• রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও শিক্ষা

  • প্রকাশিত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুফতি ইসমাইল মানসূর

 

 

 

১৯৪৭ সালে ইংরেজদের দুঃশাসনের কবল থেকে ভারত উপমহাদেশ মুক্তিলাভ করে। পৃথিবীর মানচিত্রে পুরনো দুটি নাম অঙ্কিত হয় নতুন করে। একটি পাকিস্তান আরেকটি ভারত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিন থেকে মোটামুটি তিনটি সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দেয়- ১. বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ; ২. বিভিন্ন প্রদেশ কতখানি স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে তা নিশ্চিত করে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন; ৩. অর্থনৈতিক বৈষম্য।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানের জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন- Urdu and Urdu shell be the state language of Pakistan. অর্থাৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং একমাত্র উর্দু। একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষাকে অস্বীকার করে সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার মতো নোংরা স্লোগানকে ‘নো নো’ বলে সেদিন সাহসী বাঙালি তরুণেরা জিন্নাহর মুখের ওপর ছুড়ে মারে এবং মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবিতে বাঙালি তরুণ, ছাত্র-জনতা ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় রাজপথে নেমে আসে। সারা বাংলায় দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সে আন্দোলন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ববাংলা মুসলিম আওয়ামী লীগ (পরে মুসলিম শব্দটি কেটে দেওয়া হয়) নামে পাকিস্তানের প্রথম রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। শেখ মুজিব ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ তখন দলের যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়। মৃত জিন্নাহর প্রেতাত্মা খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলে ঝিমিয়ে পড়া ভাষা আন্দোলন হয়ে ওঠে আরো তীব্র। আরো প্রতিবাদমুখর। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি দেশব্যাপী আন্দোলন করার জন্য আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, খেলাফতে রব্বানী পার্টি, মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ, তমুদ্দিন মজলিস ও বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটিসহ আরো অনেকগুলো মূল ও শাখা সংগঠনের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা আজাদ সুবহানি, আবুল হাশিম, আতাউর রহমান খান, তোয়াহা, অলি আহমেদ প্রমুখ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আহূত হরতালের প্রেক্ষিতে জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সেদিন ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। বিকাল ৩টায় মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশ বাহিনী আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। নির্মমভাবে শহীদ হয় বাংলার দামাল ছেলেরা- রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকেই। শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার পিচঢালা রাজপথ। ঢাকায় তখন পাকিস্তান গণপরিষদে বৈঠক চলছিল। পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার সংবাদ পৌঁছানো মাত্রই গণপরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ তুমুল প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, আমাদের ছাত্ররা শাহাদতবরণ করেছে আর আমরা আরামে বসে পাখার হাওয়া খেতে থাকব, এটা বরদাশত করা যায় না। আগে চলুন কোথায় হত্যাকাণ্ড হয়েছে দেখে আসি। তারপর অ্যাসেম্বলি চলবে এর আগে অ্যাসেম্বলি চলতে দেব না। ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন ২২ ফেব্রুয়ারি গণআন্দোলনে পরিণত হয়। ২১ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়। এ সময় বিভিন্ন মহল থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার নাছোড় দাবি আসতে থাকে। ঐতিহাসিক তথ্য মতে ১৯৫২ সালের ১৮, ১৯, ২০ মার্চ কিশোরগঞ্জের হজরত নগরে মাওলানা আতহার আলী (রহ.)-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ঐতিহাসিক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবাদির একটি ছিল- চতুর্থ প্রস্তাব : খ. পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের এ সম্মেলন পাকিস্তান গণপরিষদের কাছে দৃঢ়তার সহিত দাবি জানাইতেছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা হোক। (হায়াতে আতহার, পৃষ্ঠা- ১৩৮-১৩৯)

প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব প্রথিতযশা ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ১২ শ্রাবণ সংখ্যায় এক প্রবন্ধে লেখেন, ‘বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব। নতুন কোনো ভাষা আরোপ করা পূর্ববঙ্গে গণহত্যার শামিল হইবে।’ এভাবে বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র প্রতিবাদ আসতেই থাকে। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের মুখে পড়ে কোনো উপায়ন্তর না দেখে অবশেষে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পাকিস্তান গণপরিষদে একটি বিল আনয়নের প্রস্তাব প্রাদেশিক গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। উক্ত তারিখে গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে উর্দু ও বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

শিক্ষা : ১. বাংলা ভাষার জন্য আমাদের ভাইয়েরা যেদিন রক্ত দিয়েছে, শহীদ হয়েছে- সে দিনটি ছিল ৮ ফাল্গুন। তাই তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের দিনটিকে ২১ ফেব্রুয়ারির নাম দিয়ে পালন না করে ৮ ফাল্গুন নামে পালন করাই বাঞ্ছনীয়। (যদি পালন করতেই হয়) এতে তাদের আত্মত্যাগ হবে সার্থক। অন্যথায় শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নামে হবে জাতীয় প্রতারণা ও তাদের রক্তের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। ২. অন্য যেকোনো ভাষার আগে প্রথমে মাতৃভাষায় দক্ষতা ও পাণ্ডিত্য অর্জন করা। ৩. সর্বত্র মাতৃভাষার ব্যাপক চর্চা অনুশীলন ও বাস্তবায়নের প্রতি যত্নবান হওয়া। ৪. মাতৃভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার মাধ্যমে বাংলা ভাষার নেতৃত্ব অর্জন করা। ৫. মাতৃভাষাকে বিজাতীয় আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা।

তথ্যসূত্র : ১. রহমানি পয়গাম ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ১৯৯৯); ২. আল আশরাফ ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ২০১১; ৩. মিম্বরের ধ্বনি; ৪. একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে; ৫. স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা।

 

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন, মোমেনশাহী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads