• বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪২৯
আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক হজরত মোহাম্মদ (সা.)

সংগৃহীত

ধর্ম

আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক হজরত মোহাম্মদ (সা.)

  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর ২০২০

বর্তমান বিশ্বে চলছে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনতাইয়ের এক নাটকীয় অধ্যায়। সমাজ, পরিবার সব কিছুতেই এই ধারা বিরাজমান। আজকের এই যুগের চিত্র এবং মুসলমানদের অবস্থা পর্যালোচনা করলে সোনালী সেই যুগ আমাদের কাছে আকাশ-কুসুম মনে হবে। সেই সোনালী যুগের মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, দাম্পত্য জীবন সবই আমাদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর। এই বাতিঘর থেকে কিছু আলো সঞ্চয় করতে পারলেই আমাদের জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র সবই সেই সোনালী যুগের আলোর ধারায় প্রবাহমান হবে।

সেই যুগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পূর্বে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এর প্রথা ছিল সমাজ-রাষ্ট্রে। বর্ণ বৈষম্য ও গোত্রীয় বৈষম্য ছিল আরবের একটি জঘন্যতম কালচার। গোত্রে গোত্রে সংঘাত ও কলহ দ্বন্দ্ব সবসময় লেগেই থাকত। তুচ্ছ কারণে কোনো বিবাদ সৃষ্টি হলে দুই-তিন বংশ পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ত। মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যেসব সামাজিক বৈষম্যের পাহাড় গড়ে ছিল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা পরিবর্তন করে পরিপূর্ণভাবে বিলুপ্ত করে দেন। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পরশ পাথর-তুল্য। তিনি তখনকার জীর্ণ-শীর্ণ, ঘুণেধরা সমাজকে আল্লাহতায়ালার সাজেশন অনুযায়ী সংস্কার করে কোরআনী সমাজ গড়ে তুলেছিলেন।

সাধের জন্মভূমি পরিত্যাগ করে মক্কা থেকে যখন হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াসরিবে পা রাখলেন। ইয়াসরিবের জনগণ তাঁকে অভূতপূর্ব পরিবেশে অত্যন্ত আবেগঘন আবহে স্বাগত জানালেন। ইয়াসরিব নগরীর চাবি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে শুধু প্রিয়তম ব্যক্তিরূপে আপন করে নিলেন তা-ই নয়; এই নগরীর পরিচালনার সব দায়িত্ব তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁর নেতৃত্ব অবনত মস্তকে স্বীকার করে নিলেন। এই স্বীকৃতির প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ইয়াসরিবের জনগণ তাদের প্রিয় নগরীর নামকরণ করলেন ‘মদিনাতুন্নবী’ অথবা ‘মদিনাতুর রাসুল’। এই নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে মসজিদে নববী। এই মসজিদই ছিল মদিনা রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃত্বের প্রাণকেন্দ্র। আইন প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দু এবং ন্যায়নীতির শীর্ষস্থান ও বিচার বিভাগের শীর্ষস্থান। মদিনা রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল মদিনা সনদ। সম্মিলিত লিখিত সংবিধান। এর ভূমিকায় সনদকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘কিতাব’রূপে। এর আধুনিক অর্থ সংবিধান। প্রকৃত প্রস্তাবে মদিনা সনদ ছিল একটি সংবিধান এবং মানবসভ্যতার ইতিহাসে এটাই হলো সর্বপ্রথম লিখিত পূর্ণাঙ্গ সংবিধান। পাশ্চাত্যের প্রচারণায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অজ্ঞতায় এবং মুসলিম পণ্ডিতদের উদাসীনতার ফলে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা জানে, আমেরিকার সংবিধানই সমগ্র বিশ্বে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ১৭৮৯ সালের প্রায় এক হাজার ১৫০ বছর আগেই রচিত হয়েছে মদিনা সনদ।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক রাষ্ট্রনায়ক। শ্রেষ্ঠতম প্রজ্ঞায় বিভূষিত একজন জননেতা। যদি তিনি চাইতেন তিনি হতে পারতেন পরম পরাক্রমশালী সম্রাট। হতে পারতেন প্রবল প্রতাপান্বিত বাদশাহ। মহামহিম সুলতান। আর তখনকার বিশ্বে এটিই ছিল নিয়ম। সূচনা করতে পারতেন রোমান সম্রাটদের অথবা পারস্য সম্রাটের মতো অথবা চীনের রাজাধিরাজের মতো, মিসরের ফেরাউনদের মতো করতে এক পারিবারিক ধারা (ফুহধংঃরপ ষরহব)। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন দুনিয়ার এইসব ক্ষমতালিপ্সা, ভোগ-বিলাস, যশ, প্রতিপত্তির ঊর্ধ্বে। তাঁকে কখনো এসব দুনিয়াবী ব্যাপার আকৃষ্ট করেনি।

রাজনীতিকেরা সবসময় বর্তমানকালেই বসবাস করেন। তাদের দৃষ্টি থাকে ক্ষমতার দিকে এবং ক্ষমতাপ্রসূত সুযোগ-সুবিধা অথবা বৈভব-প্রভাবের দিকে। দৃষ্টি থাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অথবা পারিবারিক পর্যায়ে বিলাসিতার দিকে। আল্লাহর রাসূল হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়ক। বর্তমানে বসবাস করেও তিনি দৃষ্টি রেখেছিলেন মানবজাতির ভবিষ্যতের দিকে। মানবজাতির ঐক্য ও সংহতির দিকেই তিনি দৃষ্টি রেখেছিলেন। দৃষ্টি দিয়েছিলেন তাদের পরিপূর্ণ জীবনের দিকে, তাদের ইহলোক ও পরলোকের সম্পূর্ণতার দিকে।

মদিনা রাষ্ট্র বিশ্বময় মাথা তুলে স্থিতিশীলতার আশীর্বাদ নিয়ে সমৃদ্ধি ও শান্তিপূর্ণ অবস্থার সম্পদকে মূলধন করে বিশ্বজয়ী হয়ে উঠে সেই মদিনা রাষ্ট্র। অথচ সপ্তম শতাব্দীতে রাষ্ট্র গঠনের আগে মদিনার অবস্থা ছিল অনেকটা নৈরাজ্যপূর্ণ। ওই সময় মদিনায় ছিল সুসংগঠিত আদি পৌত্তলিক সমপ্রদায়। ছিল দেশি ও বিদেশি ইহুদি জনগোষ্ঠী। তারপরে আসেন মক্কা থেকে হিযরত করে নব্য মুসলিমরা। প্রত্যেক ইতিহাসবিদ এ কথা অত্যন্ত জোরে প্রচার করেছেন যে, তখনকার আরব সমাজ ছিল গোত্র-গোষ্ঠীতে খণ্ডবিখণ্ড, শতধাবিভক্ত ও ওইসব গোত্র-গোষ্ঠী-উপজাতি সব সময় লিপ্ত ছিল পারস্পরিক দ্বন্দ্বে, হিংসা-বিদ্বেষ, অসূয়াতাড়িত প্রতিহিংসার জিঘাংসায়। সমাজে ছিল না কোনো ঐক্যবোধ, ছিল না সহানুভূতি অথবা সহযোগিতার কোনো সূত্র। সংক্ষেপে প্রাক-ইসলাম আরবে সমাজজীবন ছিল ‘নিঃসঙ্গ, দীন, কদর্য, পশুতুল্য এবং স্বল্পায়ু’। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সৃজনশীল নেতৃত্বে এবং সীমাহীন আন্তরিকতায় সেই খণ্ডবিখণ্ড শতধাবিভক্ত সমাজজীবনের অফুরন্ত কল্যাণকামী প্রবাহের সৃষ্টি হয়ে তা পরে ৭০০ বছর ধরে স্থায়ী হয়ে বিশ্বের চিন্তা-ভাবনাকে আলোকিত করে রাখে। সৃষ্টি করে নতুন নতুন সৃষ্টির প্রাণ, যা অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি।

মদিনা রাষ্ট্র শুধু মুসলমানদের রাষ্ট্র নয়। এই রাষ্ট্র সব ধর্ম ও সমপ্রদায় নির্বিশেষে সবার। মুসলমান ও ইহুদির। আদি পৌত্তলিক ও অমুসলিমদের। যে যার ধর্ম অনুসরণ করবে কিন্তু জাতি হিসেবে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সবাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর প্রতিরক্ষায় সবাই কৃতসঙ্কল্প। জাতীয়তার প্রকৃতি বিশ্লেষণকারী হাজারো তাত্ত্বিক আজ পর্যন্ত যেসব জটিল ক্ষেত্রে কোনো সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হননি, বিভ্রান্তির চোরাবালিতে পথ হারিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে মদিনা সনদের ভিত্তিতে গড়ে উঠা রাষ্ট্রটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়কের নেতৃত্বে কীভাবে সহজ ও সরল পথে পথপরিক্রমা শুরু করেছিল তা আজো সবাই বিস্ময়াভিভূত হয়ে পর্যালোচনা করে থাকেন। আধুনিক জাতীয়তার যেমন রয়েছে আকর্ষণীয় এক সম্মিলনের স্বর্ণসূত্র, অন্য দিকে তেমনি রয়েছে বিভাজনের এক প্রবণতা। কিছুসংখ্যক জনসমষ্টি একত্র হয়ে যেমন জাতি গঠন করে। তেমনি জাতি হিসেবে তারা বিশ্ব মানবসমপ্রদায় থেকে স্বাতন্ত্র্য অনুভব করে বিচ্ছিন্ন হয়েও পড়ে। মদিনা রাষ্ট্রটি কিন্তু একক উম্মাহ দেয়াল ডিঙিয়ে ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে রীতিনীতি ও সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সব বাধা-বন্ধনকে জয় করে, বিশ্বময় উম্মাহর পথ প্রশস্ত করেছে। যে চুক্তির ভিত্তিতে মদিনা রাষ্ট্রের জন্ম হয়, সেই চুক্তিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বাক্ষর করেন একজন জননেতারূপে সততার মূর্তরূপ জনকল্যাণকামী এক পরিপূর্ণ মানুষরূপে।

মুসলিম বিশ্বে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রের আদর্শ সার্বিকভাবে বাস্তবায়িত হলে মানবজাতি উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারত। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের বিশেষজ্ঞ ও পর্যালোচকদের চোখে মদিনা রাষ্ট্রের গৌরবজনক বৈশিষ্ট্যগুলো সঠিকভাবে ধরা পড়েনি। আমাদের পণ্ডিতদের মনোযোগও এসব বিষয়ে তেমনভাবে আকৃষ্ট হয়নি। আমরা তাই নিজেদের স্বর্ণের খনিকে উপেক্ষা করে অন্যদের কয়লা খনির মূল্য নির্ধারণেই অধিক ব্যস্ত রয়েছি এবং হীনম্মন্যতার শিকার হয়েছি। এই হীনম্মন্যতা জয় করতেই হবে। মানবজাতির শিক্ষক এই মহামানবের রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পর্যালোচনার আগে তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ও অত্যন্ত সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। হেরাগুহায় তাঁর ধ্যানমগ্নতা। তারপর বাস্তবতার জগতে তাঁর প্রত্যাবর্তন। এক কথায়-পরমার্থিকতা এবং যুক্তির তথা আধ্যাত্মিকতা ও কর্মনিষ্ঠার সুষ্ঠু সমন্বয়। এক দিকে যেমন তার জীবনের সৌন্দর্য, তেমনি ইসলামের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদান। মরমিবাদ দিয়ে যার শুরু, রাষ্ট্রের মধ্যে তার পরিপূর্ণতা। এই তো মানবজীবনের সারবত্তা। এই সারবত্তার মূর্ত রূপ হলেন আদর্শ মানব হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন। এক অর্থে, এ তো এক পরশমণি। এর স্পর্শে সব কিছুই স্বর্ণ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব যে অসাধারণ তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, মুসলিম বিশ্ব এই পরশমণির স্পর্শ থেকে আজ দূরে। যে কোনোভাবেই হোক মুসলমানদের এই পরশমণির স্পর্শ লাভ করতেই হবে। তাহলেই সম্ভব হবে আমাদের জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রকে শান্তির আলোয় আলোকিত করতে।

লেখক :মিনহাজ উদ্দিন

ইমাম, খতিব ও ইসলামী আলোচক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads