• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

মোহাম্মদ বিন কাসেম : সিন্ধু বিজয়ের ইতিবৃত্ত

  • প্রকাশিত ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ

 

 

 

ভারত উপমহাদেশে ইসলাম কথাটা শুনলেই যেন এক মহান বীরের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে ভেসে ওঠে। যার রণনৈপুণ্য ও শাসন কৃতিত্ব ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে। যেই মহান বীরের কৃতিত্ব ছেপে আছে ভারতবর্ষের প্রতিটি আঙিনায়। সেই মহান বীরের বীরত্বের কারণেই পৌঁছেছিল ভরতবর্ষে ইসলামের আলো| তিনি করছিলেন সিন্ধু বিজয়। যেই বিজয়ের ছায়াতলে ছিল উপমহাদেশে ইসলামের বসবাস। যার বিজয়ের সাথে আলিঙ্গন করে আছে প্রায় দেড় হাজার বছরের নানা ইতিহাস, কাহিনী। তিনি হলেন সেনাপতি মোহাম্মদ বিন কাসেম। যিনি সিন্ধু জয় করে ভারতে সর্বপ্রথম ইসলামী রাষ্ট্র স্থাপন করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়স্ক সেনাপতি বিন কাসেম তার স্বল্পকালীন শাসনামলে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবশ্রেণির মানুষের মধ্যে এক বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন এবং সবার মুখেই ছিল তাঁর নাম। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়াকালে হিন্দুরা পর্যন্ত কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল এবং তাকে ধর্ম দরদি সৈনিক বলে আখ্যায়িত করেছিল।

উপমহাদেশে ইসলাম : ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে সিন্ধু অভিযানের পটভূমিকা ও পরিণতির বিশদ বিবরণ রয়েছে এবং মুসলমানদের এ গৌরবময় অভিযানকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা যুগে যুগে প্রত্যক্ষ করা গেছে। সেনাপতি বিন কাসেম কেন সিন্ধু অভিযানে বের হয়েছিলেন তা সব পাঠকেরই জানা। তবুও না জানা থাকাটা খুব যে অবাস্তব; তা কিন্তু মোটেও না। কেননা, ইতিহাস পড়াটা অধিকাংশ পাঠকের কাছে বেকার ও বিরক্তিকর মনে হয়। যার দরুন আজ ইতিহাসের পাতাগুলো ঝরে ঝরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই সময়কে মূল্যের পাত্রে রেখে অতিসংক্ষেপে মোহাম্মদ বিন কাসেমের সিন্ধু অভিযানের কাহিনী ও তার বীরত্বের কথা স্মরণ করতে চাই।

ইসলামের গোড়ার দিকে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগের পরেই উমাইয়া শাসন আমলকে দেশ বিজয়ের দিক দিয়ে স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। বিশেষত আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের যুগ ও তার পরবর্তী কিছুকাল। সেই সময়ে বিশ্বের বিরাট এক এলাকাজুড়ে মুসলমানদের বসবাস। ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে ঘটে ভারতবর্ষের সিন্ধু অভিযান। যা বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধু প্রদেশ। মুসলমানদের এই সিন্ধু অভিযান ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম নিদর্শন। যেই বিজয়কে বাব-উল ইসলাম বা ইসলামের প্রবেশদ্বার বলা হয়। এই সিন্ধু প্রদেশের মধ্য দিয়েই ইসলাম বিস্তারের স্রোতধারা সূদুর চীন পর্যন্ত পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছিল। সিন্ধু রাজ্যে যে অসৎ রাজার অত্যাচার নির্যাতনে স্থানীয় অধিবাসীরা অতিষ্ঠ হয়েছিল তার নাম রাজা দাহির। পৌত্তলিকরাজা দাহিরের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয় উমাইয়া শাসনকর্তা ওয়ালীদ ইবনে আবদুল মালেকের আমলে। ওয়ালীদের নির্দেশে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ পরপর দুইটি অভিযান দাহিরের বিরুদ্ধে পরিচালনা করে ব্যর্থ হলেও তৃতীয় অভিযানে মুসলমানরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেন। এই অভিযানের প্রধান সেনাপতি ছিলেন মোহাম্মদ বিন কাসেম। তার বয়স ছিল তখন মাত্র ১৭ বছর। সতের বছরের মুসলিম সৈনিক।

সিন্ধু অভিযানে সর্বপ্রথম ওয়ালীদের অনুমতিক্রমে আবদুল্লাহ আসলামীকে ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে সিন্ধুরাজ দাহিরকে দমন করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করা হয়। কিন্তু দাহিরের সৈন্যদের হাতে আবদুল্লাহ পরাজিত ও নিহত হন। এরপর দ্বিতীয় অভিযান প্রেরণ করা হয় এবং তাতেও ব্যর্থ হন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। এসব অভিযানে ব্যর্থ হওয়ার পর হাজ্জাজ বুঝতে পারেন যে, দাহিরকে পরাজিত করা সহজ নয়। অতপর সর্বশেষ বিখ্যাত উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালি-বিন আব্দুল মালিকের শাসন আমলে পূর্বাঅঞ্চলের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেমের নেতৃত্বে শুরু হয় সিন্ধু অভিযান। মোহাম্মদ বিন কাসেমের নেতৃত্বে ছয় হাজার সৈন্যের একটি সিরীয় ও ইরাকী বাহিনী সিন্ধু অভিযানের জন্য প্রস্তুত করেন। মোহাম্মদ বিন কাসেমের সমপরিমাণে ঘোড়া ও উট ছিল। তিনি সৈন্যবাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। একভাগে তোপ গোলাবারুদ ও সৈন্যসহ সমুদ্র পথে রওয়ানা করেন এবং অপর ভাগে ছিল ঘোড়সাওয়ার জোয়ানরা। তিনিও এই বাহিনীতে থাকেন। মোহাম্মদ বিন কাসেম তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে বর্তমান পাকিস্তানের মাকরান অঞ্চল দিয়ে দেবলের দিকে অগ্রসর হন। ব্রাহ্মণ ও দুর্ধষ রাজপুতের দ্বারা সুরক্ষিত দেবল নগর অতি সহজেই মোহাম্মদ বিন কাসেমের দখলে চলে আসে। অতঃপর তিনি একে একে হায়দারাবাদের নিকট নিরুন শহর শিহওয়ান ও সিসতান দখল করেন। ইতোমধ্যে সিন্ধুরাজের অত্যাচারে জর্জরিত বহুসংখ্যক বিক্ষুব্ধ মেঠ ও মেঠ সৈন্য স্বেচ্ছায় মুসলিম বাহিনীতে যোগ দেয়। এই প্রাথমিক বিজয়ের পর মোহাম্মদ বিন কাসেমের সৈন্যরা বিপুল আনন্দ উৎসাহের মধ্যে অতি সুশৃংখলভাবে সিন্ধুনদ অতিক্রম করে রাওয়ারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। হিন্দুরাজ দাহির খবর পেয়ে পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের একটি বিরাট বাহিনী সিন্ধুনদের তীরে প্রেরণ করেন। ভোরে উভয়পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হয়। অত্যন্ত বীরত্বের সাথে উভয় সৈন্যদল কিছুক্ষণ লড়াই করার পর জনৈক আরব সৈন্য অগ্রসর হয়ে রাজা দাহিরকে হত্যা করে।

সিন্ধুরাজ নিহত হওয়ার পর তার বিপুল বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করতে শুরু করে এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের দিকে ধাবিত হয়। মোহাম্মদ বিন কাসেমও তাদের ধাওয়া করতে করতে ব্রাহ্মণ্যবাদে উপনীত হন এবং সেখানে আরো একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর উক্ত স্থান মোহাম্মদ বিন কাসেম দখল করেন। এই যুদ্ধে রাজা দাহিরের বিধবা পত্নী রাণী রাঈয়ের নেতৃত্বে হিন্দুসেনারা কিছুক্ষণ মোকাবিলা করলেও পরিণামে শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে। রাণী অগ্নিকুণ্ডে আত্মহুতি দিয়ে পরাজয়ের গ্লানি হতে রক্ষা পান এবং ব্রাহ্মণবাদের আধিবাসীরা বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় মোহাম্মদ বিন কাসেমের নিকট আত্মসমর্পণ করে। সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের পথপ্রশস্ত হয়ে যায়। সেনাপতি মোহাম্মদ বিন কাসেম ৭১২ থেকে ৭১৫ খ্রিষ্টাব্দে অবধি প্রায় তিন বছরের শাসন আমলে স্থায়ী মানুষের সাথে সদয় আচরণ ও ইসলামী শাসনব্যবস্থা সুসংহত করেন। তার এ রাষ্ট্রই ছিল ভারতবর্ষে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র।

 

লেখক : তালেবে ইলম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads