির ছোয়ার এক মনোরম আবহ বিরাজ করবে যদি সঠিকভাবে ইসলামী আইন কার্যকর করা যায়।

বিকৃত মনোভাবের লোকদের চোখে আঙুল দিয়ে বলি, অতীত ইতিহাস দেখ। খোলাফায়ে রাশেদার যুগে কি শান্তির আবহ বিরাজ করেনি? তাদের শাসনামলে কি কোনো বিশৃঙ্খলা ছিল? মানুষের পরিবর্তনের সাথে সাথে জীব-জন্তুর মাঝেও পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। আরো ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে ইতিহাসের পরতে পরতে।

তাই ইসলাম সম্পর্কে সঠিকভাবে না জেনে, নামধারী কিছু মুসলিম লোকের উগ্র আচরণ দেখে ইসলামকে দোষারোপ করা যাবে না। তাই আগে ইসলাম সম্পর্কে জানতে হবে অতঃপর মন্তব্য করতে হবে। ইসলাম কখনো উগ্রতাকে সমর্থন করেনি; বরং নিষেধ করেছে। রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ-যুদ্ধ করেছেন। কাফেররা আক্রমণ করার পর মুসলমানরা আক্রমণ ঠেকিয়েছেন, পাল্টা আক্রমণ করেছেন। বর্তমান পৃথিবীতে মুসলমানরা ধৈর্যের যে দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছে তা অন্য ধর্মের লেকদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। যে ধর্ম পৃথিবীকে মানবতা শিক্ষা দিয়েছে, যে ধর্মের বাহকরা মানুষকে সভ্যতা শিখিয়েছে। যে ধর্ম মানুষের অধিকারের প্রথম ঘোষক। আসুন মানবতার, সভ্যতার আর মানুষের অধিকারের সে ধর্মের মূল্য বুঝতে চেষ্টা করি। না জেনে না বুঝে তার বিরোধিতা না করি। সর্বকণ্ঠ মিলিয়ে গগনবিদারী আওয়াজ তুলি, ‘জয় হোক ইসলামের’। মহান আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

 

লেখক : পরিচালক, হালিমাতুস সাদিয়া মহিলা মাদরাসা, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads