• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

শুক্রবার সপ্তাহের সর্বোত্তম দিন

  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুহাম্মাদ হাবীব আনওয়ার

 

 

শুক্রবার মুসলিম উম্মাহর জন্য অন্যতম একটি দিন। মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে এক বিশেষ উপহার। সপ্তাহের দিনগুলোর ভেতর জুমার দিন হলো শ্রেষ্ঠ দিন। সর্বোত্তম দিন। আল্লাহতায়ালা পুরো পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এ ছয় দিনের শেষ দিনটি ছিল জুমার দিন। এ দিনেই হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। আবার এ দিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। কেয়ামত সংঘটিতও হবে শুক্রবারে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত-হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘জুমার দিনই হলো সর্বোত্তম দিন যাতে সূর্য উদিত হয়। এ দিনে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এ দিনেই তাকে বেহেশতে প্রবেশ করানো হয়েছে। এ দিনেই তাকে বেহেশত থেকে বের করা হয়েছে। আর এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।’ (মিশকাত : ১২৭৭) মূর্খতার যুগে শুক্রবারকে ‘ইয়াওমে আরবা’ বলা হতো। আরবে কা’ব ইবনে লুয়াই সর্বপ্রথম এর নাম ‘ইয়াওমুল জুমা’ রাখেন। এ দিনে কোরাইশদের সমাবেশ হতো এবং কা’ব ইবনে লুয়াই ভাষণ দিতেন। এটা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের পাঁচশ ষাট বছর পূর্বের ঘটনা।

তাফসিরে মাআরিফুল কোরআনে মুফতি শফী (রহ.) লেখেন, ‘আল্লাহতায়ালা প্রতি সপ্তাহে মানবজাতির সমাবেশ ও ঈদের জন্য এ দিন রেখেছিলেন। কিন্তু পূর্ববর্তী উম্মতরা তা পালন করতে ব্যর্থ হয়! ইহুদিরা ‘ইয়াওমুস সাবত’ তথা শনিবারকে নিজেদের সমাবেশের দিন নির্ধারিত করে নেয়, খ্রিস্টানরা রবিবারকে। মহান রাব্বুল আলামিন এই উম্মতে মুহাম্মদিকে তাওফিক দিয়েছেন যে, তারা শুক্রবারকে মনোনীত করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ, জুমার দিন যখন সালাতের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর; এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর। (সুরা জুমআাা ৯)। এখানে ‘ধাবিত হও’-এর অর্থ এই নয় যে, দৌড়ে এসো। বরং অর্থ হলো, আজানের পর সত্বর নামাজে চলে এসো এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ কর। কেননা হাদিসে নামাজের জন্য দৌড়ে আসতে নিষেধ করা হয়েছে এবং ধীর-স্থিরতার সাথে আসতে তাকিদ করা হয়েছে। (আহসানুল বয়ান)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন সলাতের জন্য আহ্বান করা (আজান দেওয়া) হয় তখন তোমরা স্বাভাবিকভাবে হেঁটে গিয়ে সলাতে শরিক হও। এ সময় তোমাদের উচিত প্রশান্তভাব ও গাম্ভীর্য বজায় রাখা। এভাবে যতটুকু জামায়াতের সাথে পাবে আদায় করবে। আর যতটুকু পাবে না তা পূরণ করে নেবে।’ (মুসলিম : ১২৪৮)।

জুমার দিনের ফজিলত সম্পর্কে অসংখ্যা হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবু আব্দুল্লাহ সালমান ফারেসী (রা.) থেকে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিনে গোসল করে, যথাসম্ভব পবিত্রতা অর্জন করে, তেল ব্যবহার করে অথবা ঘরের সুগন্ধি নিয়ে লাগায়। অতঃপর জুমার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়ে মসজিদে প্রবেশ করে দুজনের মধ্যে পৃথক করে না। তারপর তার ভাগ্যে যতটা লেখা হয়েছে, ততটা নামাজ আদায় করে, তারপর যখন ইমাম খুতবা দেয় তখন সে চুপ থাকে, তাহলে তার জন্য এক জুমা থেকে অন্য জুমা পর্যন্ত কৃত পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হয়। (রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ৮৩২)।

মোল্লা আলী কারী (রহ.) বলেন, জুমার দিনটিকে হজে আকবার বলা হয়, যা জুমার দিনবিহীন সত্তরটি হজের চেয়েও অধিক উত্তম। হজরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব বলেন, আল্লহর কাছে জুমা নফল হজের চেয়েও অধিক মূল্যবান। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.- মারফু হাদিসে বলেছেন, জুমা হলো দরিদ্রের হজ। (মিরকাত)। শুক্রবারে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, সে মুহূর্তে মানুষ যে দোয়া করে আল্লাহতায়ালা কবুল করেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় জুমার দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যাতে কোনো মুসলমান বান্দা আল্লাহর কাছে কোনো মঙ্গল কামনা করলে আল্লাহ তা অবশ্যই দান করেন।’ (মিশকাত ১২৭৮)। অন্যত্র হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘এমন কোনো দিনে সূর্য উদয়াস্ত হয় না, যে দিন জুমার দিন হতে উত্তম। জুমার দিনে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, যদি কোনো মুমিন বান্দা একে পায় এবং আল্লাহর নিকট কোনো কল্যাণের জন্য দোয়া করে, আল্লাহ তা কবুল করেন। আর যদি কোনো অকল্যাণ থেকে মুক্তি চায় আল্লাহ তাকে মুক্তি দেন। (মেশকাত ১২৮৩)।

দোয়া কবুল হওয়ার সময়টি অজানা। এর কারণ হলো, যাতে মানুষ এ মুহূর্তটি লাভের আশায় সারাদিন ইবাদতে মশগুল থাকে। তবে দোয়া কবুলের সময় নিয়ে উলামাদের বিভিন্ন মত রয়েছে।

তার মধ্যে থেকে নিম্নে কিছু উল্লেখ করা হলো-১. জুমার দিন মুয়াজ্জিন ফজরের আজান দেওয়ার সময়। ২. ফজরের শুরু থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত। ৩. আসরের নামাজের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। ৪. ইমাম মিম্বার থেকে নেমে তাকবিরে তাহরিমা বলা পর্যন্ত। ৫. মুয়াজ্জিন যখন জুমার আজান দেন। ৬. ইমাম মেহরাবে আহরণ হওয়ার পর থেকে নামার পূর্ব পর্যন্ত। ৭. আজানের পর থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। ৮. ইমাম খুতবা শুরু করা থেকে নিয়ে শেষ করা পর্যন্ত। ৯. দুই খুতবার মাঝখানে বসার সময়। এছাড়া আরো অনেকগুলো মত পাওয়া যায়। আল্লামা সুয়ুতী (রহ.) পঁয়তাল্লিশটি মত প্রকাশ করেছেন। আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহ.)-এর ৫০টি মতামত আছে। মুহিব্বে তারাবী (রহ.) বলেন, এসব মতামতের মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধটি হজরত আবু মুসা (রা.)-এর হাদিস। অর্থাৎ ইমাম মিম্বারে আহরণ করা থেকে শুরু করে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। আর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.)-এর মত। অর্থাৎ আসরের পর শেষ মুহূর্তটি। এই দুই মতের মধ্যে বায়হাকী, ইবনে আরাবী এবং কুরতবী (রহ.) প্রমুখ বিজ্ঞজন প্রথমোক্ত মতকেই প্রধান্য দিয়েছেন। (ফয়জুল কালাম)।

জুমার দিনের আমল সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার নামাজের পূর্বে এই বিষয়গুলোর ওপর আমল করবে সে তার প্রতিটি পদক্ষেপের বদলে এক বছর নফল রোজা ও নফল নামাজের ছওয়াব পাবে (তিরমিজি)-১. গোসল করা। ২. উত্তম কাপড় পরা। ৩. খুশবু লাগানো। ৪. সকালে সকালে মসজিদে যাওয়া। ৫. পায়ে হেঁটে যাওয়া। ৬. ইমামের কাছাকাছি বসা। ৭. মনোযোগ সহকারে খুতবা শোনা। ৮. সুরা কাহাফ তিলাওয়াত করা। ৯. হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর বেশি বেশি দরুদ পড়া। ১০. গোঁফ কাটা, নখ কাটা ইত্যাদি।

 

জুমার দিনে মৃত্যুর ফজিলত

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত-হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোনো মুসলমান জুমার দিন অথবা জুমার রাতে মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহপাক তাকে কবরের ফিতনা (অর্থাৎ কবরের প্রশ্ন এবং আজাব) থেকে বাঁচান।’ (মিশকাত)। অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন মৃত্যুবরণ করে তার জন্য শহীদের প্রতিদান লিপিবদ্ধ করা হয় এবং কবরের শাস্তি থেকে বাঁচানো হয়।’ (মিরকাত)। জুমার দিন সূরা কাহফ তিলাওয়াতের রয়েছে বিশেষ ফজিলত। হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ তিলাওয়াত করবে, সে আট দিন পর্যন্ত সর্বপ্রকার ফিতনা থেকে মুক্ত থাকবে। যদি দাজ্জাল বের হয় তবে সে দাজ্জালের ফিতনা থেকেও মুক্ত থাকবে।’

 

জুমা ত্যাগকারীর ব্যাপারে হুমকি

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত-হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা কারণে জুমা পরিত্যাগ করবে তাকে এমন কিতাবে মুনাফিক হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হবে যা কখনো মিটানো হবে না।’ (মিশকাত ১২৯৭)। অন্য হাদিসে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি তাচ্ছিল্যভরে অথবা অবহেলা করে তিনটি জুমা পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তার অন্তরে মোহর এঁটে দেবেন।’ (তিরমিজি)। তাই সাবধান, জুমার নামাজের ব্যাপারে আমাদের খুব যত্নবান হতে হবে। অযথা অলসতা করে বিনা কারণে কোনো মুসলমানের জন্য জুমার নামাজ পরিত্যাগ করা উচিত হবে না। জুমার দিনের বিভিন্ন আমলের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি একটি বিশেষ দরুদ পাঠ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আমাল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন আসর নামাজের পরে, কারো সাথে বাক্যালাপের আগে (নিম্মে উল্লিখিত) এই দরুদ ৮০ বার পাঠ করবে আল্লাহ তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। আর ৮০ বছরের ইবাদতের ছাওয়াব তার আমল নামায় লিপিবদ্ধ করবেন।’ দোয়াটি হলো- ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদানিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহি ওয়াসাল্লিম তাসলিমা।’

 

লেখক : শিক্ষার্থী, হাটহাজারী মাদরাসা, চট্টগ্রাম।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads