• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

বেহেশতের নাম ও পরিচয়

  • প্রকাশিত ১৩ ডিসেম্বর ২০২০

আবদুল্লাহ শাকের

 

একজন মুমিনের শেষ ঠিকানা, আকাঙ্ক্ষিত আলয়, স্বপ্নের নিবাস, ভাবনার আবাস ও সুখের নীড় হচ্ছে একমাত্র জান্নাত। মহিমের দিদার-দর্শন। কোরআন এবং হাদিসে ছড়ানো আছে জান্নাতের নাম পরিচয়। চিরপ্রার্থিত বিষয় জানার জন্যে এসব নাম তুলে ধরছি এখানে।

 

জান্নাতুল ফিরদাউস : এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে, তাদের অভ্যর্থনার জন্য রয়েছে ফিরদাউসের উদ্যান। সেথায় তারা স্থায়ী হবে। এর পরিবর্তে তারা অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হওয়া কামনা করবে না।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত-১০৭, ১০৮) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-‘তারাই হবে উত্তরাধিকারী। উত্তরাধিকারী হবে ফিরদাউসের। যাতে তারা চিরস্থায়ী হবে।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত-১১) হযরত আনাস (রা.) বলেন, উম্মে রুবাইয়ে বিনতে বারা যিনি হারেছা ইবনে সুরাকার মা, তিনি নবীজির কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে হারেছা সম্পর্কে কিছু বলবেন না? সে বদরের দিন খুন হয়েছিল। যদি সে জান্নাতি হয় তাহলে ধৈর্যধারণ করব। না হয় তার জন্যে মনভরে অত্যধিক কান্নাকাটি করব। তিনি বললেন, হে হারেছার মা! জান্নাতের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের জান্নাত আছে। তোমার ছেলে সর্বোচ্চ ফিরদাউস (জান্নাতে) পৌঁছে গেছে। (সহিহ বুখারি)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জান্নাতে অবশ্যই একশটি দারজাহ (মর্যাদা) রয়েছে, যা আল্লাহ তাঁর পথে জিহাদকারীর জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। দুটি দারজাহর মধ্যবর্তী ব্যবধান আসমান ও জমিমের মতো। সুতরাং তোমরা (জান্নাত) চাইলে ফিরদাউস চাও। কেননা, তা হলো জান্নাতের মধ্যভাগ ও জান্নাতের উপরিভাগ। আর তার ওপরে রয়েছে রহমানের আরশ। (বুখারি, হাদিস নং-২৭৯০)

জান্নাতু আদন : আদন মানে চিরস্থায়ী। এটি একটি সুখদ উদ্যান। এ জান্নাত সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন-‘ওটা (আদন) স্থায়ী জান্নাত যাতে তারা প্রবেশ করবে, যার তলদেশে নদী প্রবাহমান। তাতে তারা যা কিছু কামনা করবে, তাদের জন্য তাই থাকবে, এভাবেই আল্লাহ সাবধানীদেরকে পুরস্কৃত করেন।’ (সুরা নাহল, আয়াত-৩১) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী (আদন) জান্নাত; যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেথায় তাদেরকে স্বর্ণ-কঙ্কনে অলঙ্কৃত করা হবে। তারা পরিধান করবে সূক্ষ্ম ও স্থুল রেশমের সবুজবস্ত্র ও সমাসীন হবে সুসজ্জিত আসনে। কত সুন্দর সে পুরস্কার ও কত উত্তম সে শরণস্থল!’ (সুরা কাহাফ, আয়াত-৩১) আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা প্রবেশ করবে স্থায়ী (আদন) জান্নাতে যেখানে তাদের স্বর্ণনির্মিত কঙ্কন ও মুক্তো দ্বারা অলঙ্কৃত করা হবে এবং যেখানে তাদের পোশাক পরিচ্ছদ হবে রেশমের।’ (সুরা ফাতির, আয়াত-৩৩) আল্লাহতায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘সেই স্থায়ী (আদন) জান্নাত যার প্রতিশ্রুতি পরম দয়াময় অদৃশ্যভাবে দিয়েছেন। নিশ্চয় তার প্রতিশ্রুত বিষয় অবশ্যম্ভাবী।’ (সুরা মারিয়াম, আয়াত-৬১) এছাড়াও আরো বহু আয়াতে এ জান্নাতের কথা উল্লিখিত হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বপ্নে আদন জান্নাত দর্শন করেছেন। (বুখারি) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া বলেছেন, ‘দুটো জান্নাত চাদির তার পাত্র ও সবকিছু চাদির। দুটো জান্নাত সোনার তার পাত্র ও সবকিছু সোনার। আদন জান্নাতে (জান্নাতি) লোকেদর দিদার ও তাদের প্রতিপালকের মাঝে কেবল তার চেহারার ওপর গৌরবের চাদর থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

 

জান্নাতুল খুলদ : খুলদ মানে চিরস্থায়ী। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ওদেরকে জিজ্ঞাসা কর এটাই শ্রেয় না (খুলদ) স্থায়ী বেহেশত। যার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সাবধানীদেরকে? এটিই তো আজর ও প্রত্যাবর্তনস্থল।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত-১৫) সাহাবি ইবনে মাসউদ দোয়ায় বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অটল-অনঢ় ঈমান চাই, অফুরান নেয়ামত চাই এবং জান্নাতুল খুলদের সর্বোচ্চে নবীজির সঙ্গ চাই।’ (সি. সহিহাহ, হাদিস নং-২৩০)

 

জান্নাতুন নাইম : নাইম মানে নেয়ামতের প্রাচুর্য। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস করেছে এবং ভালো কাজ করেছে তাদের প্রতিপালক তাদের বিশ্বাসের কারণে তাদেরকে পথ প্রদর্শন করবেন, শান্তির উদ্যানসমূহে তাদের (বাসস্থানের) তলদেশ দিয়ে নদীমালা প্রবাহিত থাকবে। (সুরা ইউনুস) আল্লাহতায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদের জন্য আছে (জান্নাতুন নাইম) সুখের উদ্যানরাজি।’ (সুরা লুকমান, আয়াত-৮) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহভীরুদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই ভোগ-বিলাসপূর্ণ জান্নাত রয়েছে।’ (সুরা কলম, আয়াত-৩৪) হজরত ইব্রাহীম (আ.) এই জান্নাত চেয়ে দোয়া করে বলেছিলেন, ‘আমাকে সুখকর (নাঈম) জান্নাতের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর।’(সুরা শুয়ারা, আয়াত-৮৫)

 

জান্নাতুল মাওয়া : মাওয়া মানে ঠিকানা। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা বিশ্বাস করে, সৎকাজ করে তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ তাদের  জন্য রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া।’ (সুরা সাজদাহ, আয়াত- ১৯) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহার নিকট। যার নিকট অবস্থিত (জান্নাতুল মাওয়া) বাসোদ্যান।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৩-১৫)

 

জান্নাতে দারুস সালাম : দারুস সালাম মানে শান্তিনিকেতন। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের জন্য রয়েছে (দারুস সালাম) শান্তির আলয় এবং তারা যা করত, তার কারণে তিনি হবেন তাদের অভিভাবক।’ (সুরা আনআম, আয়াত-১২৭) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ (মানুষ)কে (দারুস সালাম) শান্তির আবাসের দিকে আহ্বান করেন এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রদর্শন করেন।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত-২৫)

 

জান্নাতে দারুল মুকামাহ : দারুল মুকামাহ মানে স্থায়ী। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যিনি নিজ অনুগ্রহে, আমাদেরকে (দারুল মুকামাহ) স্থায়ী আবাস দান করেছেন। যেখানে আমাদেরকে কোনো প্রকার ক্লেশ স্পর্শ করে না এবং স্পর্শ করে না কোনো প্রকার ক্লান্তি।’ (সুরা ফাতির, আয়াত-৩৫)

 

জান্নাতে রাইয়ান : রাইয়ান মানে তৃষ্ণাহীন। তৃষ্ণা ও পিপাসায় যারা কষ্ট পেয়েছে, তাদেরকে এই জান্নাত দেওয়া হবে। এ জান্নাত সম্বন্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘জান্নাতের এক প্রবেশদ্বার রয়েছে, যার নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন ওই দ্বার দিয়ে রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া আর কেউই ওই দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে না। রোজাদারগণ প্রবিষ্ট হয়ে গেলে দ্বার রুদ্ধ করা হবে। ফলে সে দ্বার দিয়ে আর কেউই প্রবেশ করবে না।’  (বুখারি, হাদিস নং-১৮৯৬, মুসলিম, হাদিস নং- ১১৫২)

 

জান্নাতে আদদারুল আখিরাহ : আদদারুল আখিরাহ মানে পরকালের আবাস। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর পার্থিব জীবনতো ক্রীড়া-কৌতুক বৈ আর কিছুই নয় এবং যারা সাবধানতা অবলম্বন করে, তাদের জন্য (আদদারুল আখিরাহ) পরকালের আবাসই শ্রেয়। তোমরা কি তা অনুধাবন কর না? (সুরা আনআম, আয়াত- ৩২) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘এটাতো (আদদারুল আখিরাহ) পরকালের আবাস। যা আমি নির্ধারিত করি তাদেরই জন্য যারা এ পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। সাবধানীদের জন্য শুভ পরিণাম।’ (সুরা কাসাস, আয়াত-৮৩)

 

জান্নাতে দারুল হায়াওয়ান : দারুল হায়াওয়ান মানে চিরজীবনের ঘর। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এ পার্থিব জীবনতো খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর পারলৌকিক জীবনই তো (হায়াওয়ান) প্রকৃত জীবন। যদি ওরা জানত।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত-৬৪)

 

জান্নাতে দারুল কারার : দারুল কারার মানে স্থায়ীগৃহ। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার সমপ্রদায়! এ পার্থিব জীবনতো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু। আর নিশ্চয় পরকাল হচ্ছে (দারুল কারার) চিরস্থায়ী আবাস।’ (সুরা মুমিন, আয়াত- ৩৯)

 

জান্নাতে আল-মাকামুল আমীন : আল-মাকামুল আমীন মানে নিরাপদ স্থান। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় মুত্তাকীগণ থাকবে (মাকামে আমীন) নিরাপদ স্থানে।’ (সুরা দুখান, আয়াত-৫১)

 

জান্নাতে মাকয়াদু সিদক : মাকয়াদু সিদক মানে যথাযোগ্য আসন। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন, ‘সাবধানীরা থাকবে জান্নাতে ও নহরে। (মাকয়াদু সিদক) তথা যথাযোগ্য আসনে। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী সম্রাটের সান্নিধ্যে।’ (সুরা কামার, আয়াত-৫৫)

 

জান্নাতে তুবা : তুবাও একটি জান্নাতের নাম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ওই বান্দার জন্য তুবা, যে আল্লাহর পথে নিজের ঘোড়ার লাগাম ধরে প্রস্তুত আছে। যার মাথার কেশ আলুথালু, যার পদযুগল ধূলিমলিন। তাকে পাহারার কাজে নিযুক্ত করলে, পাহারার কাজে নিযুক্ত থাকে। আর তাকে সৈন্যদলের পশ্চাতে (দেখাশোনার কাজে) নিয়োজিত করলে, সৈন্যদলের পশ্চাতে থাকে। যদি সে কারো সাক্ষাতের অনুমতি চায়, তাহলে তাকে অনুমতি দেওয়া হয় না এবং কারো জন্য সুপারিশ করলে, তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না।’  (বুখারি, হাদিস নং-২৮৮৭)

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads