• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামে মেহমানদারির গুরুত্ব

  • প্রকাশিত ১৩ নভেম্বর ২০২০

মিনহাজ উদ্দিন

 

 

 

বর্তমান সমাজে দেখা যায়, মেহমান এলে মানুষ বিরক্ত হয়। অথচ ইসলামে মেহমানদারির গুরুত্ব অনেক বেশি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে সে যেন তার মেহমানের সমাদর করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৭৯)। প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত সালমান ফারসি (রা.) বলেন, ‘একবার আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলাম। তিনি (সা.) একটি বালিশে হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। আমাকে দেখে তিনি বালিশটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। নবীজি বললেন, ‘সালমান, যখন কোনো মুসলমান তার ভাইয়ের কাছে আসে তখন তার সম্মানে যদি একটি বালিশও সে এগিয়ে দেয়, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। (হায়াতুস সাহাবা, পৃষ্ঠা : ৪৪৬)।

মেহমানের ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের কোনো পার্থক্য করা যাবে না। অনেকেই ধনী আত্মীয়-স্বজনদের সম্মান করে, খুব আপ্যায়ন করে থাকে। কিন্তু গরিব নিকট আত্মীয়কে অবহেলা করে থাকে। কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে ধনীদের জন্য বিশেষ আয়োজন আর গরিবদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেই। এ ব্যাপারেও নবীজি হুঁশিয়ারি করেছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে অলিমায় শুধু ধনীদের আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং গরিবদের বাদ দেওয়া হয়, তা সবচেয়ে নিকৃষ্ট খাবার।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৭৯৯)। ইসলাম সব ধরনের মেহমানকে সম্মান করে। এমনকি মেহমান যদি অমুসলিমও হয়ে থাকে তবুও অবহেলা করার সুযোগ নেই।

সাহাবি রুশদ ইবনে আবদুর রহমান (রা.) বলেন, ‘ইসলাম গ্রহণের আগে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেহমান হয়েছিলাম। তিনি আমার খোঁজখবর নিলেন। তাঁর কাছে আমাকে বসালেন। যতক্ষণ আমি তাঁর কাছে ছিলাম ততক্ষণ তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। তার এই অসাধারণ আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। (হায়াতুস সাহাবা, পৃষ্ঠা : ৪৪৭)।

ইসলাম মেহমানদারির এতই গুরুত্ব দিয়েছে যে, শত্রুও যদি মেহমান হয়ে আসে তাকেও যথাযথ আপ্যায়ন করতে হবে। আরবের মুহারিব গোত্র ছিল খুবই উগ্র। কট্টর ইসলামবিরোধী। ইসলামের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে যখন মানুষ দলে দলে মদিনায় আসতে লাগল তখন মুহারিব গোত্রেরও দশজন লোক মদিনায় এলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের অভ্যর্থনা-আপ্যায়নের জন্য বেলাল (রা.)-কে দায়িত্ব দেন। সকাল-বিকাল তাদের আহারের সুব্যবস্থা করেন। এতে তারা মুগ্ধ-বিস্মিত হলো এবং ইসলাম গ্রহণ করে নিজ দেশে ফিরে গেল। (আসাহহুস সিয়ার, পৃষ্ঠা : ৪৪৪)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অতিথিদের নানা দুর্ব্যবহারেও সহনশীলতার পরিচয় দিতেন। তাদের অসৌজন্যতা নীরবে সয়ে যেতেন। ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিতেন তাদের। একটু কটুবাক্যও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো বলতেন না। অন্যদেরও কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। এক গ্রাম্য লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলো। হঠাৎ সে মসজিদ-ই-নববির ভেতরেই প্রস্রাব করতে লাগল। সাহাবায়ে কেরাম তাকে বাধা দিতে গেলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও এবং তার প্রস্রাবের ওপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। তোমরা কঠোর হওয়ার জন্য নয়, বরং নম্র ব্যবহারের জন্য প্রেরিত হয়েছ।’ (মুখারি, হাদিস : ২২০)

মেহমানের আদর-আপ্যায়ন ও খাতির-যত্নেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো সংকোচবোধ ছিল না। তিনি মেহমানের সঙ্গে একই পাত্রে বসে খেতেন। মেহমান তৃপ্তিসহকারে খেয়ে না ওঠা পর্যন্ত তিনি উঠতেন না। বসে থাকতেন। ভালো খাবারগুলো মেহমানের দিকে এগিয়ে দিতেন। নিজের পরিবারকে অভুক্ত রেখে তিনি মেহমানদের খাওয়াতেন।

আসহাবুস সুফফা ছিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিত্য মেহমান। তিনি তাদের খাতির-যত্নের কোনো কমতি রাখেননি। অন্য মেহমানদের তিনি আসহাবুস সুফফার সঙ্গে মসজিদ-ই-নববিতে থাকার ব্যবস্থা করতেন। তাছাড়া দুই নারী সাহাবি রামলা ও উম্মে শরিক (রা.)-এর ঘরেও মেহমানদের থাকার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। (শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাহ, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৮০)। এতেও সংকুলান না হলে তিনি সাহাবাদের মধ্যে মেহমানদের বণ্টন করে দিতেন। তাদের খাতির-যত্নের তাগিদ দিতেন। সাহাবারাও তাদের সমাদর করতেন। মক্কা বিজয়ের পর মদিনায় অতিথির কোনো অভাব ছিল না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাদের খেদমত আঞ্জাম দিতেন। আর সাহাবি বিলাল (রা.)-কে রাষ্ট্রীয় মেহমানদের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেন। (সিরাতুন নবী, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৫০৪)।

মেহমানের বিদায়কালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেহমানদের পথখরচ ও উপহার দিতেন। কখনো পর্যাপ্ত উপহার দিতে না পারলে অল্প হলেও দিতেন এবং মেহমানের কাছে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি কামনা করতেন। কখনো বিশেষ সাহাবিকে বলে দিতেন, যাতে তিনি তাদের পথখরচ দিয়ে দেন। অন্যান্য উপহার তো থাকতই। বিশেষত যখন কেউ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপহার নিয়ে আসত তখন তিনি তা গ্রহণ করতেন এবং তাকে বিদায়কালে নিজের পক্ষ থেকে অবশ্যই উপহার দিতেন। হারিস ইবনে আউফের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল নবীজির মেহমান হলো। বিদায়কালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রত্যেককে ১০ উকিয়া পরিমাণ রুপা দিলেন। সাহাবি হারিসকে দিলেন ১২ উকিয়া পরিমাণ। (আসাহহুস সিয়ার, পৃষ্ঠা : ৪৪৩)। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আতিথেয়তা মুসলমানদের অনুপম আদর্শ। আধুনিক যুগেও এসব সুন্নাহই আভিজাত্যের নিদর্শন। এসব সুন্নাহ থেকে মুসলমানরা নিত্য দূরে সরে যাচ্ছে। তাই আসুন, মেহমানের সমাদর করি। তাদের খাতির-যত্ন ও আদর-আপ্যায়নে সুন্নতের অনুসরণ করি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক : ইমাম, খতিব ও ইসলামী আলোচক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads