• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯
মাটির ঘর থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

মাটির ঘর থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ

  • প্রকাশিত ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সৌদি আরবের মদিনা মুনাওরায় অবস্থিত মসজিদে নববী (সা.) বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর নিকট ধর্মীয় দিক থেকে দ্বিতীয় পবিত্রতম স্থান। মসজিদটি হজরত  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাদানি জীবনে ইসলামের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। একাধিক হাদিস সূত্রে জানা যায়, মসজিদে নববীতে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার দ্বারা মক্কা মুকাররমার মসজিদুল হারাম ব্যতীত পৃথিবীর যে কোনো মসজিদে নামাজ আদায়ের তুলনায় হাজার গুণ বেশি সওয়াব অর্জিত হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে তৎকালীন ইয়াসরিব তথা আজকের মদিনা নগরীতে হিজরতের পরে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। মদিনায় মসজিদে কুবার পরে নির্মিত মসজিদে নববী। ঐতিহাসিক এই মসজিদের মধ্যে এমন একটি বরকতপূর্ণ স্থান রয়েছে যাকে জান্নাতুল বাকী বা জান্নাতের বাগান আখ্যায়িত করা হয়েছে। হজরত আবু হুরাইরা (রা.)-এর সূত্রে সহিহ বুখারি শরিফে বর্ণিত হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার ঘর এবং আমার মসজিদের মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানে জান্নাতের একটি টুকরা রয়েছে।

আজ থেকে ১৪৪২ বছর পূর্বে এই মসজিদ আখেরি নবী হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাসগৃহের সন্নিকটে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করা হয় এবং পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে একাধিক বার এর সম্প্রসারণ করা হয়। সুলতান গালিব আল কায়িতী এ প্রসঙ্গে লিখেন, ১৯০৯ সালে আরব উপদ্বীপের একমাত্র ভবন হিসেবে মসজিদে নববীতে আলোকসজ্জার জন্য বিদ্যুতের ব্যবহার করা হয়। মসজিদে নববীর সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণ কাজটি হয় বাদশাহ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল আজিজের শাসনামলে। বর্তমানের আকৃতিটি এরই পূর্ণরূপ। বলা হয়, এই সম্প্রসারণের পরই প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলমানের গন্তব্যস্থল মসজিদে নববীতে হজ্বের মৌসুমে একসঙ্গে অন্তত ১৮ লাখ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

সাম্প্রতিক ইসলামিক একটি মাসিক ম্যাগাজিনে ‘মসজিদে নববী ও সবুজ গম্বুজ’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে জাফর বাঙ্গাশ লিখেছেন, প্রথম দিকে মসজিদে নববীর ক্ষেত্রফল ছিল-৯৮ বাই-১১৫ ফুট। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে মসজিদকে একাধিকবার সম্প্রসারণ করা হয়েছে। স্মরণীয় যে, ইসলামে সাওয়াব অর্জনের উদ্দেশে পবিত্রতম তিনটি স্থানে দীর্ঘ সফর করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তার একটি হলো মসজিদে নববী। ডক্টর শফিক ওমর মুহাম্মাদ ওয়াজিদ আখতার তাঁর একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, প্রাথমিক সময়ের মসজিদে নববীর চেয়ে বর্তমানের স্থাপনাটি প্রায় শত গুণ বড় এবং আজকের মসজিদটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রাচীন মদিনা নগরীকে বেষ্টন করে নিয়েছে। তিনি লিখেছেন, মসজিদের বাইরের প্রাচীর জান্নাতুল বাকীকে স্পর্শ করেছে। যা রাসুলের সময়ে নগরীর উপকণ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হতো। ডক্টর শফিক রচিত ‘মসজিদে নববী সম্পর্কে অজানা নয় তথ্য’ গ্রন্থের সূত্রে এই কথা বর্ণনা করেছেন।

মসজিদে নববীতে একসঙ্গে ১৮ লাখ মুসল্লির নামাজ আদায় : ২০১২ সালে বাদশাহ আব্দুল্লাহর সম্প্রসারণ প্রকল্পের অসামান্য অবদান। মসজিদের বর্তমান আয়তন সম্পর্কে সৌদি আরবের অর্থমন্ত্রী ইবরাহিম আসাফ জানান, মূল স্থাপনাটি অন্তত ছয় লাখ ১৪ হাজার আটশত বর্গমিটার জায়গাজুড়ে অবস্থিত। আর মসজিদ ও তার আঙিনার একত্রিত আয়তন হলো-দশ লাখ বিশ হাজার পাঁচশত বর্গমিটার। অর্থাৎ মূল মসজিদে একইসঙ্গে ১০ লাখ মুসল্লি এবং আঙিনায় ৮ লাখ সর্বমোট ১৮ লাখ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের মুখপাত্র শায়খ আব্দুল ওয়াহেদ আল হাত্তাবের সূত্রে আরব নিউজ জানান, বাদশাহ আব্দুল্লাহর নির্দেশে মসজিদে বিশেষ কাঠামোতে তৈরি ২৫০ টি ছাতা স্থাপন করা হয়। এসব ছাতা অন্তত এক লাখ ৩৪ হাজার বর্গমিটার এলাকায় ছায়া দান করতে সক্ষম। দ্বিস্তরবিশিষ্ট স্বয়ংক্রিয় এই ছাতাগুলো সমাগত মুসল্লিদের বৃষ্টি ও আরব মরুর জ্বলন্ত সূর্যালোকের তীব্র উত্তাপ থেকে সুরক্ষিত রাখে। মদিনা মুনাওয়ারার মসজিদে নববী ও মক্কা মুকাররমার মসজিদুল হারাম- দুটিই একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। আর মসজিদের দেখভালের দায়িত্ব স্বয়ং রাজপরিবারের ওপর। খোদ বাদশাহকে ‘খাদেমুল হারামাইনিশ শারিফাইন’ (পবিত্র দুই মসজিদের সেবক) বলা হয়।

ইমামতি : মসজিদে নববীর সর্বপ্রথম ইমাম ছিলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে মসজিদের প্রধান ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন সৌদি আরবের প্রবীণ আলেম শায়খ আলি আল হুজাইফি। বিগত ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর তাঁর সহযোগী স্বরূপ মসজিদে নববীতে আরো দুইজন ইমাম নিয়োগ দিয়েছে সৌদি সরকার। তাঁদের একজন শায়খ হুজাইফিপুত্র শায়খ আহমাদ হুজাইফি। অপরজন হলেন শায়খ খালেদ আল মিহান্না। এছাড়াও আরো কয়েকজন ইমাম নিযুক্ত আছেন। তাঁরা বিশেষত তাহাজ্জুদ নামাজের ইমামতি করেন।

মুয়াজ্জিন : মোবারকপুরীর মতে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীর জন্য সর্বপ্রথম মুয়াজ্জিন নিয়োগ দেন বিখ্যাত সাহাবি হজরত বেলাল (রা.)কে। বর্ণনা অনুযায়ী সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ যখন মহানবী (সা.)কে স্বপ্নে আজান দেখার বিষয়ে জানালেন। তখন তিনি তাকে নির্দেশ দিলেন, সে যেন বেলালকে নামাজে ডাকার জন্য আজান দিতে বলে। কারণ, হজরত বেলালের কণ্ঠস্বর উঁচু ছিল। সৌদি গণমাধ্যম রিয়াদের সূত্রে মসজিদে নববীর প্রধান মুয়াজ্জিন শায়খ আবদুর রহমান খাশোগি জানান, বর্তমানে মসজিদে নববীতে অন্তত ১৭ জন মুয়াজ্জিন আছেন, তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান দেন। তবে প্রতিদিনের জন্য তিনজন মুয়াজ্জিন নির্ধারিত রয়েছেন, পাঁচ ওয়াক্ত আজান দেওয়ার পাশাপাশি তারা মুকাব্বিরের দায়িত্বও পালন করে থাকেন।

মসজিদের সূচনা : ঐতিহাসিক মুবারকপুরীর সূত্রে জানা যায়, হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় পৌঁছে স্থানীয় দুই এতিম সহোদর সাহিল ও সুহাইলের কাছ থেকে দশ দিনারের বিনিময়ে মসজিদের জায়গাটি ক্রয় করেন। এর আগে জায়গাটিতে খেজুর শোকানো হতো। মসজিদ নির্মাণে স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অংশগ্রহণ করেন। পাথর দ্বারা এর ভিত্তিস্থাপন করা হয়। প্রাচীর তৈরি করা হয় মাটি দিয়ে। ছাদে ব্যবহার করা খেজুর গাছের ডাল ও কাণ্ড। শুরুতে মসজিদের দরজা ছিল মাত্র তিনটি। আর মসজিদকে বর্তমান ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসার অভিমুখী করে নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই সময়ে মুসলমানদের কিবলা ছিল হজরত সুলাইমান (আ.) এই মসজিদ। দরিদ্র ও দূরের মুসাফিরদের জন্য একটি বিশেষ বিশ্রামাগারও তৈরি করা হয়েছিল। পরে যখন পবিত্র কাবাগৃহ ফের কিবলা নির্বাচিত হয় তখন মসজিদে নববীর মুখও মক্কা অভিমুখী করে দেওয়া হয় এবং একটি দরজা বন্ধ করে বিপরীত পাশে আরেকটি দরজা সংযোজন করা হয়। নির্মাণকালে মসজিদের আয়তন ছিল এক হাজার বর্গমিটার, অতঃপর হিজরতের সাত বছর পরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে তা বৃদ্ধি করে চৌদ্দ শ ২৫ বর্গমিটার করা হয়।

মসজিদে নববীর সৌন্দর্য : চোখ ধাঁধানো নির্মাণশৈলী ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত এই মসজিদের প্রতিটি জিনিসই সর্বাধিক সুন্দর ও রুচিকর। একথা বললে অত্যুক্তি হবেনা যে, বাস্তবিকই মসজিদে নববী সৌন্দর্য বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম একটি ধর্মীয় স্থাপনা। কাছ থেকে দেখলে যেমন চোখজুড়ায়, তেমনি দূর থেকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেও মসজিদে নববীর মোহনীয়তায় মন নেচে ওঠে। মসজিদের ভেতর-বাইরে সবখানেই আধুনিকতা ও নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর ব্যবহার এবং পরিচালনার দারুণ সব ব্যবস্থা অত্যন্ত সুন্দর উপায়ে সাজানো হয়েছে। এর বিস্তৃত আঙিনা, সজ্জিত ছাদ, সুউচ্চ গম্বুজ ও মিনার, বাহারি আলোকসজ্জা, সাউন্ড সিস্টেম, দেয়াল, সিঁড়ি এবং কার্পেট-সব জায়গারই নিপুণ সৌন্দর্য যে কোনো রুচিশীল দর্শকের মন কেড়ে নেবে। মসজিদে নববীর মুখপাত্র শায়খ আবদুল ওয়াহেদ হাত্তাব জানান, মসজিদের আঙিনায় ২৫০ টি মিনারার উপরে স্বয়ংক্রিয় বিশেষ ছাতা স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ছাতা মসজিদের অন্তত ১৪৩ বর্গমিটার জায়গায় ছায়া দান করে এবং আগত অন্তত আটশত মুসল্লিকে মৌসুমি রৌদ্রতাপ ও ঠান্ডা থেকে সুরক্ষা দান করে।

দরজা : আর্কিটেকচারাল ডিজাইন অনুসারে বর্তমানে মসজিদের দরজা সংখ্যা ৪১ টি। প্রতিটি দরজার উপরে একটি শিলালিপি লাগানো রয়েছে-পবিত্র কোরআনের সুরা হিজরের ৪৬ নাম্বার আয়াতের অনুসারে তাতে লেখা-শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে প্রবেশ করুন। একাধিক লিফটের ব্যবস্থাও আছে-যা আপনাকে এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোর কিংবা একতলা থেকে অন্য তলায় নিয়ে যাবে।

আয়তন : মসজিদের আয়তন সম্পর্কে হারামাইন শরিফাইনের জেনারেল প্রেসিডেন্সি জানিয়েছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে তাঁর মসজিদের আয়তন এক হাজার ৫০ বর্গমিটার নির্ধারণ করেছিলেন। হিজরতের সাত বছর পর মহানবীর নির্দেশে এটি বাড়িয়ে চৌদ্দ শ ২৫ বর্গমিটার করা হয়। এর পাশাপাশি রাসুলের ইন্তেকালের পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে একাধিকবার মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ ও পুনর্গঠন করা হয়। যার সূচনা হয় হজরত ওমর (রা.)-এর হাত ধরে এবং একেক করে আব্বাসি, উমাইয়া ও উসমানি খেলাফত হয়ে বর্তমান সৌদি শাসনামল পর্যন্ত চলতে থাকে। কালপরিক্রমায় মদিনায় মুসলিম জনমিতি বৃদ্ধির ফলে মূল মসজিদের কাঠামোও বাড়ানো হয়। কেননা, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার মসজিদুল হারামের পরে পৃথিবীর অন্য সব মসজিদের চেয়ে তাঁর মসজিদে নামাজ আদায়ে এক হাজার গুণ বেশি সওয়াবের কথা উল্লেখ করেছেন। সারা বছর ওমরার জন্য এবং হজের মৌসুমে লাখ লাখ মুসল্লি মসজিদে নববীতে হাজির হন। (চলবে..)

তারিকুল ইসলাম

লেখক : আলেম, গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads