• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

বাকস্বাধীনতা মানেই কি ধর্মবিদ্বেষ

  • প্রকাশিত ১২ নভেম্বর ২০২০

মুফতি শরিফুল ইসলাম

 

আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে যেসব নিয়ামতরাজি দিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো কথা বলার শক্তি। যার মাধ্যমে আমরা মনের ভাব আদান-প্রদান করে থাকি। আমরা কথা বলার ক্ষেত্রে স্বাধীন। যখন যা ইচ্ছা তা বলার ক্ষমতা জিহ্বার আছে। কিন্তু বাকস্বাধীনতা মানে এটা নয় যে, যখন যা মন চাইবে তাই বলে দেব। বর্তমানে অনেকেই ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে বাকস্বাধীনতা বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে থাকে। বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়। জুলুম, নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার, হত্যা, খুন, আইনের দুঃশাসনের বিষয়ে বাকস্বাধীনতার ফুলঝুরি নেই। তবে ‘বাকস্বাধীনতাকে’ ইসলামের বিপক্ষে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে  ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকরা।

যেসব দেশে ইসলামের বিরোধীরা অন্য কোনো উপায়ে ইসলামী জোয়ার ঠেকাতে পারছে না, সেসব দেশে বাকস্বাধীনতাকে তারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আর তাদের সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে তাদের খরিদ করা কিছু নামধারী মুসলমান। ইসলামী পরিচয়েই নাস্তিকতার পোশাক পরে ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছে। আবার কিছু লোক আছে যারা নিজেদেরকে মুক্তচিন্তক বা মডারেট হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য ইসলাম ধর্মের কোরআন-হাদিস, নবী-রাসুল, নামাজ, পর্দা, পরকাল, হজ্ব, তাবলীগ এমনকী মহান আল্লাহ সম্পর্কে কটূক্তি করে থাকে। আর হলুদ মিডিয়ারা তাকে আধুনিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রমোট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অথচ এদেশের মুসলমানরা ইসলামকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। অনেকে এমন আছে যে, নামাজ-রোজা বা ধর্মীয় বিধি-নিষেধ কম মানেন। কিন্তু ইসলামের সবকিছু বিশ্বাস করেন মনে-প্রাণে। মুসলমানদের  বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে তাওহিদ বা একত্ববাদ। আমাদের দেশে প্রায় ৪ লাখ মসজিদ রয়েছে। এদেশে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত হয় মিনারের আযানের ধ্বনির মাধ্যমে। ফজরের আযানের সুরে এদেশের মুসলমানদের ঘুম ভাঙ্গে। মসজিদ, মাদরাসা, আযান, ইকামত ইত্যাদি হচ্ছে মুসলমানদের জাতীয় সংস্কৃতির অংশ। এদেশের মানুষের কাছে কোরআন-হাদিস, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় গ্রন্থাদি, ধর্মীয় পোশাক সম্মানের পাত্র। ধর্মীয় ব্যক্তি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও কৃষ্টি-কালচারের প্রতি রয়েছে সীমাহীন শ্রদ্ধা ও ভক্তি। ধর্মীয় অনুভূতির বিশেষ একটি প্রভাব রয়েছে আমাদের জাতীয় অঙ্গনেও। সঙ্গত কারণেই ইসলাম সম্পর্কে যখনই কোনো কটূক্তি বা কটাক্ষ করা হয় এবং দেশের নব্বই ভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি এবং বিশ্বাসে আঘাত হানা হয় তখন গোটা দেশ আন্দোলিত হয়ে ওঠে। জাতীয় সংকট সৃষ্টি হয়। আর বহির্বিশ্বে আমাদের ধর্মীয় ভাবমূর্তিকে কলুষিত করা হয়।

সারা পৃথিবীতে ইসলামের প্রচার-প্রসার দেখে ইসলামবিদ্বেষীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তাই বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ইসলামী সভ্যতা মুছে দিতে আন্তর্জাতিকভাবেও  ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। যে কারণে বিভিন্ন দেশে অন্যায় অভিযান চালিয়ে ইসলামবিরোধীরা লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে সভ্যতার লীলাভূমিকে তারা বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে। বিভিন্ন সময় নানাভাবে তারা ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষের চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে বিশ্ব পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত রেখেছে। যার বাস্তব নমুনা আমরা দেখেছি ২০০৫ সালে ডেনমার্কের একটি পত্রিকায়, ২০০৭ সালে সুইডেনের একটি পত্রিকায় এবং বর্তমান ২০২০ সালে ফ্রান্সে হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আপত্তিজনক ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করেছে। তারা তাদের এই কাজকে ব্যক্তিস্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, সুইডেন ইত্যাদি দেশে ইসলামবিদ্বেষীরা রীতিমতো উন্মাদ হয়ে গেছে।

ইসলাম বাকস্বাধীনতা এবং সমালোচনার স্বাধীনতাও দিয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কারণ, উম্মাহর কল্যাণ, চরিত্র ও নৈতিকতা সংশোধনের স্বার্থে মতপ্রকাশ ও সমালোচনা করা কখনো কখনো ওয়াজিব হয়ে যায়। সবসময় হক কথা বলতে হবে, আল্লাহর পথে কাজ করতে গিয়ে কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করা চলবে না। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করতে হবে। কল্যাণের দিকে মানুষকে ডাকতে হবে। ভালো কাজের স্বীকৃতি দিয়ে মানুষকে বলতে হবে, আপনি উত্তম কাজ করেছেন। আর কেউ মন্দ কাজ করলে বলতে হবে, আপনি খারাপ কাজ করেছেন। এসব হক কথা বলার জন্য যখন নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না কিংবা আপনার নীরবতাই যখন উম্মাহর ক্ষতি ও মানুষের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, তখন এসব সংশোধনমূলক কাজ অপরিহার্য কর্তব্যে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় সত্য বলা অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়ে। এতে কোনো বিপদের পরোয়া করা যাবে না।

‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করো। এতে বিপদ আসলে সবর করো। নিশ্চয়ই তা এক মহান ব্যাপার।’ কোরআনের এই বাণী হলো ইসলামের অন্যতম মৌলিক অনুশাসন। ইসলামে এমন কোনো সুযোগ নেই যাতে করে মানুষের টুঁটি চেপে ধরে লাগাম পরিয়ে রাখা হবে। ‘অনুমতি ছাড়া মানুষ কথা বলতে না পারা’ এমনটি ফেরাউন ও তার প্রেতাত্মাদের বৈশিষ্ট্য।

ইসলাম বাকস্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু ধর্মহীনতা ও পাপাচারের স্বাধীনতা দেয়নি। আজকাল যাকে বাকস্বাধীনতা হিসেবে দাবি করা হয়, ইসলামের বাকস্বাধীনতার স্বরূপ তেমনটা নয়। বাকস্বাধীনতার অর্থ যদি হয় ইসলামবিদ্বেষীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য শুধু ইসলামী বিষয় নিয়ে অমূলক, অশালীন, বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড করা; তাহলে ইসলাম এমন স্বাধীনতাকে অনুমোদন করে না। কারণ এটা পাপাচারের স্বাধীনতা, অধিকারের স্বাধীনতা নয়। ইসলাম চিন্তাভাবনা, জ্ঞান, মতামত গঠন, মতপ্রকাশ, সমালোচনা, বিশ্বাস ও ধর্মের স্বাধীনতাকে অনুমোদন করে। এই স্বাধীনতাগুলোর ওপরই মানবজীবন দাঁড়িয়ে আছে। যা অন্যের ক্ষতিসাধন করে না—এই আইনি শর্ত ও নীতির চুক্তিতে ইসলাম মানুষকে স্বাধীনতা দেয়।

ইসলামের সাধারণ মূলনীতি হলো, ‘ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করাও নয়।’ আদতে এমন কোনো স্বাধীনতা কি আছে, যা নিজের বা অন্যের ক্ষতিসাধনের অনুমোদন দেয়? যদি থাকে তাহলে এমন স্বাধীনতাকে মোকাবিলা করা উচিৎ, শর্তাধীন করা উচিৎ। কারণ, যেখান থেকে অন্যের স্বাধীনতার শুরু হয়, আপনার নিজের স্বাধীনতা সেখানেই শেষ হয়ে যায়। তাই এমন স্বাধীনতার কথা কেউই সমর্থন করে না, যেখানে স্বাধীনতার নামে অপরকে দমনপীড়ন বা নিষ্পেষিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাস্তায় সবার চলাফেরার স্বাধীনতা থাকলেও রাস্তার আদব-কায়দাও তো মেনে চলতে হবে। আপনি অপরের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে পারেন না বা যানবাহনের পথ রোধ করতে পারেন না। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করতে পারেন না। লাল বাতি জ্বললে আপনাকে থেমে যেতে হবে কিংবা নির্ধারিত পথেই আপনাকে হাঁটতে হবে। এগুলোই হচ্ছে আপনার স্বাধীনতার শর্ত বা সীমারেখা। সবার কল্যাণের স্বার্থেই এই বিধিনিষেধ ঠিক করা হয়েছে। প্রত্যেক মতাদর্শ ও ব্যবহারিক ব্যবস্থার মধ্যেই স্বাধীনতার এরূপ সীমারেখা নির্ধারিত রয়েছে। ইসলামও তাই করেছে। কেননা, মানবতার জন্যে এটাই সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা।

আধুনিক জামানার ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলাম সম্পর্কে যেসব কটূক্তি করেছে আইয়ামে জাহিলিয়াতের বর্বর সমাজেও এরূপ ইসলামবিদ্বেষের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অথচ আমাদর সভ্যসমাজে এই ঘৃণিত কাজগুলো অহরহ সংঘটিত হচ্ছে।

যারা ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন তাদের অধিকাংশ পিতৃপরিচয়ে মুসলিম এবং ইসলামী নামধারণ করেই ইসলাম সম্পর্কে কটাক্ষ করে চলেছেন। তারা কি কেবল বাকস্বাধীনতার খাতিরেই ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি করছেন? বরং না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারা একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে চলেছেন। আর তা হচ্ছে ধর্মহীনতার ব্যাপক প্রসার ঘটানো।

দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে ইসলামের বিপক্ষে দাঁড় করানো এবং ইসলামের বিভিন্ন প্রতীক যেমন টুপি, দাঁড়ি, পাঞ্জাবি, বোরকা ইত্যাদিকে কলুষিত করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে, ওরা কারা? আজকাল কলেজ-ভার্সিটিগুলোতে ধর্মপরায়ণ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা হচ্ছে। ইসলামপন্থীদেরকে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, জঙ্গি, গোঁড়া ইত্যাদি বলে নানা অপপ্রচার চালিয়ে ইসলামকে কলুষিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আপনি মুসলমান না হোন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা যে কোনো ধর্মের হোন না কেন। কোনো ধর্ম তো একথা বলেনা যে, অন্য ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করো। অথবা আপনি নাস্তিক, থাকুন আপনার নাস্তিকতা নিয়ে। কিন্তু ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কটাক্ষ করে পরিবেশ অশান্ত করার অধিকার আপনার নেই।

দায়িত্বশীলদের খতিয়ে দেখা দরকার, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির এই দেশে বারবার ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কটাক্ষ করে দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করতে উঠে-পড়ে লেগেছে, ওরা কারা?

 

লেখক : পরিচালক, হালিমাতুস সাদিয়া মহিলা মাদরাসা, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads