• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

তাকওয়া অবলম্বন প্রত্যেকের জন্য জরুরি

  • প্রকাশিত ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুফতি নাঈম কাসেমি

 

 

 

আল্লাহরাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য, আর দুনিয়ার বাকি সবকিছু তৈরি করেছেন মানবজাতির সেবা করার জন্য। আসমান, জমিন, পাহাড়, নদী, গাছপালা, ফল-ফুল ইত্যাদি সবকিছুই মানুষের খেদমতের জন্য বানিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে অনেক নেয়ামত দান করেছেন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গ মানুষের জন্য অতুলনীয় নেয়ামত। হাত, পা, চোখ, কান, নাক এই সবগুলোই বড় নেয়ামত। যার নেই সে অনুভব করতে পারে এগুলোর কতটা গুরুত্ব মানবজীবনে। এতো এতো মূল্যবান নেয়ামত আল্লাহতায়ালা আমাক আপনাকে দিয়ে রেখেছেন বিনামূল্যে। আমি ঘুমিয়ে থাকি আমার শ্বাস-প্রশ্বাস চলমান। আমি অচেতন, আমার ব্লাড সার্কুলেশন সচেতন। আল্লাহতায়ালা তার এই সব অমূল্য নেয়ামতরাজি শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ, মুসলিম-অমুসলিম সবাইকে সমানভাবে দিয়ে রেখেছেন।

দুনিয়ার উপকরণের নেয়ামত আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন, তা ব্যবহার করে আমাদের আখিরাতের পাথেয় অর্জনের জন্য। দুনিয়াকে মুহাব্বত করার জন্য নয়। দুনিয়ায় বেঁচে থাকাটা পানিতে নৌকা চলার মতো। পানি ছাড়া যেমন নৌকা চলতে পারে না, আবার নৌকায় পানি উঠলে তা ডুবে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। তেমনই দুনিয়া ছাড়া এবং এর উপকরণ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। তবে যদি তাতে ডুবে যায় তবে তার বিভ্রান্ত হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যখন তোমাদের নামাজের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা বেচাকেনা ছেড়ে দিয়ে নামাজের দিকে আসো।’ নামাজের আদেশের সাথে সাথে আল্লাহপাক রিজিক তালাশের কথাও বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তোমাদের নামাজ শেষ হয় তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো আল্লাহপ্রদত্ত রিজিক সন্ধানে।’ রিজিক অন্বেষণ করা, বেঁচে থাকার উপায় অবলম্বন করা সুন্নাতে ইলাহী। তবে এতে ডুবে যাওয়া নিষেধ।

আল্লাহতায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন কোনো বিনিময় ছাড়াই। অতঃপর আমাদের চোখ দিয়েছেন। সেই চোখ প্রয়োজনে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে ঘুরানোর জন্য ফ্রিলি মুভমেন্টের জন্য লাগিয়ে দিয়েছেন অদৃশ্য বেয়ারিং। লাইফ টাইম গ্যারান্টি। শ্রবণের প্রয়োজনে কান দিয়েছেন। কথা বলার প্রয়োজনে মুখ দিয়েছেন। আর মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা দিয়েছেন। আলোর প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছেন সূর্য। স্নিগ্ধতার প্রয়োজনে দান করেছেন চন্দ্র। দিন-রাতের মাঝে তফাত সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহতায়ালা এতো এতো নেয়ামত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দান করার পর ঘোষণা করেন, ‘তোমরা আল্লাহর কোন কোন নিদর্শন অস্বীকার করবে?’

যে আল্লাহ আমাদের প্রয়োজনার্থে এতো এতো নেয়ামত দান করেছেন। সেই আল্লাহকে আমরা ভুলে এই তুচ্ছ দুনিয়ার পেছনে দৌড়াচ্ছি। ফলে আমাদের জীবনতরী দুনিয়া নামক সাগরে ডুবতে থাকে। টাকার প্রয়োজন। হালাল-হারাম দেখার দরকার নেই। চুরি করব নাকি ডাকাতি করব তা ভাবার সময় নাই। অন্যের মাল মেরে হোক, অন্যকে মেরে হোক, চাঁদাবাজি করে হোক, টেন্ডারবাজি করে হোক, দুর্নীতি করে হোক, এতোকিছু ভাবার সময় আমার নেই। আমার শুধু টাকার প্রয়োজন। বাড়ি করব জায়গা দরকার, শপিং মল করব জায়গা দরকার, নিজেরটা নাই তো কী হয়েছে? অন্যেরটা মেরে হোক, আমার দরকার শুধু জায়গা। তা যেভাবেই হোক না কেন। এভাবেই আমরা আস্তে আস্তে দুনিয়া নামক সাগরের অতল গহ্বরে ডুবে যাই। আল্লাহ বলেন, ‘যে সীমালঙ্ঘন করল, দুনিয়ার জিন্দেগীকে প্রাধান্য দিল, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।’

ক্ষমতাও আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এক নেয়ামত। এটাও আমাদের কাছে আমানত স্বরূপ। ক্ষমতার চেয়ারে বসে জোর গলায় কথা বললেই স্কলার হওয়া যায় না। ক্ষমতার চেয়ার থেকে গায়ের জোরে কোনো অন্যায় ফরমান জারি করা যাবে না। হাদিসে পাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা সবাই দায়িত্বশীল। আর সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (তিরমিজি শরিফ) তাই কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবহেলা করা যাবে না। আর কোনো দায়িত্বের অপব্যবহার করাও যাবে না। মানুষের উপর জুলুম নির্যাতন এবং অন্যের হক নষ্ট করা যাবে না। সবার সাথে ভালো আচরণ করতে হবে। সবার হক যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। জনৈক কবি বলেন,  ‘মানুষ যদি কেবল আকৃতিতেই মানুষ হতো, আবু জাহেল আর মোহাম্মদ (সা.) আকৃতিতে তো একই রকম ছিল।’ কিন্তু আবু জাহেলের ব্যাপারে কত কঠিন কথা হাদিসে এসেছে, ‘সে (আবু জাহেল) হলো এই উম্মতের ফেরআউন।’ আবু জাহেল তো ফেরআউনের চেয়ে আরো ভয়ংকর। ফেরআউনও মৃত্যুর সময় বাঁচার জন্য ঈমান এনেছিল। পক্ষান্তরে আবু জাহেল যখন যুদ্ধক্ষেত্রে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিল, তখন আনসারি সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) তার বুকের উপর গিয়ে বসেন। ‘আবু জাহেল তার দিকে তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে-‘আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ! তোর কতবড় সাহস! ফকিরের বেটা হয়ে আমার বুকে বসেছিস! কি করবি? সাহাবী বলেন, তোর মাথাটা কেটে নিয়ে আমার নবীর পদতলে সোপর্দ করব। আবু জাহেল বলল, মাথাটা কাটার সময় একটু ঘাড়ের নিচের থেকে কাটিস! যেনো দেখতে বড় দেখা যায়।’ কত বড় গোমরাহ! মৃত্যু সামনে উপস্থিত। কিন্তু তার দম্ভ এতটুকুও কমেনি।

বর্তমান ক্ষমতাধররা ক্ষমতার চেয়ারে বসে দম্ভ দেখায়। তারা গায়ের জোরে কোরআন-হাদিসের বিধান পরিবর্তন করে দিতে চায়। ফেরআউন যুগে যুগে আসে। ক্ষমতার দম্ভে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধানকে রহিত করে দিতে চায়। মনে রাখবেন, যেই জমিনের উপরে আপনি হুকুমত চালাচ্ছেন সে জমিনের নিচেও আরেকটা হুকুমত আছে। সেখানে কোনো চেয়ার নেই, সেখানে মাখলুকের কোনো হুকুমত চলে না, সেখানে হুকুমত চলে কেবল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার। আমার আপনার সবাইকেই একদিন সেখানে চলে যেতে হবে। যে চেয়ার রক্ষার জন্য এতোকিছু করছেন, সেই চেয়ার থাকবে। আপনি থাকবেন না। যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য রবের নাফরমানি করতে দ্বিধা করছেন না সেই ক্ষমতা ঠিকই থাকবে আপনি থাকবেন না। যাদের সন্তুষ্টি অর্জনার্থে এতো দম্ভোক্তি সেই কবর জগতে তাদের সন্তুষ্টি বিন্দুমাত্র কাজে আসবে না।

বর্তমানে আমরা একেবারে মুমূর্ষু না হলে আখেরাতের কথা মনেই করি না। ছেলে যখন দেখে যে, বাবার অবস্থা খারাপ তখন দৌড়ে মসজিদের হুজুরের কাছে আসে। ‘হুজুর! আব্বার অবস্থা খারাপ, তাড়াতাড়ি তওবা পড়িয়ে দেন’। অথবা পিতা নিজেই অস্ফুট কণ্ঠে বলে ‘হুজুরকে নিয়ে এসো, তওবাটা করে ফেলি’। কারণ, তখন মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়, মালাকুল মাউত হজরত আজরাঈল (আ.) তার ষোল কোটি দাঁত বের করে সামনে উপস্থিত হন। জাহান্নামের ভয়াবহতা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কিন্তু তখন তো তওবা কবুল হয় না। কারণ, না দেখে অদৃশ্যকে বিশ্বাস করার নাম ঈমান। দৃশ্যমান-এর উপর ঈমান আনাকে ঈমান বলে না। মৃত্যুর সময় তো ফেরআউনও ঈমান এনেছিল। মূসা (আ.)এর পশ্চাদ্ধাবন করে নীলনদে ডুবে মরার সময় অবস্থা বেগতিক দেখে সেও বলেছিল-‘আমি মুসা এবং হারুনের (আ.) রবের উপর ঈমান আনলাম’। কিন্তু তার ঈমান গ্রহণযোগ্য হয়নি! প্রতি উত্তরে আল্লাহ বলেছেন ‘এখন? অথচ একটু আগেই না নাফরমানি করলে? তুমি তো ফাসাদকারী ছিলে।’

সুতরাং এখন থেকেই আমাদের তাকওয়ার জিন্দেগী অবলম্বন করতে হবে। তাকওয়া খুবই সহজ একটা বিষয়। আল্লাহকে ভয় করা তথা সব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। গুনাহ এবং বান্দার মাঝখানে একটা বড় দেয়াল তৈরি করা। যেন বান্দা গুনাহের ধারে কাছেও যেতে না পারে। আর সেই দেয়ালটা হলো ‘আল্লাহর ভয়’ ও নেক আমলের। নিজের মনকে গুনাহ থেকে ফিরিয়ে রাখতে হবে। শয়তানের সব কুমন্ত্রণাকে পেছনে ফেলে আল্লাহকে রাজি খুশি করতে হবে। আল্লাহ নারাজ হন এমন কোনো কাজ করা যাবে না।

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে আল্লাহর সত্ত্বাকে ভয় করে নফসকে খাহেশাত থেকে মুক্ত রাখবে, তার ঠিকানা হবে চিরশান্তির জান্নাত।’ যখন আমরা আল্লাহকে ভয় করবো, তাঁর কুদরতের উপর ঈমান আনবো, তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলবো এবং নিজেকে এক আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দেব তখন আল্লাহও আমাদের হয়ে যাবেন। আমাদেরকে আল্লাহর রহমতের চাদরে ডেকে  নেবেন। সব গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। আমাদের সব প্রয়োজন আল্লাহ পুরা করে দেবেন। আল্লাহরাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে তাকওয়ার জিন্দেগী গঠন করার তাওফিক দান করুন। আমীন!

 

লেখক : পরিচালক, জামিয়া শায়খ আরশাদ মাদানী, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads