• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
মেহমানদারিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি মেলে

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

মেহমানদারিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি মেলে

  • প্রকাশিত ০৬ জানুয়ারি ২০২১

মাওলানা মাহাথির মোবারক

মেহমানদারি বা অতিথি আপ্যায়নে রয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি। মেহমানদারির ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুব জোর তাকিদ দিয়েছেন। যার কারণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, আমার মনে হয় আমার কাছে মেহমানদের হক রয়েছে। তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামদের অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে খুব নজর দিতে বলেছেন। কিন্তু বর্তমান আমাদের সমাজে মেহমানদারিটা একটি ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে। আমরা মেহমান দেখলেই বিপদ মনে করি এবং নাক ছিটকে ওঠি। কিন্তু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মেহমান কারো রিজিকে হস্তক্ষেপ করে না। বরং সে তার নিজের রিজিক ভক্ষণ করে যায়। একসময় আমাদের দেশে মেহমানদের অনেক সেবাযত্ন করা হতো। তাদের জন্য বাড়ির সামনেই বাংলো ঘর বানিয়ে রাখা হতো। যেন তারা সেখানে অবস্থান করতে পারে। মেহমানদের ঘরগুলো নিজেদের ঘরের চেয়েও সুন্দর করে তৈরি করা হতো। যেন তাদের কোনো কষ্ট না হয়। কোনো বাড়িতে মেহমান আসলে সে বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতো।

মেহমানদারি মহান আল্লাহরতায়ালার সন্তুষ্টিলাভের অন্যতম কারণ। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে মানুষের সেবা করে সেই শ্রেষ্ঠ। (বায়হাকী)। এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো মেহমানের মেহমানদারি করতে অস্বীকৃতি  জানায় তাহলে মেহমান জোর করে তার বাড়িতে অবস্থান করার অধিকার আছে। এই হাদিসের দ্বারা বোঝা যায় মেহমানদারি সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা কতো গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অন্য এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, একটি ছুরি যেমন খুব তাড়াতাড়ি উটের কুঁজের দিকে চালানো হয় যার ফলে তার গর্দান শরীর হতে অতি দ্রুত আলাদা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি সে ঘরের দিকে অতি দ্রুত কল্যাণ অগ্রসর হতে থাকে, যে ঘরে অধিক মেহমানের আগমন ঘটতে থাকে। (সুনানে ইবনে মাজাহ)

হাদিস শরিফে পাওয়া যায় রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের শত্রুকেও আপন মনে করতেন এবং মেহমানদারি করতেন। একবার এক ইহুদি ব্যক্তি আবু জাহেলের নির্দেশ অনুযায়ী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথা মোবারক কেটে নেওয়ার জন্য নবীজির কাছে এসে বলল, হে মোহাম্মদ! আমি তোমার বাড়িতে আজ মেহমান হতে চাই। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অত্যন্ত খুশির সাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে মেহমান হিসেবে গ্রহণ করে নিলেন এবং রাতে অতি যত্নের সাথে আপ্যায়ন করলেন। যদিও তিনি জানতেন তার মাথা নেওয়ার জন্য এ ব্যক্তি এসেছে তারপরও তিনি তাকে ফিরিয়ে দেননি। সাহাবিগণ হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! একজন অমুসলিম মেহমানের প্রতি আপনি এতো সম্মানজনক আচরণ জানালেন কী কারণে? তিনি উত্তর দিলেন, আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবীতে মানুষকে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন। (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত-৭০) হজরত সালমান ফারসি (রা.) বলেন, একবার আমি নবীজির খেদমতে হাজির হলাম তখন তিনি একটি চেয়ারে বসা ছিলেন। আমাকে দেখে তাঁর চেয়ারটি সামনে বাড়িয়ে দিলেন আর বললেন, ‘হে সালমান! যে ব্যক্তি কোনো মেহমানের সম্মানে তার আসনটি বাড়িয়ে দেয়, আল্লাহতায়ালা তার সব গোনাহ মাফ করে দেন।’ (হায়াতুস সাহাবা)

 মেহমানদারির ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘অতিথিপরায়ণতা বা মেহমানের সেবা মানুষের অসহায়ত্ব দূর করে, মনের মধ্যে প্রশান্তি সৃষ্টি করে, সর্বোপরি জীবনে নিয়ে আসে অনন্ত সুখ আর শান্তি।’ (সহিহ বুখারি) অতিথিপরায়ণতা পরস্পর ভালোবাসা এবং সহানুভূতি সৃষ্টি করে। ইবনুস সাকান-এর বরাতে সাহাবি আবু রুশদ ইবনে আব্দুর রহমান বলেন, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেহমান হয়েছিলাম। তিনি আমাকে তাঁর কাছে বসালেন। ভালো-মন্দ খাবার দিলেন। অতঃপর তিনি আমাকে তাঁর চাদর হাদিয়া দিলেন। আমি তাঁর হূদয়স্পর্শী আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম। (হায়াতুস সাহাবা) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদিসে বলেন, মেহমানকে খুশি করার জন্য নফল সাওম বা রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ। হজরত আবু হুজাইফা (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, একদা হজরত সালমান ফারসি (রা.) হজরত আবু দারদার বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। সালমানের জন্য খাবার তৈরি হলো। আবু দারদা বললেন, ‘খানা খাও, আমি রোজাদার। সালমান বললেন, তুমি না খাওয়া পর্যন্ত আমি খাব না। তখন দুজনে একসাথে খাবার গ্রহণ করলেন।’ (সহিহ বুখারি)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেহমান দেখলে অত্যন্ত আনন্দচিত্তে তাকে ‘মারহাবা’ বলে  অভ্যর্থনা জানাতেন। (ইবনুল কায়্যিম, জাদুল মা’আদ) হজরত আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদিসে নবীজি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাত আদায় করে, জাকাত প্রদান করে, রমজানের সাওম পালন করে এবং মেহমানের আদর আপ্যায়ন করে, সে বেহেশতে প্রবেশ করবে। তিনি বলেন, যার ঘরে মেহমানের জন্য দস্তরখানা বিছানো থাকে, ফিরিশতাগণ ওই ব্যক্তির জন্য রাহমাতের দোয়া করতে থাকেন। (আত্তারগীব ওয়াত তারহীব) হজরত মিকদাম আবু করীমা সামী রাদিআল্লাহুর রেওয়ায়েতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘রাত্রি বেলা আগন্তুক মেহমানকে আপ্যায়িত করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ওয়াজিব। সকাল পর্যন্ত থাকলে তখনও মেহমানদারি করা তার পাওনা। তবে মেহমান ইচ্ছা করলে এটা গ্রহণ করতে পারেন আবার ছেড়েও দিতে পারেন। (আদাবুল মুফরাদ)

হজরত আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘একদিন একরাত পর্যন্ত মেহমানকে উত্তম খাদ্য প্রদান করা তার পাওনা। আর মেহমানদারি হলো সর্বনিম্ন তিন দিন। অধিক করলে তা সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (সহিহ বুখারি) হজরত উকবা ইবনে আমির এর বর্ণনায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা যদি কোনো সমপ্রদায়ের নিকট উপস্থিত হও আর যা শোভনীয় তা দ্বারা তারা তোমাদের আপ্যায়ন করে, তবে তা সাদরে গ্রহণ করো। আর যদি তা না করে তবে মেজবানের অবস্থা অনুযায়ী তোমরা মেহমানদারির হক আদায় করে নিতে পার। (সহিহ বুখারি) আহমদ বলেন ক্ষুধার তীব্রতায় যখন প্রাণনাশের আশংকা দেখা দেয় অথবা জনমানবহীন এলাকার জন্য এটা প্রযোজ্য (ফাতহুল বারী)

মেহমানের সেবা-যত্ন করতে গিয়ে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবার-পরিজনকে অনেক সময় অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হতো। তথাপি তিনি কখনো মেহমানের আগমনকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করতেন না এবং বিরক্ত হতেন না। একবার এক বেদুঈন লোক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে উপস্থিত হলেন। রাসুল সাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মেহমানদারির জন্য নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। তখন তার বিবি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতে লাগলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ! আজ আমাদের ঘরে পানি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। একথা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  দরবারে গিয়ে সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মাঝে কে আছো, যে এই বেদুঈনকে মেহমানদারির ব্যবস্থা করবে? তখন এক আনসারি সাহাবি তাকে মেহমান হিসেবে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলেন। বাড়িতে গিয়ে শুনতে পেলেন তার ঘরে শুধু মাত্র দুটা রুটি ছাড়া আর কিছুই নেই। আনসারি সাহাবি মোটেও ঘাবড়ালেন না বরং রাত্রি বেলায় বেদুঈন ব্যক্তিকে নিয়ে এক সাথে খেতে বসলেন এবং দুটি রুটিই তার প্লেটে দিয়ে নিজে খালি প্লেট নিয়ে বসে আছেন। খাওয়ার সময় নিজের কুপি বাতিটি নিভিয়ে দিলেন যেন বেদুঈন লোকটি কোনো কিছু দেখতে না পায়। সকালে আনসারি সাহাবি বেদুঈন লোকটিকে নিয়ে যখন রাসুলের দরবারে উপস্থিত হলেন, তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি গত রাতে কী করেছ যার কারণে আল্লাহতায়ালা তোমার ওপর পরিপূর্ণ রাজি ও খুশি হয়ে গেলেন? আনসারি সাহাবি জবাব দিলেন, নিজে না খেয়ে মেহমানের মেহমানদারি করেছি। এই হলো মেহমানদের প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসা ও আন্তরিকতা।  

লেখক : খতিব, মসজিদে বায়তুন নূর, মাওনা, গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads