• শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

মাতৃভাষাকে পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি দিয়েছে ইসলাম

  • প্রকাশিত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

তারেক সাঈদ

 

 

পৃথিবীতে মানুষকে মুখের ভাষা দেওয়া হয়েছে। মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে ভূষিত হওয়ার যেসব যোগ্যতা ও গুণাবলি রয়েছে ভাষাও তার মধ্যে একটি। জন্মের পরই মানুষ হাঁটতে, খেলতে, কিংবা কথা বলতে শিখে না। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর তার শ্রুতিশক্তির বলে মা-বাবার শেখানো বা তাদের মুখনিঃসৃত বাণী আত্মস্ত করতে শিখে। ফলে একসময় বাকশক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘মা’ ‘বাবা’ ‘দাদা’ ‘আল্লাহ’ ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে। মায়ের কাছ থেকে এ ভাষা শিখে বিধায় এর নাম হয়েছে মাতৃভাষা। মায়ের ভাষার কথা বলা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মাতৃভাষা মহান আল্লাহর অপার দান। এ ভাষা দিয়ে মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে। তাই ইসলাম মায়ের প্রতি যেমন অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিয়েছে, তেমনি মাতৃভাষার প্রতিও অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাব (ভাষা) প্রকাশ করতে শিখেয়েছেন’। (সুরা আর-রাহমান, আয়াত-৩, ৪) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম, আয়াত- ২২)

মানুষ মাতৃভাষায় যতটা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে ভিন্ন ভাষায় ততটা সাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। এ যেন আত্মার বন্ধন। এ বন্ধন জীবন উৎসর্গের মতো ঘটনা ও রচনা করেছে। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরকে নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যদিও ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক দিয়ে ছিল ভিন্নতা। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বীয় মাতৃভাষাকে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চালায়। তাদের এ চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল ছাত্রজনতা মাতৃভাষার টানে রাজপথে নেমে এসেছিল। পুলিশের বুলেটের সামনেও তাদের মাতৃভাষাকে পদানত করতে দেয়নি। মাতৃভাষার এ অকৃত্রিম ভালোবাসাকে স্মৃতিময় করতে ২০০০ইং সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

মাতৃভাষার প্রতি এ অম্লান ভালোবাসার পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি ইসলাম দিয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা সব নবী-রাসুলকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। যাতে তারা স্বীয় জাতিকে দীনের দাওয়াত স্পষ্টভাবে পৌঁছাতে পারেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কোরআনে কারীমে ইরশাদ করেন, ‘আমি রাসুলগণকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের (দীন) স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত-৪) সব ঐশী ধর্মগ্রন্থ স্ব-স্ব জাতির মাতৃভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা জানি, তাওরাত কিতাব ইবরানি ভাষায় হযরত মুসা (আ.)-এর ওপর নাজিল করা হয়। জাবুর কিতাব ইউনানি ভাষায় হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর নাজিল করা হয়। ইঞ্জিল কিতাব সুরিয়ানি ভাষায় হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর নাজিল করা হয় এবং সর্বশেষ আসমানি কিতাব কোরআন আরবি ভাষায় সর্বশেষ নবী ও রাসুল মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাজিল করা হয়। অনুরূপভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল-কোরআনও আরবি ভাষায় নাজিল করার কারণ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা স্বয়ং ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘ইহা আমি অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত-২)

যুগে যুগে ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিতে গিয়ে নবী-রাসুলগণ এবং পরবর্তী মনীষীগণ তাদের উম্মতদের মাতৃভাষার বিশুদ্ধতা ও প্রাঞ্জলতা অর্জনকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বনি ইসরায়েলের জন্য হজরত মুসা (আ.)কে নবী ও রাসুল হিসেবে ঘোষণা করলেন; আর তখন তিনি তাঁর ভাই হজরত হারুন (আ.)কে নবী ও রাসুল হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আল্লাহর সমীপে আবেদন করে বললেন, ‘আমার ভাই হারুন সে আমার অপেক্ষা সুস্পষ্ট ভাষী, অতএব তাকে আমার সাহায্যকারীরূপে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে। আমি আশঙ্কা করি, তারা আমাকে মিথ্যবাদী বলবে।’ আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমার ভ্রাতার দ্বারা তোমার বাহু শক্তিশালী করব এবং তোমাদের উভয়কে প্রাধান্য দান করব। তারা তোমাদের নিকট পৌঁছাতে পারবে না, তোমরা এবং তোমাদের অনুসারীরা আমার নিদর্শন বলে তাদের ওপর প্রবল হবে।’ (সুরা কাছাছ, আয়াত-৩৪,৩৫)

মাতৃভাষার প্রতি ইসলাম যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেছে। সব মাতৃভাষা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান। দয়াময় আল্লাহ যার মুখে লালিত্যপূর্ণ ভাষা দিয়েছেন, মনের ভাব শব্দে প্রকাশে বাকশক্তি দিয়েছেন সে বড় ভাগ্যবান। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাই বলেছেন, ‘নিশ্চয় ভাষাশৈলীতে জাদু রয়েছে।’ (বুখারি-৫১৪৬) অর্থাৎ ভাষার যে জাদুকরি প্রভাব রয়েছে তা অনস্বীকার্য। তাই মানুষকে আল্লাহর সব নেয়ামতের সঙ্গে ভাষার নেয়ামতেরও যথার্থ মূল্যায়ন করা উচিত। ভাষার নেয়ামতের কদর করা মানে অশুদ্ধ শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ না করা, মিথ্যা বাক্য ব্যবহার না করা, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা, মাতৃভাষায় সৎকাজের আদেশ আর অসৎকাজে নিষেধ করা এবং ভাষার অপপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ মাতৃভাষায় বিশুদ্ধতা অর্জনের ফলে গর্ববোধ করে বলেছিলেন, ‘আমি আরবদের মাঝে সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষী। উপরন্তু আমি কুরাইশ বংশের লোক।’ ইসলামের আলোকে শিক্ষা ও উপদেশদানের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ মাতৃভাষার চর্চা, দক্ষতা, প্রাঞ্জলতা ও বিশুদ্ধতা অর্জন অত্যন্ত প্রয়োজন। বাংলা ভাষা তথা আমাদের মাতৃভাষা আজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন এ ভাষাতে ইসলাম চর্চা আরো ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হবে। ইসলাম যেমন আরবীয় মরু অঞ্চল পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল ঠিক তেমনি বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষার মাধ্যমে আমরা ইসলামের চর্চাকে বিশ্বব্যাপী আরো সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হবো।

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads