• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯
ইসলাম শিক্ষায় আধুনিক বিজ্ঞানের সমাধান

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ইসলাম শিক্ষায় আধুনিক বিজ্ঞানের সমাধান

  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ইসলামী শিক্ষার সর্বপ্রথম শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। ফেরেশতারা বলেছিল, ‘হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র! আপনি যা শিখিয়েছেন, তাছাড়া আমাদের আর কোনো জ্ঞান নেই; নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-৩২) জ্ঞান অর্জনকে ইবাদত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে ইসলামী বিধানে। আমরা মুসলমান, ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ, ইসলামী শিক্ষাই বর্বর মানুষকে সোনার মানুষে পরিণত করতে পারে। মূলত যে জ্ঞানের সাহায্যে সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত কোরআনের বিশেষ জ্ঞান সম্পর্কে জানা যায় এবং যে শিক্ষালব্ধ জ্ঞানের দ্বারা মানুষ স্বীয় আত্মাকে ও মহান স্রষ্টা আল্লাহতায়ালাকে জানতে, বুঝতে ও চিনতে পারে তাই হলো ইসলামী শিক্ষা।

মানবীয় গুণাবলির বিকাশ সাধনপূর্বক আল্লাহপ্রদত্ত বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করার জন্য ইসলামী শিক্ষা অত্যন্ত আবশ্যক। ইসলামী শিক্ষা তথা শিক্ষার সর্বাত্মক গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কারণেই আল্লাহতায়ালা তাঁর সৃষ্ট প্রথম মানবকে সর্বপ্রথম শিক্ষাদান করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং তিনি আদমকে যাবতীয় বস্তুর নাম শিক্ষা দিলেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-৩১) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হেরা গুহায় প্রথম যে প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত হন তাও ছিল ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়ো, দিয়ে আরম্ভ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,  ‘আল্লাহ যার দ্বারা কল্যাণ কামনা করেন, তাকে দীনের জ্ঞান দান করেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের (অতিন্দ্রীয়) জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের (উপযুক্ত) মর্যাদায় উন্নীত করবেন। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে সম্যক অবগত।’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত-১১)

ইসলাম একটি জীবনবিধান। শিক্ষা জাতীয় উন্নয়নের সোপান। শিক্ষা ইসলামের অন্যতম মূলভিত্তি। শিক্ষা ছাড়া ভালো মানুষ হওয়া যায় না। শিক্ষা ছাড়া ভালো মুসলমান বা ইনসানে কামিল হওয়া যায় না। শিক্ষা ছাড়া পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার বান্দা হওয়া যায় না। ইসলামের প্রথম বার্তা ছিল, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক, আয়াত-১) রাব্বুল আলামীনের এ বার্তা থেকেই বোঝা যায়, মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে শিক্ষার গুরুত্ব। কোরআন কারীমে রয়েছে শিক্ষাসংক্রান্ত প্রচুর আয়াত। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সত্যকে জানা, উপলব্ধি করা ও উদ্ঘাটন করা যায়। মানুষের জন্যে আল্লাহর অবদানের শ্রেষ্ঠ দান হলো জ্ঞান। কিন্তু এই জ্ঞানকে কাজে না লাগালে তার কোনো মূল্যই থাকে না। কোরআনের সুরা ফাতিরের ২৮নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে,  ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শুধু জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে।’ এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, ‘যে জ্ঞানী সে যেহেতু আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে অভিহিত সেহেতু সে আল্লাহকে ভয় করা বা তার প্রতি অনুগত থাকাকে করণীয় কর্তব্য বলে ভাবে।

মানুষ যতই শিক্ষা অর্জন করে তার আকাঙ্ক্ষা যেন আরো বেড়ে যায়। এজন্য আল্লাহতায়ালা কোরআনে ঈমানদারদের জ্ঞান প্রার্থনার কথা বলেছেন, ‘হে প্রভু! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও।’ (সুরা তোহা, আয়াত-১১৪) এই প্রার্থনার উদ্দেশ্যই হচ্ছে, জ্ঞান অর্জনের মন-মানসিকতাকে জাগ্রত করা এবং জ্ঞানের ক্রম-প্রসার বৃদ্ধি করা। তবে শিক্ষা হতে হবে সর্বদিক দিয়ে মানব-কল্যাণমুখী ও সত্যাশ্রয়ী। যদি তা না হয় তাহলে মানুষ কুশিক্ষা ও কুসংস্কারকে গ্রহণ করে নীতি ও জ্ঞানশূন্য এবং বিবেকবর্জিত ব্যক্তিতে পরিণত হবে। এর ফলে দিন দিন ভালো কাজের সংখ্যা কমে যাবে এবং খারাপ কাজ বৃদ্ধি পাবে। আর তখনই মানুষের পদস্খলন ঘটবে। সুতরাং সৎশিক্ষা ও সঠিক জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

ইসলাম আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষায় বিরোধী নয়; বরং ইসলামী জ্ঞান তথা  কোরআন-হাদিস যেমন শিক্ষণীয়, তদ্রূপ আধুনিক জ্ঞান অর্জন করাও দরকার। এই দুটির কোনো একটিকে বাদ দিলে চলবে না। ইসলামের স্বর্ণযুগে মসজিদে কোরআন, হাদিস ও ফেকাহর ওপর আলোচনার পাশাপাশি রসায়ণ, পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভেষজবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপরও আলোচনা হতো। কেননা, ইসলামের স্বর্ণযুগে মসজিদই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলাম আধুনিক শিক্ষাবিস্তারেও এক কালজয়ী ভূমিকা পালন করেছে ইতিহাস আজো যার সাক্ষী। জ্ঞান অর্জন করতে যেমন উৎসাহ দিয়েছে ইসলাম। তদ্রূপ জ্ঞান বিতরণ করতেও কখানো পিছপা হয়নি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তাঁর থেকে সাহাবীরা শিক্ষা গ্রহণ করে পৃথিবীর দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। কোরআন এমন একটি আসমানী মহাগ্রন্থ, যা মানবজাতির জ্ঞানের সব তৃষ্ণাকে মেটাতে পারে। অতএব,  কোরআন থেকে আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের বহু জটিল সমস্যার সমাধান পেতে পারি। এ ছাড়া একটি উন্নত ও কল্যাণমুখী সমাজব্যবস্থাও গড়ে তুলতে পারি।

সব মানুষ আলিম, হাফিজ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকিহ এবং মুফতি হবেন না। জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়েও মুসলমানদের হতে হবে বিশেষজ্ঞ। যেমন তাদের মধ্যে থাকবেন বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, প্রশাসক ইত্যাদি। এরা হবেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের একে অপরের পরিপূরক। যিনি যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, অন্যরা সে বিষয়ে তার শরণাপন্ন হবেন। তার পরামর্শ নেবেন। এ জন্য আধুনিক শিক্ষাকে ইসলামী মূলভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হলে তাদের ঈমান সুদৃঢ় হওয়ার পাশাপাশি তারাও ইসলামের আলোকে অনেক বিষয়ের সহজ সমাধান দিতে পারবেন। আর এটা কোনো কঠিন বিষয়ও নয়।

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে দেখা যায়, শিক্ষার মূলভিত্তি হতে হবে তাওহিদ। অর্থাৎ শিক্ষার উৎস যিনি, তাঁর একত্ববাদই হবে শিক্ষার মূলভিত্তি। কারণ আল্লাহপাক পড়তে বলেছেন, খালিক অর্থাৎ স্রষ্টার নামে। তাওহিদি শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থাকবে রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাস। আর তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, প্রতিটি শিক্ষা ধর্মীয় শিক্ষাই হোক বা আধুনিক শিক্ষা এর মূলভিত্তি হতে হবে তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। তাওহিদি শিক্ষা মানুষকে সৎ, নীতিবান, নেক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। যাতে থাকে ভালো মানুষের প্রতিটি উপাদান। তাই প্রতিটি বিষয়কে ইসলামের মূল উৎস কোরআন ও হাদিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা গেলে গোটা দেশ ও জাতি, এমনকী বিশ্ব উপকৃত হবে। কারণ কোরআনে সব বিষয়ের মূল নির্দেশনা রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে সেগুলো উন্মোচিত করা প্রয়োজন। বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, কোরআনের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই; বরং কোরআনে বিজ্ঞানের প্রচুর উপাদান রয়েছে, যা আজ স্বীকৃত। চিকিৎসাবিজ্ঞানেও দেখা যায় একই চিত্র। অর্থনীতি, সমাজনীতি, লোকপ্রশাসন, ভাষা-সাহিত্যসহ প্রচলিত সব বিষয়ে দিক নির্দেশনা রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। আল্লাহরাব্বুল আলামীন কোরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন, ‘আমি মুসলমানদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, হিদায়াত (দিক নির্দেশনা), রহমত ও সুসংবাদ হিসেবে আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি।’ (সুরা নাহল, আয়াত-৮৯) পশ্চিমা শিক্ষাবিদরা কোরআন থেকেই গবেষণার অনেক উপাদান গ্রহণ করেছেন এবং সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনেক এগিয়ে গেছেন।

আমরা শিক্ষার উৎস সন্ধান করলেও এর বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হব। পাশাপাশি এও প্রমাণিত হবে, ইসলাম ও শিক্ষার পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীরে। বিশেষ করে ইসলামের মূলকথা হলো সব মুসলিমকে অবশ্যই কমবেশি শিক্ষিত হতে হবে। কারণ শিক্ষাবিহীন মানুষ কুসংস্কারের দিকে ধাবিত হয়। আর ইসলামবিহীন শিক্ষা মানুষকে পরিণত করে প্রাণহীন মানুষে। এর মাধ্যমে মানুষ হয়ে পড়ে স্বার্থনির্ভর। জাগতিক উৎকর্ষ সাধনে তারা বৈধ-অবৈধের তোয়াক্কা করে না। নীতি-নৈতিকতা ভুলে শুধু ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়। তাই শিক্ষার উৎস সন্ধান করলে আমরা একটা মহাসত্য আবিষ্কারে সক্ষম হব। আর তা হলো শিক্ষার উৎস হলেন স্বয়ং স্রষ্টা মহাজ্ঞানী আল্লাহ। আর তাই আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক জ্ঞানীর ওপর আছেন এক মহাজ্ঞানী।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত-২৬) তিনি জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য তাঁর কাছে দোয়া করতে বলছেন এভাবে, ‘হে আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ কর।’ (সুরা ত্বহা, আয়াত-১১৬)

বান্দার জ্ঞান হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষমতা একমাত্র রয়েছে তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। শিক্ষার মহান শিক্ষক তিনিই। হজরত আদমকে তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আর তিনি (আল্লাহ) আদমকে শিক্ষা দিয়েছেন যাবতীয় সব নাম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-৩১) তিনি মানবজাতিকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং শিক্ষা দিয়েছেন বর্ণনাশৈলী। মহাবিশ্বের মহাজ্ঞানী একমাত্র খালিক আল্লাহ। মাখলুক মানুষের পক্ষে সব জ্ঞান আয়ত্ত করা কখনোই সম্ভব নয়। কোনো একটি বিষয়ে হয়তো পাণ্ডিত্য অর্জন করা যেতে পারে। কিন্তু সে একই বিষয়ের যাবতীয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। এ জন্যই প্রস্তাবনা হলো সব শিক্ষাকে ইসলামী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। তা হলেই কেবল ভালো মানুষ গড়ার মাধ্যমে ভালো সমাজ গড়া সম্ভব হবে। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন!

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

লেখক : কামিল হাদিস, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

কো-চেয়ারম্যান, হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads