• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

রাগ সংবরণের গুরুত্ব ও উপায়

  • প্রকাশিত ২৫ ডিসেম্বর ২০২০

মুহাম্মাদ আবু আখতার

 

 

 

রাগের সময় মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাই এ অবস্থায় খুব সহজেই বিভিন্ন ধরনের অন্যায় কাজ সংঘটিত হয়। পৃথিবীতে মানুষ জেনে শুনে যত ভুল করে তার অধিকাংশই সাধারণত রাগের বশে করে থাকে। রাগ মানুষের একটা স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। তাই রাগকে পুরোপুরি দমন করা হয়তো সম্ভব নয়। তবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করা অসম্ভব কিছু নয়। তাই কখনো মানুষের মনে রাগ এলেও তা সংবরণ করার চেষ্টা করা আবশ্যক। ইসলাম রাগ সংবরণ করার ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। শুধু তা-ই নয়, কীভাবে রাগ সংবরণ করতে হয় তার কার্যকর কিছু উপায় সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দিয়েছে। 

ইসলাম মানুষকে পারতপক্ষে রাগ না করার জন্য জোর নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে রাগ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল, ‘আপনি আমাকে অসিয়ত করুন।’ তিনি বললেন, ‘তুমি রাগ করো না।’ লোকটি কয়েকবার তা বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক বারই বললেন, ‘রাগ করো না’ (সহিহ বুখারি : ৬১১৬)। ইসলামে রাগ করা একেবারেই যে নিষেধ ব্যাপারটি এমন নয়। রাসুলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাঝে মাঝে রাগান্বিত হতেন। তবে তিনি সাধারণত নিজের জন্য রাগ করতেন না। তার রাগের মধ্যেও অন্যের প্রতি কল্যাণকামিতা ও ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যেতো। আবু মাসউদ আনসারী (রা.) বলেন, ‘একদা জনৈক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি নামাজে (জামায়াতে) শামিল হতে পারি না। কারণ অমুক ব্যক্তি আমাদের নিয়ে খুব দীর্ঘ নামাজ আদায় করেন।’ আবূ মাসউদ (রা.) বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোন নসিহতের মজলিসে সেদিনের তুলনায় অধিক রাগান্বিত হতে দেখিনি। (রাগত স্বরে) নবীজি বললেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা মানুষের মধ্যে বিরক্তি সৃষ্টি করে থাকো। অতএব যে লোকদের নিয়ে নামাজ আদায় করবে সে যেন সংক্ষেপ করে। কারণ তাদের মধ্যে রোগী, দুর্বল ও কর্মব্যস্ত লোকও থাকে’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯০)।

রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কোনো কাজ নয়। সবাই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এর জন্য অনেক ধৈর্য ও সাহসের প্রয়োজন হয়। এজন্য যারা রাগ সংবরণ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রশংসা করেছেন। তিনি এক হাদিসে তাদেরকে সত্যিকার বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রকৃত বীর সে নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়। বরং সেই আসল বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে’ (সহিহ বুখারি: ৬১১৪)।

ইসলামে রাগ সংবরণের অনেক ফজিলত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে মুত্তাকীদের বিভিন্ন গুণাবলির কথা বর্ণনা করেছেন এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর ওয়াদা করেছেন। রাগ সংবরণ করা এসব গুণাবলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও। যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে। বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন’ (সুরা আল ইমরান : ১৩৩, ১৩৪)। যারা রাগ প্রয়োগের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অন্যের ওপর জুলুম করা হতে নিজেদেরকে সংযত রাখে, তাদের জন্য হাদিসে বিশেষ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাঁর রাগ প্রয়োগের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সংযত থাকে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সৃষ্টিকুলের মধ্য থেকে ডেকে নেবেন এবং তাকে হুরদের মধ্য থেকে তাঁর পছন্দমতো যে কোনো একজনকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেবেন’ (আবু দাউদ : ৪৭৭৭)।

আল্লাহর পথে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার মতো ফজিলতপূর্ণ নেক আমলও যদি রাগের বশবর্তী হয়ে করা হয় তাহলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। জিহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করা। হজরত আবু মুসা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর পথে যুদ্ধ কোনটি, কেননা আমাদের কেউ লড়াই করে রাগের বশবর্তী হয়ে, আবার কেউ লড়াই করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। তিনি তার দিকে মাথা তুলে তাকালেন। বর্ণনাকারী বললেন, নবীজির মাথা তোলার কারণ ছিল, সে ছিল দাঁড়ানো। অতঃপর নবীজি বললেন : ‘আল্লাহর বাণী বিজয়ী করার জন্য যে যুদ্ধ করে তার লড়াই আল্লাহর পথে হয়’ (সহিহ বুখারি : ১২৩)।

হাদিসে রাগ সংবরণ করার কার্যকর কিছু উপায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো। অর্থাৎ দাঁড়ানো অবস্থায় থাকলে বসে পড়া এবং বসা অবস্থায় থাকলে শুয়ে পড়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কারো যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগের উদ্রেক হয় তাহলে সে যেন বসে পড়ে। এতে যদি তার রাগ দূর হয় তো ভালো, অন্যথায় সে যেন শুয়ে পরে’ (আবু দাউদ : ৪৭৮২)।

রাগ সংবরণের আরেকটি কার্যকর উপায় হলো অজু করা। হজরত আবু ওয়াইল আল-কাস (রহ.) বলেন, ‘একদা আমরা উরওয়াহ ইবনু মুহাম্মাদ আস-সা’দীর কাছে গেলাম। তখন এক ব্যক্তি তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে তাকে রাগিয়ে দিল। অতএব তিনি দাঁড়ালেন এবং অজু করলেন। অতঃপর বললেন, ‘আমার পিতা আমার দাদা আত্বিয়্যাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন, ‘রাগ হচ্ছে শয়তানি প্রভাবের ফল। শয়তানকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আগুন পানি দিয়ে নেভানো যায়। অতএব তোমাদের কারো রাগ হলে সে যেন অজু করে নেয়’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৮৪)। রাগ যেহেতু শয়তানের পক্ষ থেকে আসে, তাই রাগের সময় শয়তানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা কর্তব্য। কেননা পবিত্র কোরআনে শয়তানের কুমন্ত্রণা অনুভব করলে আল্লাহতায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি শয়তানের পক্ষ থেকে আপনি কিছু কুমন্ত্রণা অনুভব করেন, তবে আল্লাহর শরণাপন্ন হোন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সুরা ফুসসিলাত : ৩৬)।

হজরত সুলাইমান ইবনে সুরাদ (রা.) বলেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন দুজন লোক গালাগালি করছিল। তাদের একজনের চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল এবং তার রগগুলো ফুলে গিয়েছিল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমি এমন একটি দোয়া জানি, যদি এ লোকটি পড়ে তবে তার রাগ দূর হয়ে যাবে। সে যদি পড়ে “আ’উজুবিল্লাহি মিনাশ শায়তান’- আমি শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। তবে তার রাগ চলে যাবে’ (সহিহ বুখারি : ৩২৮২)।

অনেক সময় পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া হলে একপর্যায়ে উভয় পক্ষের রাগ চরমে ওঠে। এ সময় রাগ নিয়ন্ত্রণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হলো চুপ থাকা কিংবা প্রতিপক্ষের সামনে থেকে চলে যাওয়া। এ সম্পর্কিত শিক্ষণীয় একটি ঘটনা হাদিসে বর্ণিত আছে। হজরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (রহ.) বলেন, ‘একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিদের নিয়ে বসা ছিলেন। এ সময় এক লোক আবু বাকর (রা.)-কে গালি দিল এবং কষ্ট দিল। কিন্তু আবু বাকর (রা.) কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলেন। অতঃপর পুনরায় সে আবু বাকর (রা.)-কে গালি দিল এবং কষ্ট দিল, কিন্তু তিনি কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলেন। তৃতীয়বার সে আবু বাকর (রা.)-কে গালি এবং কষ্ট দিলে এবার তিনি তার প্রতিশোধ নিলেন। আবু বাকর (রা.) যখন প্রতিশোধ নিলেন তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে দাঁড়ালেন। আবু বাকর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আসমান থেকে একজন ফেরেশতা নেমেছিলেন এবং তোমার পক্ষ হয়ে জবাব দিচ্ছিলেন। কিন্তু যখন তুমি তার প্রতিশোধ নিলে তখন শয়তান এখানে উপস্থিত হয়েছে। শয়তান এখানে উপস্থিত হওয়ায় আমি আর বসতে পারি না (আবু দাউদ : ৪৮৯৬)। রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য উল্লেখিত প্রতিটি উপায় অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও ফলপ্রসূ। এসব উপায় অবলম্বন করে খুব সহজে রাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আল্লাহতায়ালা আমাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে দুনিয়া ও আখিরাতের অপরিসীম কল্যাণ লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক, ইসলামী কলাম লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads