• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসপ্রায় দারাসবাড়ি মসজিদ

  • ফিচার ডেস্ক
  • প্রকাশিত ০৯ নভেম্বর ২০২০

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার ছোট সোনা মসজিদ ও কোতোয়ালী দরজার মধ্যবর্তী স্থানে ওমরপুরের সন্নিকটে দারাসবাড়ি মসজিদটি অবস্থিত। অযত্ন-অবহেলায় বর্তমানে ধ্বংসপ্রায়। মসজিদটির অবস্থান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে মহানন্দা নদীর পাড় ঘেঁষে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ রাইফেলসের সীমান্ত তল্লাশি ঘাঁটি; এই ঘাঁটির অদূরে অবস্থিত দখল দরওয়াজা। দখল দরওয়াজা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে আমবাগানের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হয়ে একটি দিঘি পার হয়ে দক্ষিণ পশ্চিমে ঘোষপুর মৌজায় দারাসবাড়ি মসজিদ ও দারাসবাড়ি মাদরাসা অবস্থিত।

ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের সময় মুনশী এলাহী বখ্শ কর্তৃক আবিষ্কৃত একটি আরবী শিলালিপি অনুযায়ী (লিপি দৈর্ঘ্য ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি, প্রস্থ ২ ফুট ১ ইঞ্চি) ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে (হিজরী ৮৮৪) সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের রাজত্বকালে তারই আদেশক্রমে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এই মসজিদের নাম দারাসবাড়ি ছিল না। ফিরোজপুর জামে মসজিদ ছিল। ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে যখন সুলতান হোসেন শাহ্ কর্তৃক দারাসবাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হয় তখন অত্র অঞ্চলের নাম দারাসবাড়ি নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। ফিরোজপুর জামে মসজিদ নাম হারিয়ে দারাসবাড়ি নাম ধারণ করে। দীর্ঘদিন মাটিচাপা পড়েছিল এ মসজিদ। সত্তর দশকের প্রথমভাগে খনন করে এটিকে উদ্ধার করা হয়। মসজিদটি দীর্ঘকাল আগে পরিত্যক্ত হয়েছে, বর্তমানে চারপাশে গাছগাছালির ঘের। পরিচর্যার অভাবে এ মসজিদটি বিলীয়মান। এর সংলগ্ন সমসাময়িক আরেকটি স্থাপনা হলো দারাসবাড়ি মাদরাসা। দিঘির এক পাড়ে মসজিদ এবং অন্য পাড়ে মাদরাসা অবস্থিত।

মসজিদটির বাইরের দিকের পরিমাপ ৩৪ মি ী ২০.৬ মি এবং ভেতরের পরিমাপ ৩০.৩ মি ী  ১১.৭ মি। এটি মধ্যযুগীয় বাংলার বৈশিষ্ট্যধারী একটি জামে মসজিদ, যা ভেতরে ও বাইরে টেরাকোটা ফলক অলংকরণসহ ঈষৎলাল বর্ণের ইট প্রদর্শন করছে। বর্তমানে এটি আচ্ছাদনবিহীন এবং সামনে একটি ভেঙ্গেপড়া বারান্দা রয়েছে। মসজিদটির দুটি অংশ, একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ, সম্পূর্ণ ইমারতটি পূর্ব-পশ্চিমে টানা একটি চওড়া ‘নেভ’ (হধাব) দ্বারা বিভক্ত। মূল প্রার্থনা কক্ষের ‘নেভের’ ওপরের আচ্ছাদন তিনটি চৌচালা ভল্টের সাহায্যে তৈরি; যার মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড়। নেভের প্রতিপার্শে উল্টানো পেয়ালার আকৃতিতে তৈরি সারিবদ্ধভাবে নয়টি করে মোট ১৮টি গম্বুজ আছে। বারান্দার ওপরও এরূপ চৌচালা আচ্ছাদন ও গম্বুজ রয়েছে। বারান্দার নেভের ওপর কিছুটা ছোট চৌচালা আকৃতির আচ্ছাদন এবং এর উভয়পার্শ্বে তিনটি করে একই রকম গম্বুজ নির্মিত হয়েছে। ফলে মসজিদের ওপরে সর্বমোট চারটি চৌচালা আচ্ছাদন ও ২৪টি গম্বুজ নির্মিত হয়েছে যার সব কয়টি এখন নিশ্চিহ্ন। ইট ও পাথরের স্তম্ভগুলো যথাযথভাবে এ ভল্ট এবং গম্বুজগুলোর ভার বহন করত। সবগুলোই বর্তমানে ভেঙ্গে গেছে এবং উন্মুক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভের ওপর থেকে সূচাঁলো খিলান তৈরি হয়েছিল যা গম্বুজের বর্গাকৃতি ভিত্তি সৃষ্টিকারী পেন্ডেন্টিভকে ধারণ করেছিল। এ মসজিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো মূল কক্ষের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত রাজকীয় গ্যালারি (কখনো এটাকে ভুলভাবে মহিলা গ্যালারি বলেও বর্ণনা করা হয়েছে)। বাইরে থেকে প্রবেশের জন্য ছিল সিঁড়িযুক্ত মঞ্চ, যা সশস্ত্র প্রহরী দ্বারা সুরক্ষিত থাকত। ওই গ্যালারি এ মসজিদকে শহরের অন্যান্য মসজিদের মতো জামে মসজিদ বলে নির্দেশ করে। মসজিদের উত্তরে একটি প্রবেশপথ ছিল, এখন সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা পাথর থেকে এর অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। প্রতি কোণে অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ নির্মাণ করে মসজিদকে মজবুত করা হয়েছিল। পূর্বেরগুলো এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, শুধু ভিত্তির কিছু অংশ টিকে আছে। এ মসজিদের অলংকরণ অত্যন্ত জমকালো। অনুভূমিকভাবে, ‘অফসেট’ ও ‘ইনসেট’ ও নকশার সাহায্যে বাইরের দেয়াল বিন্যস্ত। সাথে রয়েছে পোড়ামাটির ফলকের প্যানেল, যার মধ্যে ঝুলন্ত মোটিফের প্রাধান্য রয়েছে। ভেতর দিকে খিলান ও পেন্ডেন্টিভগুলোতে ইটের গাঁথুনির মাধ্যমে সজ্জিত করা হয়েছে। মিহরাবগুলোকে প্রতিটি ‘বে’ বরাবর স্থাপন করা হয়েছে। মিহরাবগুলোর খিলান লতাগুল্ম, পত্রসম্ভার, গোলাপ, চারাগাছ ও ঝুলন্ত নকশায় সজ্জিত পোড়ামাটির ফলকের ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত। খিলানগুলোর অলংকরণশৈলী গৌড়-লখনৌতির এক প্রকার অলংকরণশৈলীর অতি উৎকৃষ্ট নমুনা। এ পোড়ামাটির ফলকগুলো অন্যান্য উদাহরণের চেয়ে উন্নতমানের এবং এগুলোতে কিছুটা ঔজ্জ্বল্যের আবরণ থাকাতে দেখতেও কিছুটা ভিন্ন ধরনের ও আকর্ষণীয়। পশ্চিম দেয়ালটি টিকে আছে, এবং দক্ষিণ দিকের দেয়ালে সংস্কারের ফলে পোড়ামাটির ফলকের আসল রূপ নষ্ট হয়ে গেছে। মসজিদের বক্র কার্নিসে ধাবমান সারিতে পতাকার আকারে পোড়ামাটির ফলক স্থাপনের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় উদ্দেশ্য  রয়েছে, যা ঘোষণা করে মসজিদের নির্মাতা ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান ও বিশ্বাসীদের নেতা (আমীর-উল-মুমিনীন)।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads