• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির প্রাণপুরুষ মোহাম্মদ (সা.)

  • প্রকাশিত ১৪ নভেম্বর ২০২০

মুফতি শরিফুল ইসলাম

 

 

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি’। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বের সবশ্রেণির মানুষের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি রক্ষায় তিনি যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, সেই আদর্শ বর্তমান সময়ে অনুসরণ-অনুকরণ করলেই বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হবে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি। শান্তি-সমপ্রীতি ও মানবতার ধর্ম হলো ইসলাম। কোনোরূপ ফেতনা-ফ্যাসাদ, সহিংসতা, বিশৃঙ্খলার স্থান ইসলামে নেই। শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমপ্রীতি বিনষ্ট হয় এমন আচরণকেও ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। সর্বক্ষেত্রে শান্তির বিধান নিশ্চিত করে বিশ্বব্যাপী সৌহার্দ্য, শান্তি ও সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। মানবজীবনে উদারতা একটি মহান শিক্ষা। এর দ্বারা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবখানেই বজায় থাকে স্থিতিশীলতা ও শান্তি। উদারতা ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা না থাকলে কোথাও স্বস্তি মেলে না। ইসলাম উদারতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। সব মত, পথ ও ধর্মের সহাবস্থানের জায়গাটি হলো ইসলাম। বিগত দেড় হাজার বছর ধরে ইসলাম উদারতা, মানবিকতাবোধ, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি ও পরধর্ম সহিষ্ণুতার অপূর্ব নজির স্থাপন করে আসছে।

হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত জীবনব্যবস্থার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গান্ধী বলেছিলেন, ‘প্রতীচ্য যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, প্রাচ্যের আকাশে তখন উদিত হলো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং আর্ত পৃথিবীকে তা দিলো আলো ও স্বস্তি। ইসলাম মিথ্যা ধর্ম নয়। শ্রদ্ধার সঙ্গে হিন্দুরা তা অধ্যয়ন করুক, তাহলে আমার মতোই তারা একে অপরকে ভালোবাসবে।’ একটি রাষ্ট্রে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের ও সমপ্রদায়ের নাগরিক থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাসকারী সব সম্পদায়ের মধ্যে সমপ্রীতি, সদ্ভাব, উদারতা প্রতিষ্ঠা করে বসবাস করাই সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতি। মানবতার ধর্ম ইসলাম এই সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি রক্ষা তথা সব নাগরিককে তার ন্যায্য অধিকার প্রদান করে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে সৌহার্দ্য, সমপ্রীতি বজায় রেখে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে।

অমুসলিমদের প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি সুরক্ষায় ইসলামের রয়েছে শাশ্বত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি আচরণ সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির বিরল ও প্রজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করার পর যে ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন করেন তা ইসলাম তথা বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি-সমপ্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। মদিনায় বসবাসরত বিভিন্ন গোত্র, উপগোত্র, সমপ্রদায় ও গোষ্ঠী, দল ও উপদলের সহাবস্থান, সৌহার্দ্য-সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন। যা ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত। এতে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা রয়েছে। অতুলনীয় চরিত্র মাধুর্য, অনুপম শিক্ষা ও আদর্শ, আমল ও আখলাক দ্বারা তিনি মানুষকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মদিনায় মুসলমান, ইহুদি এবং আওস ও খাযরায গোত্রসহ ১২টি উপগোত্রের বসবাস ছিল। চরম গোষ্ঠীগত মতানৈক্য ও সংঘাতের মধ্যে সব গোষ্ঠী, সমপ্রদায়, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনাকে তার একটি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। মদিনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার মাঝে সৌহার্দ্য-সমপ্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন। যেমন-সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সমপ্রদায় ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে। সব ধর্ম সমপ্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে। কেউ কারো ওপর কোনোরূপ আক্রমণ করবে না। সন্ধিভুক্ত কোনো সমপ্রদায় বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে উক্ত আক্রান্ত সমপ্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে। কোনো নাগরিক কোনো অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।

মদিনার সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তৎকালীন সমাজের গোত্রসমূহের আন্তঃকলহের অবসানসহ নৈরাজ্যমুক্ত, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম ও কুরাইশদের মাঝে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশকটি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। এতদসত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মেনে নেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর সন্ধিতে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের সাথে ‘রাসুলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসুল, তাহলে তো আর আপনার সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো না। আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী (রা.)কে বললেন ‘রাসুলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লেখ। এতে হযরত আলী (রা.) অপারগতা প্রকাশ করায়, রাসুল সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন।

সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি রক্ষায় ইসলাম এতোই স্বোচ্চার যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেদের জানমালের পাশাপাশি সংখ্যালঘু অমুসলিম সমপ্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্যও মুসলমানদের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর আঘাত-সহিংসতা ও অন্য ধর্মের প্রতি সামান্য কটূক্তি করতেও নিষেধ করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করব। (আবু দাউদ)। অন্যত্র বর্ণিত আছে ‘যে ব্যক্তি সংখ্যালঘুকে উত্ত্যক্ত করলো সে আমাকে উত্ত্যক্ত করলো, আর যে আমাকে উত্ত্যক্ত করলো, সে আল্লাহকেই উত্ত্যক্ত করলো।’ অমুসলিম নাগারিককে হত্যা করা সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সংখ্যালঘুকে হত্যা করবে সে বেহেশতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ বেহেশতের সুঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দূরত্ব হতেও পাওয়া যায়।’ হযরত আলী (রা.) সুস্পষ্ট ভাষায় অমুসলিমদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো এবং তাদের ধনসম্পদ আমাদের ধনসম্পদের মতো।’ অমুসলিমদের জানমাল মুসলমানদের নিজের জানমালের ন্যায় পবিত্র ও নিরাপত্তাযোগ্য।

হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ছিল, মানুষে মানুষে ঘৃণা বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী সবকিছু থেকে বিরত থাকতে হবে। পরস্পরে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করার লক্ষ্যে সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। এ জাতীয় সমপ্রীতি ও জাতীয় ঐক্য রক্ষার জন্য হযরত মোহাম্মদ (সা.) বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা শোন; আরবের ওপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আবার অনারবের ওপরও আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালোর ওপর সাদার এবং সাদার ওপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কেননা, সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে সৃষ্ট। শ্রেষ্ঠত্ব যাচাইয়ের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেকে তিনটি বিষয় হতে সম্পূর্ণরূপে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ১. ঝগড়া-বিবাদ। ২. বেশি কথা বলা। ৩. অনর্থক বিষয়াদি হতে বেঁচে থাকা। অনুরূপ তিনটি বিষয় হতে অন্যকেও বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ১. কারো নিন্দা করতেন না। ২. কাউকে লজ্জা দিতেন না। ৩. কারো দোষ তালাশ করতেন না।

মুমিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে লোকজন নিরাপদ থাকে, সেই মুসলমান এবং যার নির্যাতন থেকে মানুষ নিরাপদ; তাকে মুমিন বলে।’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমন ঘোষণার পর যারা অমুসলিমদের  সাথে খারাপ আচরণ করে, তাদেরকে অযথা হয়রানি করে, তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে বা জবরদস্তিমূলক দখল করে রাখে, তারা কি নিজেদেরকে মুসলমান পরিচয় দিতে পারে? এ ব্যাপারে স্পষ্ট ফতোয়া আসলে বহু অমুসলিম ইসলামের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হতো।

ইসলাম পরধর্মসহিষ্ণুতার মূর্তপ্রতীক এবং অন্যান্য ধর্মের নির্দেশ হলো, ভিন্ন ধর্মের কোনো কিছু নিয়ে কটূক্তি করা যাবে না। বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই—রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে নেই সমপ্রীতি, নেই শান্তি। উল্টো দেখা যায়—আগ্রাসন, সামপ্রদায়িক দাঙ্গা, বর্ণবাদ ও শ্রেণিবৈষম্য প্রকটা আকার ধারণ করে আছে। নোবেল বিজয়ীরা শান্তির জন্য পদক পেলেও কোথাও কিঞ্চিৎ শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শান্তির এদূতদের হাতই রক্তে রাঙানো। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় সামপ্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর জন্য, বিভিন্ন পদ্ধতিতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়। বিভিন্ন উস্কানিমূলক আচরণ প্রকাশ হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়। যা মূলত দেশবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্র। তাই এদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। দেশের ভাবমূর্তি, সমপ্রীতি রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব করলে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপর্যস্ত হবে।

আসুন সবাই মিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশটাকে এগিয়ে নেই। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক : পরিচালক, হালিমাতুস সাদিয়া মহিলা মাদরাসা, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads