• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

উমর মুখতার : লায়ন অব দ্য ডিজার্ট

  • প্রকাশিত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুজীব রাহমান

 

 

 

উমর মুখতার। বিপ্লবী, সাহসী ও লড়াকু এক কিংবদন্তির নাম। তাঁর বয়স তখন ৭৩ বৎসর। ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনী তাঁকে ঝুলিয়ে দিল ফাঁসির কাষ্ঠে। তিনি পান করলেন শাহাদাতের অমীয় সুধা।

উমর মুখতার ১৮৫৮ সালের এক রৌদ্রমাখা আলো ঝলমল দিনে জন্মগ্রহণ করেন লিবিয়ার সিরেনাইকা অঞ্চলের হতদরিদ্র সম্ভ্রান্ত পরিবারে। শৈশব পেরিয়ে উমর মুখতার পা রাখেন কৈশরে। স্বপ্নের ডানা মেলে উড়তে থাকেন তার রঙ্গীন ভুবনে। সজীব প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভরপুর তার তারুণ্য। হঠাৎ ভাটা পড়ে তার তারুণ্যে। পাখির বাসার মতো সুন্দর সংসারটা এতদিন যে মানুষটা খুব যত্ন করে আগলে রেখেছিলেন সেই মানুষটা বিদায় নিলেন দুনিয়া থেকে। কৈশরে বাবাকে হারিয়ে কেমন যেন নিষ্প্রাণ নির্জীব হয়ে গেলেন উমর মুখতার। কিছুই ভালো লাগে না। সবসময় তাঁর প্রিয় বাবাজিকে মনে পড়ে। সন্ধ্যাতারা, সকালের শিশিরকণা, সবুজ ঘাষ, মরুভূমির ধূসর বালুস্তূপ কোনো কিছুই এখন আর আগের মতো স্পর্শ করে না তাকে। বাবার মৃত্যু সংসারের অভাব-অনটনকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে কৈশরের দীর্ঘ সময় কাটে তার ছন্নছাড়া অবস্থায়। কৈশরের শেষের দিকে তার পরিচয় হয় তারই শহরের এক প্রথিতযশা আলেমের সাথে। সে তার দায়ভার গ্রহণ করেন এবং তিনি তার কাছেই  কোরআনের হিফজ ও দীনি ইলম শিক্ষাগ্রহণ করেন।

হিফজ পরবর্তী জীবনে আমৃত্যু শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও পবিত্র কোরআন খতম দিতেন। তিনি তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেন না। রাতের শেষ তৃতীয়ভাগে তিনি ঘুম থেকে উঠে আল্লাহর জিকির-আজকার, কোরআন তেলাওয়াত ও তাহাজ্জুদ পড়ে কাটিয়ে দিতেন। এটা ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন। তিনি মানুষের কাছে একজন নিরহংকার ও অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। তার জীবন কেটেছে কঠোর দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে। সবকিছুকেই তিনি মধুরভাবে বরণ করে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন গভীর প্রজ্ঞা, কঠিন হিম্মত ও প্রবল বীরত্বের অধিকারী। যুবকদের জন্য অনুকরণীয় ও রোল মডেল।

মরুসিংহ উপাধি : ইতিহাসের পাতায় উমর মুখতারের নাম তখনই খোদাই হয়ে যায়, যখন সে তার জীবনের মায়া ত্যাগ করে অত্যন্ত বীরত্বের সাথে তার জনগণ, তাদের ধন-সম্পদ ও মাতৃভূমি রক্ষার জন্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন। তখন তিনি টগবগে যুবক। তার কাফেলাকে নিয়ে ভ্রমণে বের হলেন সুদানের দিকে। যেপথ ধরে তারা অগ্রসর হচ্ছিলেন তা ছিল খুবই ভয়ংকর এক পথ। এপথে যাতায়াত মানে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনা। কারণ এটা ছিল ভয়ংকর এক সিংহের যাতায়াতের রাস্তা। তিনি সবাইকে অভয় দিয়ে চলতে লাগলেন সামনের দিকে। হাতে শর্টগান নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে তিনি সিংহের পেছনে ছুটলেন। সিংহকে হত্যা করে ফেললেন চোখের পলকেই। তখন থেকেই উমর মুখতার ‘লায়ন অব দ্য ডিজার্ট’ তথা মরুসিংহ উপাধিতে মানুষের মুখে প্রসিদ্ধি পেয়ে গেলেন।

স্বৈরাচারীদের দখলদারিত্ব : ১৯১১ সাল। ইতালিয়ানরা যখন বিচ্ছিন্ন অটোমান খলিফাদের থেকে লিবিয়াকে দখল করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন উমর মুখতারের বয়স তিপ্পান্নর কাছাকাছি। ইতালির তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে পরিচালিত লিবিয়া আক্রমণকে ‘রুমান রিকনকুইস্তা’ নামে অবহিত করে। যার অর্থ ‘পুনরায় উদ্ধার করা’। ওই সব ভূমিকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসা, যা একসময় রোমানদের ছিল। তারা একসময় জোরপূর্বক জমি দখল করে নেয়। তাদের এই অবৈধ দখলদারিত্ব উমর মুখতারকে ভীষণ উদ্বিগ্ন করে তুলে। যা সম্পূর্ণ জোরপূর্বক ও অমানবিকভাবে তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। উমর মুখতার কোনোভাবেই তা সহ্য করতে পারছিলেন না। প্রতিশোধের আগ্নেয়গিরি তার  ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগছিল। তিনি নিজ জাতির অধিকার আদায় করার জন্য জালেম ও স্বৈরাচারদের বিরুদ্ধে লড়াই করাকে আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব মনে করলেন। এরপর থেকেই ইতালীয় ঔপনিবেশিক বাহিনী ও উমর মুখতারের নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনীর মধ্যে একের পর এক যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে।

যেভাবে প্রতিরোধ গড়েছিলেন : তার গেরিলা যুদ্ধের দক্ষতা, প্রতিরোধ শক্তির ক্ষমতা, প্রবল সাহস, গভীর আগ্রহ ও উদ্দীপনা তার দলকে ওই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর অন্যতম সৈন্যবাহিনী হিসেবে ইতিহাসের খাতায় নাম লেখিয়েছিল। তার বিপরীতে ইতালিয়ানদের উৎকৃষ্ট ও অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র তার অর্ধেক বয়সী সৈন্যগুলো লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ইতালিয়ান ট্যাংক এবং এরোপ্লেনের বিরুদ্ধে উমর মুখতারের সক্রিয় যোদ্ধার সংখ্যা ছিল মাত্র ১০০০ থেকে ৩০০০। তাদের কাছে ভারী তেমন কোনো অস্ত্রও ছিল না। অধিকাংশের অস্ত্রই ছিল হালকা-পাতলা। তারা প্রায় প্রতিদিনই মুসোলিনের বাহিনীকে পরাস্ত করতেন। তারা এক বৎসরে ২৫০ টিরও বেশি লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিলেন। ইতালিয়ান ফ্যাসিস্ট সরকার এটাকে প্রতিরোধ করার জন্য সাধারণ জনগণকে টার্গেট করে। কনসেনট্রেশান ক্যাম্প গঠন করে।

১৯৩০ সালে ইতালিয়ান সরকার ১ লাখ বেদুইন পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে ক্যাম্পে একত্রিত করে। যা সেই সময়ের সেরিনাইকার আদিবাসী জনগণের অর্ধেক ছিল। যেখানে অনেকেই মারা গিয়েছিল। এটা ছিল অনেকটা বর্তমান সময়ে ইসরায়েলের যুদ্ধের জন্য ফিলিস্তিনে অভিগমনের মতোই। ইতালিয়ানরা যুদ্ধে যতবার ক্ষতিগ্রস্ত হতো তারা ততবারই জনগণের ওপর আগের তুলনায় অত্যাচার, নিপীড়নের পরিমাণ বাড়িয়ে দিত। ২০ বছর পর তাকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ইউরোপীয়দের সাথে পরাজয়বরণ করতে হয়েছিল। মূলত এর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ভবিষ্যতে (জান্নাতে) তার মর্যাদাকে উন্নীত করতে এবং পার্থিবজীবনে তার বীরত্বপূর্ণ পদমর্যাদাকে অমর করে রাখতে চেয়েছেন।

তিনি ১৯৩১ সালে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সৈন্যের হাতে আহত ও গ্রেপ্তার হন। তিনি বন্দি অবস্থায় প্রতিরোধ তুলে নেওয়ার জন্য ইতালিয়ান সরকারের কাছ থেকে লোভনীয় প্রস্তাব পান। কোনো অবস্থাতেই তিনি প্রতিরোধ তুলে না নেওয়ার কথা সরকারকে বলিষ্ঠকণ্ঠে জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি দু মর্যাদা অর্থাৎ শহীদ হওয়া বা বিজয়ী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করব ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ চালিয়েই যাব। আমি আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলছি, যিনি আমার হূদয়ের সবকিছু জানেন। এই মুহূর্তে যদি আমার হাত বাঁধা না থাকত তাহলে খালি হাতে হলেও তোমাদের সাথে লড়াই করতাম। ফাঁসিতে ঝুলানোর আগে তাকে বলা হলো, সে তার যে কোনো অন্তিম ইচ্ছার কথা জানাতে পারে। প্রতি উত্তরে তিনি  কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন ‘ইন্নালিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ তার শেষ পরিণতি দেখার জন্য বিশ হাজার বন্দি এবং সিরেনাইকা নাগরিকদের বাধ্য করা হয়েছিল। উমর মুখতার তার বেশ কিছু উক্তির জন্য আজো খুবই বিখ্যাত। যা তার চরিত্রের নির্ভীক, দুঃসাহসী, সাহসিকতাপূর্ণ চিত্রটি ফুটিয়ে তোলে।

তার বিখ্যাত উক্তি : ‘আমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে আত্মসমর্পণ করি না। আমরা হয় বিজয় লাভ করি, না হয় শাহাদাত বরণ করি।’ উমর মুখতার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামের মূলনীতি ধারণ করার জন্যও সুপরিচিত ছিলেন। একবার তিনি দুজন জীবিত ইতালিয়ানকে বন্দি করে তাদেরকে বলেছিলেন আমরা কোনো বন্দিকে হত্যা করি না। তখন তার সাথীরা বলল, তারা তো আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করে। তখন তিনি তার সাথীদেরকে উত্তর দিয়েছিলেন, তারাতো আমাদের শিক্ষক নয়।

প্রতিরোধের প্রতীক : প্রকৃতপক্ষে আজকের মুসলিমবিশ্বের এ সংকটপূর্ণ সময়ে উমর মুখতার মুসলমানদের জন্য প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। বর্বর স্বৈরশাসক যখন জনগণের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালায়, মুসলমানদের ওপর অন্যায়, অবিচার, জুলুম নির্যাতন শুরু করে তখন তিনি বসে না থেকে পূর্ণ সাহসিকতার সাথে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি জালেমদের সামনে উদাহরণস্বরূপ পেশ করেছিলেন, ‘সামান্য দলই বিরাট দলের মোকাবিলায় জয়ী হয়েছে আল্লাহর হুকুমে। আর যারা ধৈর্যশীল আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৪৯)

বর্তমান সময়ে মুসলিম তরুণদের জন্য উমর মুখতারের সৈনিকদের জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শত্রুদের হাত থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকের শিকল থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষাকরণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অপশক্তির বিরুদ্ধে সত্য কথার সৎসাহস থাকতে হবে। উমর মুখতার শুধু লিবিয়া কিংবা আরব বিশ্বেই উচ্চারিত নাম নয়। আজ তিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদের চেতনার অগ্রপথিক। (ইংরেজি থেকে ছায়ানুবাদ)

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads