• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ধর্ষণ প্রতিরোধে শরয়ী পোশাকের ভূমিকা

  • প্রকাশিত ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

মুহাম্মাদ আবু আখতার

 

 

 

ধর্ষণের প্রধান কারণ ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের মতামত প্রদান করে। ধর্ষণের প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে পুরুষের ভোগবাদী মানসিকতাকে দায়ী করে এবং ধর্ষণ প্রতিরোধে পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তনের উপদেশ দেয়। আবার অনেকে নারীর নিরাপত্তাহীনতাকে ধর্ষণের জন্য দায়ী মনে করে এবং নারীর নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কথা বলে। কেউ আবার ধর্ষকদের উপযুক্ত বিচার না হওয়াকে ধর্ষণের কারণ মনে করে এবং ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানায়। আবার কেউ নারীর অশালীন পোশাককে ধর্ষণের প্রধান কারণ মনে করে এবং শালীন পোশাক পরার উপদেশ দেয়। অনেকে আবার নৈতিক শিক্ষার অভাবকে ধর্ষণের প্রধান কারণ বলে মনে করে এবং নৈতিক শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বারোপ করার দাবি জানায়। এছাড়াও অনেকে অন্য কোনো কারণকে ধর্ষণের জন্য দায়ী করে এবং প্রতিকারের ভিন্ন উপায় সম্পর্কে মতামত দেয়।  আসলে ধর্ষণ প্রতিরোধে এসবের কোনোটির ভূমিকাকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে প্রত্যেকটিরই বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

কিন্তু আধুনিক যুগের ইসলামবিদ্বেষীরা ধর্ষণের জন্য অন্য সব কারণকে দায়ী মনে করলেও অশালীন পোশাককে ধর্ষণের কারণ হিসেবে স্বীকার করতে রাজি নয়। তারা ধর্ষণ প্রতিরোধে অন্য সব ব্যবস্থাকে স্বীকার করলেও এক্ষেত্রে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষবশতঃ শরীয়তসম্মত পোশাকের ভূমিকাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। পাশ্চাত্যের নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারায় চরমভাবে প্রভাবিত মুসলমান নামধারী ভার্সিটি পড়ুয়া এক ছেলের সাথে এ ব্যাপারে আমার কথা হয়েছিল।  তার মতে নারীদের পোশাক নির্বাচনে স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। আর ধর্ষণ প্রতিরোধে শরীয়তসম্মত পোশাকের ভূমিকাকে সে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে সে বেশ কিছু বাজে মন্তব্যও করেছে। সে বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে দাবি করছিল যে, ধর্ষণের জন্য অশালীন পোশাক নাকি ১%ও দায়ী নয়।

ধর্ষণের জন্য নারীদের অশালীন পোশাকই একমাত্র দায়ী নয় একথাটা অবশ্যই সত্য। ধর্ষণের পেছনে আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু ধর্ষণের জন্য অশালীন পোশাকের কোনো ভূমিকাই নেই এটা জঘন্যতম মিথ্যাচার। ব্যভিচার-ধর্ষণসহ যাবতীয় অশ্লীল কাজ প্রতিরোধে ইসলামী শরীয়ত শুধুমাত্র নারীদেরকে পর্দাসম্মত পোশাক পরিধান করার নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। এ ব্যাপারে ইসলামের আরো অনেক নির্দেশনা রয়েছে। নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি কুদৃষ্টিতে না তাকানো। বিয়ে বহির্ভূত অবৈধ প্রেমে না জড়ানো। ছেলে-মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করা। পরস্পরে নির্জনে একত্রিত না হওয়া। বেপর্দায় পরস্পর দেখা সাক্ষাত ও মেলামেশা না করা। গাইরে মাহরাম নারী-পুরুষের কর্মক্ষেত্র আলাদা করা। বেশি দূরের সফরে নিরাপত্তার জন্য মাহরাম পুরুষ সাথে রাখা। ব্যভিচার-ধর্ষণের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ইসলামের এসব নির্দেশনা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করলে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ খুব দ্রুত নির্মূল হবে ইনশাআল্লাহ। এসব নির্দেশনা অমান্য করে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ বন্ধ করার চিন্তা অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। যদি ইসলামের এসব নির্দেশনা না মেনে ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব হতো তাহলে ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে ধর্ষণের হার বেশি হতো না।

ধর্ষণের ক্ষেত্রে পোশাকের ভূমিকা অস্বীকার করার জন্য ইসলামবিদ্বেষীরা যে যুক্তি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে তা হচ্ছে পর্দা করা সত্ত্বেও মেয়েরা কেন ধর্ষণের স্বীকার হয়? তাদের এ ধরনের খোঁড়া যুক্তির পক্ষে তারা বিভিন্ন মাদরাসায় পর্দানেশীন মেয়েদের এবং শিশুদের ধর্ষণের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং শরীয়তের শর্তগুলো লঙ্ঘন করে বোরকা পরিধানকারীণিদের ধর্ষণের কিছু ঘটনা প্রমাণ হিসেবে পেশ করে। এর জবাবে প্রথম কথা হলো সব ধর্ষণের জন্য পোশাকই একমাত্র দায়ী নয় এটা তো আমরা অস্বীকার করি না। এসব ক্ষেত্রে অন্য কারণও থাকতে পারে। আর দ্বিতীয় কথা হলো শরীয়তের সবগুলো শর্ত মেনে পর্দা করে এমন নারী ধর্ষণের স্বীকার হওয়ার ঘটনা তেমন নেই বললেই চলে। আর এরকম কেউ দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো পাষণ্ড বর্বরের হাতে ধর্ষণের শিকার হলেও সেটা দুর্ঘটনা ও ব্যতিক্রমধর্মী বিরল ঘটনা। আর ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসেবে পেশ করা মূর্খতা। এছাড়া বেপর্দা নারী যত বেশি ধর্ষিতা হয় তাদের তুলনায় পর্দানেশীন নারীদের ধর্ষিতা হওয়ার হার খুবই নগণ্য। আর যেসব পর্দানেশীন নারী ধর্ষিতা হওয়ার খবর পত্রিকায় আসে সেগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদেরকে পর্দার শরয়ী শর্তগুলো সঠিকভাবে মেনে চলতে দেখা যায় না। কিন্তু ইসলামবিদ্বেষীরা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার খবর পেলেই তিলকে তাল বানিয়ে পর্দার বিপক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে।

যেসব মুসলিম দেশে মেয়েরা কঠোরভাবে পর্দা করে চলে সেসব দেশে ধর্ষণের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এটা প্রমাণিত সত্য। পক্ষান্তরে যেসব দেশে মেয়েরা বেপর্দায় চলে বিশেষভাবে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে ধর্ষণের হার অনেক বেশি। ইসলামবিদ্বেষীরা দাবি করে মুসলিম দেশগুলোতে ধর্ষণের অনেক ঘটনা গোপন করা হয়ে থাকে। কিন্তু পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ধর্ষণের কোনো ঘটনাই গোপন থাকে না। কিন্তু তাদের এ দাবি ভিত্তিহীন। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট দ্বারা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও ধর্ষণের অধিকাংশ ঘটনা গোপন করার বিষয়টি প্রমাণিত। স্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও অন্ধ ইসলামবিদ্বেষীরা এসবের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্ষণ প্রতিরোধে পর্দার ভূমিকাকে অস্বীকার করে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ জঘন্য স্বভাব সম্পর্কে বলেন, ‘যদি তারা সব নিদর্শন দেখে তবুও সেগুলো বিশ্বাস করবে না।’ (সুরা আল আনআম, আয়াত- ২৫)

ইসলামবিদ্বেষীরা যেসব বিষয়কে ধর্ষণের প্রধান কারণ বলে মনে করে থাকে সেসব বিষয়ের কিছু ক্ষেত্রে পোশাকের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তারা ধর্ষণ প্রতিরোধে নারীর প্রতি পুরুষের ভোগবাদী মানসিকতা পরিবর্তনের কথা বলে। কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য শরীয়তসম্মত পোশাকের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বখাটে যুবকরা বেপর্দা নারীদের দিকে যেরূপ লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্দানেশীন নারীদেরকে সেরূপ দৃষ্টিতে তাকায় না; বরং তাদেরকে মা-বোনের নজরে দেখে। সুতরাং বখাটে যুবকদের মানসিকতা পরিবর্তন করার জন্যই মেয়েদের শরীয়তসম্মত পোশাক পরা দরকার। আর নারীদের হিজাব হচ্ছে তাকওয়ার পোশাক। এ পোশাকের প্রতি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের শ্রদ্ধাবোধ আছে। এ পোশাক পরিহিত কোনো নারীকে দেখলে তাদের মধ্যে তাকওয়ার চেতনা জাগ্রত হয়। আর যাদের অন্তরে তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় বিদ্যমান তারা ব্যভিচার ও ধর্ষণের মতো জঘন্য কোনো কাজ করতে পারে না। তাই ধর্ষণ প্রতিরোধে তাকওয়ার শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আবার অনেকে নারীর নিরাপত্তাহীনতাকে ধর্ষণের প্রধান কারণ বলে মনে করে। কিন্তু নারীর নিরাপত্তা রক্ষায়ও শরীয়তসম্মত পোশাকের ভূমিকা অপরিসীম। পর্দা নারীর নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। পর্দা নারীদেরকে বখাটেদের কুদৃষ্টি হতে হেফাজত করে। তথাকথিত কিছু পর্দানেশীন নারীর ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরে নারীর নিরাপত্তায় শরয়ী পর্দার ভূমিকা অস্বীকার করা মূর্খতা ও ইসলামের প্রতি বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহতায়ালা পর্দার হিকমত বর্ণনা করে বলেন, "হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের (মুখমণ্ডলের) ওপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে (সম্ভ্রান্ত নারী হিসেবে) চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সুরা আল-আহজাব, আয়াত-৫৯) এ আয়াতে সুস্পষ্ট ভাষায় পর্দার উপকারিতা হিসেবে নারীদের উত্ত্যক্তের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

ইসলামে ধর্ষকের জন্য পরকালীন শাস্তির ঘোষণা ছাড়াও দুনিয়াতেও কঠোর শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু ধর্ষিতার জন্য কোনো শাস্তির বিধান ইসলামে নেই। এমনকী যদি কোনো নারী বেপর্দা হয়ে চলার কারণে ধর্ষণের শিকার হয় তাহলেও দুনিয়াতে তার কোনো নির্ধারিত শাস্তির ঘোষণা ইসলাম দেয়নি। তবে বেপর্দাপনার জন্য পরকালে সে কঠিন শাস্তি পাবে সেটা আলাদা বিষয়। হজরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কোনো শাস্তি দেন নি। তবে ধর্ষণকারীকে শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-২৫৯৮) ইসলামের বিধানসমূহ অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। ইসলাম নারীদের পর্দাবৃত থাকার নির্দেশদানের পাশাপাশি পুরুষদেরও তাদের প্রতি কুদৃষ্টি নিক্ষেপের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞারোপ করেছে। আর অনিচ্ছাকৃতভাবে কখনো দৃষ্টি পড়ে গেলে তার দৃষ্টি সাথে সাথে ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আর জোরপূর্বক ধর্ষণ করা তো অনেক দূরের বিষয় কোনো নারী যদি স্বেচ্ছায় অবৈধভাবে ব্যভিচারের জন্য কোনো পুরুষকে আহ্বান জানায় তাহলেও কোনো পুরুষের জন্য তার ডাকে সাড়া দেওয়া ইসলামে বৈধ নয়। এটা শুধুমাত্র অবৈধই নয় বরং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নারী-পুরুষ পরস্পরের সম্মতিতে ব্যভিচার করলে উভয়ের জন্য ইসলাম শাস্তি ঘোষণা করেছে। অবিবাহিত হলে একশত বেত্রাঘাত। আর বিবাহিত হলে পাথর মেরে হত্যা।

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads