• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম

  • প্রকাশিত ১৪ ডিসেম্বর ২০২০

এম জহিরুল ইসলাম

 

 

মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মাতৃভূমি ও জন্মস্থানের প্রতি মানুষের এ দুর্নিবার আকর্ষণ বা ভালোবাসা, ভালো লাগা, গভীর আবেগ-অনুভূতি ও মমত্ববোধকে বলে দেশপ্রেম। দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে হলে স্বদেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানুষের উচিত দেশকে ভালোবাসা। যে ব্যক্তি দেশকে ভালোবাসে না, সে প্রকৃত ইমানদার নয়।’ দেশের প্রতি ভালোবাসা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় দেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। কোনো দেশ বা ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারলে মান-সম্মান, স্বাধিকার, ঈমান ও আমল হিফাজত করা অসম্ভব। এজন্য ধর্মীয় দৃষ্টিতে স্বদেশপ্রেমের গুরুত্ব অত্যধিক। দেশ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে কোরআনুল কারীমে এসেছে, ‘আমি আমার রাসুলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ পাঠিয়েছি এবং তাঁদের সঙ্গে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি নাজিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচণ্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ জেনে নেবেন কে না দেখে তাঁকে (আল্লাহকে) ও তাঁর রাসুলগণকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।’ (সুরা আল হাদীদ, আয়াত- ২৫)

শাসকের কর্তব্য : মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে তারা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত।’ (সুরা আল হজ্ব, আয়াত- ৪১) এ আয়াতে একজন দেশপ্রেমিক শাসকের জন্য প্রধান চারটি কাজ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ১. নামাজ কায়েম। ২. জাকাত আদায়। ৩. সত্য ও ন্যায়ের নির্দেশ। ৪. অসত্য ও অন্যায় থেকে নিজে বিরত থাকা এবং অন্যকে বিরত রাখা।

দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত মহানবী (সা.) : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর কোরআন নাজিল করার মাধ্যমে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পিত হলে তিনি তার স্বদেশ মক্কার জনগণকে এ দীনের দাওয়াত দিতে থাকলেন। অথচ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতে স্বদেশের জনগণের মধ্য থেকে মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া বাকিরা প্রত্যাখ্যান করে উল্টো এ মহৎ কাজে বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে স্বদেশী বর্বর আবু জাহেলরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর দাওয়াত কবুলকারী সাহাবিদের ওপর অত্যাচার শুরু করে এমনকী তাঁর প্রাণনাশে বদ্ধপরিকর হয়। মক্কাবাসীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সেখান থেকে মদিনায় হিজরতের সময় স্বীয় জন্মভূমির প্রতি তিনি বার বার ফিরে তাকান এবং কাতর কণ্ঠে বলেন, ‘মক্কা আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় দেশ, যদি কাফেররা আমাকে বের করে না দিত তবে আমি বের হতাম না।’

সাহাবায়ে কেরামের দেশপ্রেম : স্বদেশকে ভালোবাসতেন সাহাবি কেরাম (রা.)। হিজরতের সময় মদিনায় যাওয়ার পর আবু বকর (রা.) ও বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হলেন। তখন তাদের মনেপ্রাণে স্বদেশ মক্কার স্মৃতি চিত্র ভেসে ওঠেছিল। সে সময় তারা মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি শুরু করলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের মনের এ দুরবস্থা দেখে প্রাণভরে  দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি তার চেয়ে বেশি মদিনার ভালোবাসা আমাদের অন্তরে দান কর।’ স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ওমরা পালনের জন্য মক্কায় রওয়ানা দেন তখন সাহাবিরা স্বদেশের কথা স্মরণ করে আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছিলেন। ৮ম হিজরিতে বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং অতীত অত্যাচার ও নির্যাতনের কথা ভুলে গিয়ে দেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। বিশ্বে দেশপ্রেমের উদারতা আর মহানুভবতার নিদর্শন রাখলেন। আল্লাহর নবী ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের ক্ষেত্রে যা করেছিলেন। তিনি বললেন, ‘আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত-৯২)

দেশপ্রেম সফলতার চাবিকাঠি : জীবনে সফলতা অর্জন প্রত্যেকেরই লক্ষ্য থাকে, আর সে সফলতা বিভিন্ন উপায়ে অর্জন করা যায়, তন্মধ্যে দেশপ্রেম একটি সফলতা অর্জনের মাধ্যম। আল্লাহরাব্বুল আলামীন বলেন, ‘হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য ধারণ করো এবং মোকাবিলায় (সীমান্ত প্রহরা এবং যুদ্ধের প্রস্তুতিতে) দৃঢ়তা অবলম্বন করো। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্যলাভে (সফলতা অর্জনে) সমর্থ হতে পার।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-২০০)

দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব : দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। প্রধান কর্তব্য হচ্ছে-রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখা, রাষ্ট্রের সংবিধান, প্রচলিত আইন ও বিধি মেনে চলা, রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ‘কর’ আদায়ে সচেষ্ট থাকা, নাগরিকের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা, নিজস্ব কৃষ্টি ও মূল্যবোধ চর্চা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করা।  দেশপ্রেমের আরো কিছু  বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচনা করা হলো-

১. মানবতাবাদী হওয়া : একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হতে পারেন একজন প্রকৃত মানবতাবাদী। আর মানবতা ছাড়া মাতৃভূমির মূল্য নেই। তাই একজন দেশপ্রমিক কবির আহজারি, ‘জিস বাগ মে ফুল নেহী, উনসে কিয়া কাম হায়/ জিস ওয়াতান সে ইনসানিয়াত নেহী, উস সে কিয়া কাম হায়’। অর্থ: যে বাগানে ফুল নেই সে বাগানের কী প্রয়োজন! যে মাতৃভূমিতে মানবতা নেই সে মাতৃভূমি কী প্রয়োজন!’। একজন প্রকৃত ধর্মানুসারী ব্যতীত সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হওয়া অসম্ভব। তাই ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ মানুষকে স্বদেশ রক্ষায় উদ্ধুদ্ধ করে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক যিনি স্বদেশের কল্যাণে সদা নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। কারণ স্বদেশকে হেফাজত করতে না পারলে ধর্মকে হেফাজত করা যায় না, দেশের মানুষ ও তাদের স্বার্থকে সংরক্ষণ করা যায় না।

২. দেশের সম্পদ রক্ষা করা : একজন দেশপ্রেমিক দেশের সাধারণ মানুষকে স্বদেশের উন্নতি সাধনে সজাগ রাখে, দেশের জাতীয় সম্পদ অপচয় রোধে উদ্ধুদ্ধ করে। আর দেশাত্মবোধ ছাড়া কোনো দেশের স্বাধীনতা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না।

৩. প্রকৃতি রক্ষায় সচেতন হওয়া : দেশের রূপ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু ও প্রতিবেশ  সুরক্ষায় একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অহেতুক গাছপালা কর্তন, জনগণের চলার পথে প্রবাহমান পানিতে মলমূত্র ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বনায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া বলেন, ‘কিয়ামত হয়ে যাবে এটা যদি আগেভাগে অনুমান করতে পারো, তাহলে হাতে রক্ষিত গাছের চারা রোপণ করে দাও।’

৪. দেশ রক্ষায় প্রস্তুত থাকা : আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আর প্রস্তুত করো তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের ওপর এবং তোমাদের শত্রুদের ওপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যদের ওপর ও যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। বস্তুত যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাহে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোনো হক অপূর্ণ থাকবে না।’ (সুরা আল আনফাল, আয়াত-৬০)

জাতীয় অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষায় রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেওয়া নফল ইবাদতের চেয়েও বেশি সওয়াব। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘লাইলাতুল কদরের  চেয়ে আরো একটি পুণ্যময় রাতের খবর তোমাদের দেব কি?’ সাহাবারা জবাব দেন, ‘বলুন ইয়া রাসুলাল্লাহ!’ তিনি (সা.) বললেল, ‘কোনো সৈনিক রাতে এমন কোনো কঠিন ভীতিপ্রদ চৌকিতে দাঁড়িয়ে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে; যে কোনো মুহূর্তে শত্রু উদ্ধত অস্ত্রের আঘাতে তার বক্ষ বিদীর্ণ হতে পারে এবং জীবনে আর স্ত্রী-সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ নাও আসতে পারে, সে রজনী লাইলাতুল কদরের চেয়েও বেশি বরকতপূর্ণ।’ আসুন, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা দেশপ্রেমের চেতনায় অক্ষুণ্ন রাখি। বিজয়কে সমুন্নত রাখি এবং নিজেদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হই।

 

লেখক : আলেম, সাংবাদিক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads