• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
আদর্শ জাতি গঠনে ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

আদর্শ জাতি গঠনে ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব

  • প্রকাশিত ১০ মার্চ ২০২১

সিনথিয়া সুমি

‘শিক্ষাই আলো’ ‘সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ সুশিক্ষিত জাতি আগামীর ভবিষ্যৎ। মানব সভ্যতার বয়স যতদিন, শিক্ষার বয়সও ততদিন। কারণ মানুষকে সৃষ্টিকর্তা একজন জ্ঞানী ও খলিফা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। উম্মতে মোহাম্মদীর শিক্ষাব্যবস্থা সূচনা হয় সৃষ্টিকর্তার বাণী-‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক্ব, আয়াত-১) মসজিদে নববীতে অবস্থিত ‘সুফফা’ হলো ইসলামের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র বা বিশ্ববিদ্যালয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন প্রথম শিক্ষক এবং সাহাবিগণ প্রথম ছাত্র। সেখান থেকেই শিক্ষার ইতিহাস শুরু হয়। খোলাফায়ে রাশেদিন, উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে ইসলামি শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং শিক্ষাব্যবস্থা একটি পরিপূর্ণতা লাভ করে। মুসলিম শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসকগণ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন। তারা ইসলামী শিক্ষার বুনিয়াদি কাঠামো দাঁড় করিয়ে ছিলেন। শুধু রাজধানী দিল্লিতেই ১০০০ মাদরাসা ছিল।

প্রফেসর ম্যাক্স মুলারের মতে, ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে শুধু বাংলাতেই ৮০ হাজার মাদরাসা ছিল। ক্যাপ্টেন হেমিলটনের মতে, সিন্ধুর প্রসিদ্ধ ঠাট্টানগরীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং শিল্পকলার চারশত প্রতিষ্ঠান ছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে পরাজয়ের পর উপমহাদেশের মুসলিম শাসনের ইতি ঘটে। সূচনা হয় ইংরেজ শাসন। ইংরেজগণ তাদের শাসনব্যবস্থা দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখার জন্য নীতি প্রয়োগ করে। মূললক্ষ্য ছিল দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে মুসলমানদের মাঝে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করা। ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকেলের সুপারিশকৃত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে দুই বিপরীতমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। তাদের এ নীতি সফলতার সাথে বাস্তবায়ন হয়েছে। ব্রিটিশ আমাদের এ দেশ থেকে চলে গেছে সেই ১৯৪৭ সালে ঠিকই; কিন্তু তাদের সৃষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা আজো অক্ষুণ্ন আছে। এ দীর্ঘ সময়ে পাঠ্যসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আসলেও শিক্ষানীতির মূলকাঠামো আজো অপরিবর্তিত।

ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা পৃথিবীর কোনো ধর্মগ্রন্থে বা মনীষীর বাণীতে পাওয়া যাবে না। কোরআনের প্রথম শব্দই শিক্ষাসংক্রান্ত। সৃষ্টিকর্তা বলেন, পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটবাঁধা রক্ত থেকে। পড়ুন আর আপনার রব মহামহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক্ব, আয়াত- ১-৫) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেরা গুহায় ওহিপ্রাপ্ত হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ফিরে এসে তাঁর সহধর্মিনী খাদিজা রা.-এর নিকট সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষা লাভ করে ঘোষণা করেন- ‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ (ইবনে মাজাহ) অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ) নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে যুদ্ধবন্দি ৭০ জনের মুক্তিপণ হিসেবে ঘোষণা করেন, যারা লেখাপড়া জানেন তারা ১০ জন নিরক্ষর ব্যক্তিকে অক্ষরজ্ঞান দান করে মুক্তি পাবেন। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি সেটা হলো ‘দারুল আরকাম’। বিশিষ্ট সাহাবি আরকাম (রা.) ছিলেন এই ঘরের মালিক। মুসলমান হওয়ার পর তিনি ইসলামের জন্য এই ঘরটি ওয়াকফ করে দেন।

মদিনার মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.)কে শিক্ষক হিসেবে মদিনায় প্রেরণ করেন। তিনি আবু উসামা ইবনে যুরারার বাড়িতে অবস্থান করে কোরআন শিক্ষা দিতেন। সেটিই মদিনার প্রথম শিক্ষালয় হিসেবে পরিগণিত হয়। হিজরতের সময় রাসুল (সা.)-এর বাহন উটনী আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) বাড়িতে গিয়ে থেমে যায়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই বাড়িতে অবস্থান করে প্রায় ৮ মাস শিক্ষাক্রম চালিয়ে যান। মসজিদে নববীর উত্তর পার্শ্বে খেজুর পাতায় ছাউনি দিয়ে একটি আবাসস্থল প্রণয়ন করা হয়। ইসলামের ইতিহাসে ‘সুফফাহ’ নামে পরিচিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল একীভূত শিক্ষাব্যবস্থা। সেখানে কোনো ভেদাভেদ ছিলনা। সকলেই জ্ঞান লাভের সমান সুযোগ পেত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কন্যা-সন্তানদের শিক্ষাদানের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ প্রদান করেছেন। নবীজি ইরশাদ করেন“‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যাসন্তানকে লালন-পালন করবে, তাদেরকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিবে তাদের বিয়ে দিবে এবং তাদের সাথে ভালো আচরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে (আবু দাউদ)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিনী আম্মাজান আয়শা (রা.) শিক্ষা-দীক্ষায় বিরাট অবদান রাখেন। তিনি হাদিস, ফিকাহ শাস্ত্রসহ সব বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তাঁর থেকে ২২১০টি হাদিস বর্ণিত হয়।

ঈমানের পরে ইলমই হলো আল্লাহর নিকট মর্যাদা বৃদ্ধির প্রথম উপায়। সৃষ্টিকর্তা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম বা জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে তাদের মর্যাদা আল্লাহ বাড়িয়ে দেবেন।’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত-১১) ইলম শিক্ষা করার জন্য পথচলা, হাঁটা, কষ্ট করা ইত্যাদিও ইবাদত। এগুলোর মর্যাদা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত বেশি। (বুখারি, মুসলিম) শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে ক্বারীর মর্যাদা সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,  ‘ কোরআনের ক্বারীকে (কেয়ামতের দিন) বলা হবে পড়ুন এবং সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকুন। সুমধুর কণ্ঠে পড়তে থাকুন যেভাবে তারতীলের সাথে দুনিয়াতে পড়েছেন। নিশ্চয় আপনার গন্তব্য হবে সেখানে, যেখানে পড়া শেষ হবে (তিরমিযি, আবু দাউদ )। আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) হতে বর্ণিত- রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যে  কোরআন পড়ল অত:পর মুখস্থ করল এবং হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম মেনে চলল। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করবেন এবং তাকে ওই সমস্ত দশজনকে সুপারিশ করার সুযোগ দেবেন যাদের প্রত্যেকের জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গিয়েছে।’ (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ ও বায়হাকি)

মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় অবদান হলো সৎ ও আদর্শ ব্যক্তি গঠন। পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর ইসলাম ও মুসলমানদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তা থেকে উত্তরণের নিমিত্তে ১৮৬৬ সালের ৩০ মে মাওলানা ক্বাসেম নানুতবী (রহ.) প্রতিষ্ঠা করেন ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ মাদরাসা। স্যার সৈয়দ আমহদ খান স্থাপন করেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭৮১ সালে মুসলমানদের চাপের মুখে আরবি শিক্ষার ব্যবস্থাস্বরূপ কলকাতায় (পশ্চিমবঙ্গে) বর্তমান ঢাকা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা তাহজীব-তমদ্দুন, কৃষ্টি-সভ্যতা, দীন-ঈমান, ইজ্জত-আবরু ইত্যাদি সংরক্ষণে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের অনৈতিক কাজ যেমন-চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ব্যভিচার, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করার মতো নজির পাওয়া যায় না। মাদরাসায় শিক্ষাগ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকুরি করার পাশাপাশি মসজিদে জুমার খুতবা, ওয়াজ মাহফিল, সভা-সেমিনার ও ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সৎভাবে জীবনযাপন করার উপদেশ দেন। তাঁদের উপদেশ শুনে সাধারণ মানুষ সৎভাবে জীবনযাপন করার চেষ্টা করেন। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি মাদরাসাগুলো অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান ও অসহায় এতিম শিশুদের বিত্তবানদের সহযোগিতায় নিরক্ষরতা দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। সৎ ও আদর্শ জাতি গঠনে মাদরাসা শিক্ষার ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আদর্শ জাতি গঠনে ইসলামি শিক্ষা এক অপরিহার্য মাধ্যম।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষার আলো দিয়ে একটি বর্বর ও অশিক্ষিত জাতিকে সুশিক্ষিত, সুশৃঙ্খলিত  ও  সর্বোত্তম জাতিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটিয়ে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে আসা যাতে মাদরাসা শিক্ষার ইসলামী ধ্যান-ধারণা ও পরিবেশের সাথে তেমন কোনো পার্থক্য না থাকে। নৈতিক, আদর্শিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন জনশক্তি উৎপাদনের জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার কোনো বিকল্প নেই। এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থায় অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই সন্তানকে পরিপূর্ণ ইসলামি শিক্ষাদানের যথাযথ ব্যবস্থা করা নৈতিক দায়িত্ব। এটা নবুয়তি কাজের অন্তর্ভুক্ত। পিতা-মাতা সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে পরকালে তাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! যেসব জিন ও মানুষ আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদেরকে দেখিয়ে দাও, আমরা তাদেরকে পদদলিত করব, যাতে তারা যথেষ্ট অপমানিত হয়।’ (সুরা হা-মীম-সিজদা, আয়াত-২৯)

লেখক : শিক্ষার্থী, ভূরারঘাট এম ইউ বহুমুখী ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসা, রংপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads