• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী

  • প্রকাশিত ১৯ মার্চ ২০২১

মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

 

 

 

শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণ দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুন্দর সম্পর্ক। দাতা-গ্রহীতার সম্পর্কের চেয়ে অনেক পবিত্র এ সম্পর্ক। শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থী কেবলই জ্ঞান লাভ করে না, তার উপদেশ ও পরামর্শ থেকে পায় জীবন ও চরিত্র গঠনের মূল্যবান নির্দেশনা। শিক্ষকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ হতে চাইলে তার প্রতি শিক্ষার্থীকে হতে হবে শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত। থাকতে হবে তার ওপর গভীর আস্থা। আর তখনই শিক্ষক শিক্ষার্থীকে সর্বোত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সক্ষম হবেন। এর ফলে সাধিত হবে শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য এবং প্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি হবে সুন্দর পরিবেশ। শিক্ষার্থীর দুর্বিনীত আচরণ শিক্ষককে নিদারুণ হতাশায় ভরে তুলে। বিনিময়ে শিক্ষার্থী কিছুই লাভ করে না। অবাধ্য ও দুর্বিনীত শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে শিখতে পারে না কিছুই, তার অর্জন কেবলই শূন্য।

শিক্ষক মহৎ সেবাদানে নিয়োজিত। তার এ সেবা অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, যেমনি যায় না মাতা-পিতার সেবা সন্তানের প্রতি। মাতা-পিতা সন্তান জন্ম ও প্রতিপালনের গুরু দায়িত্ব পালন করেন আর শিক্ষক তাকে শিক্ষিত করেন। তার হূদয়-মনকে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করেন। তাকে সমাজে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ঐশী বাণী অর্জন করেছেন, সে বাণীর আলোকে তিনি মানবকুলকে মহান রব, মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের নীতিমালা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি স্বয়ং নিজে পরিচয় তুলে ধরে বলেন ‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি’।  (ইবনে মাজাহ,হাদিস নং-২২৫)। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে সে সম্পর্ক তা সকল হীন স্বার্থ ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শিক্ষক কিছু প্রত্যাশা করেন না। শিক্ষক শিক্ষার্থীর মাঝে দেখতে চান জ্ঞানের আলো, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ এবং পরিচ্ছন্ন ও সচেতন মন। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শিক্ষক আশা করেন, সদাচারণ ও সৎস্বভাব। শিক্ষার্থীকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে শিক্ষক আনন্দিত হন। বিপথগামী হতে দেখে ব্যথিত হন। শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষকের যে ব্যাকুলতা, তা না পাওয়ার হতাশা নয়, বরং হারিয়ে যাওয়ার বেদনা, শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত না হওয়া বেদনা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার বেদনা।

শিক্ষার্থীর মাঝে যুগ যুগ বেঁচে থাকেন শিক্ষক। শিক্ষকের জ্ঞান ও দর্শন, শিক্ষা ও জীবনবোধ তার অজান্তে শিক্ষার্থীর মাঝে প্রোথিত হয়। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে কোনো কোনো শিক্ষার্থী  তার প্রিয় শিক্ষকের স্মৃতিচারণ করে। এ প্রিয় শিক্ষকই তার জীবনকে নাড়া দিয়েছে বিরাট করে, প্রভাবিত করেছে প্রবলভাবে। সৎ এবং নিষ্ঠাবান শিক্ষকই কেবল শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত করতে এবং জীবন ও চরিত্র গঠনে তাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। আর এমন শিক্ষকই জাতির কাম্য, সবার কাছে সম্মানীয়। যে শিক্ষক শিক্ষার্থীর সামনে কোনো আদর্শ ও মূল্যবোধ উপস্থাপন ও তা লালনে সক্ষম নন, তিনি কখনোই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না। নীতি ও নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষক কখনো শিক্ষার্থীর আদর্শ ও প্রিয় শিক্ষক হতে পারেন না। কেননা, তিনি শিক্ষার্থীকে যথাযথ শিক্ষিত ও চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন।

মাতা-পিতা তার সন্তানকে শাসন করেন। সেটা যেমন স্বাভাবিক তেমনি স্বাভাবিক ও কাম্য হলো, শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শাসন করা। শিক্ষার্থীকেকে আজকাল শাসন করা যায় না, এমন কথা প্রায়শই শুনা যায়। তা ঠিক নয়। শিক্ষার্থী যথার্থ ক্ষেত্রে, যথাসময়ে তার শিক্ষকের যথার্থ নির্দেশনা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও শৃঙ্খলাবোধ প্রত্যাশা করে ও পছন্দ করে। যতই দুর্বিনীত হোক না কেনো। শিক্ষকের যথার্থ যুক্তি ও ন্যায়বোধের কাছে সে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। পরিবেশ ও প্রতিরোধ তা ক্ষণিকের জন্য বিলম্বিত করে মাত্র। শিক্ষার্থীরা বয়সে তরুণ, স্বভাবে চাঞ্চল্য ও চিন্তায় বিপ্লবী। এদের মধ্যে মুষ্টিমেয় ক্ষেত্রবিশেষে নেতৃত্ব দিতে চায়। কিছু একটা করতে চায়। সবার কাছে তার কৃতিত্ব তুলে ধরতে চায়। যথাযথ পথ নির্দেশের অভাবে এরা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়, হয় বিপথগামী। এদের মধ্যে নেতৃত্ব গ্রহণের ও সমস্যা সমাধানের কিছু প্রতিভা হয়ত আছে। এ সত্য উপলব্ধি করে তাদের প্রতিভা ও কার্যস্পৃহাকে যথাযথ খাতে চালিত করে তাদের মধ্যে যথার্থ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেন। বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’।

শিক্ষকদের নিকট সমাজের প্রত্যাশা অনেক। শিক্ষকগণ সমাজের প্রত্যাশা যত পূরণ করতে পারবেন সমাজও তত সম্মান শিক্ষকদের দেবেন। শিক্ষকেরা শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। তাঁদের শিক্ষার আলো শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে সুদৃঢ় করে। জ্ঞান অন্বেষণের গুরুত্ব ও শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,‘যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?’ (সূরা যুমার: ৯)। সুতরাং সমাজ ও ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে মূল্যবোধ সৃষ্টি করার জন্য শিক্ষক সমাজের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষা বৈষম্য দূর করতে হবে, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তন করতে হবে। মেধাবী, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। মূল্যবোধভিত্তিক সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। যারা শিক্ষকতায় আসবেন তাদের শিক্ষকতা পেশাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ না করে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষকদেরকে সমাজ ও ছাত্রছাত্রীদের সামনে নিজের আদর্শ স্থাপন করতে হবে। কেননা মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য শিক্ষকের ভূমিকাই প্রধান।

শিক্ষকতা শুধু একটি বৃত্তি বা পেশা নয় বরং এটি একটি আরাধনা। আদর্শ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের জ্ঞান ও গুণে মুগ্ধ শিক্ষার্থী শিক্ষককে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। যথার্থ শিক্ষকের কাছ থেকে দেশ আশা করতে পারে অসংখ্য প্রকৃত দেশপ্রেমিক, বিজ্ঞানমনস্ক আলোকিত মানুষ। প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাঝে লুকিয়ে আছে প্রতিভা। সুপ্ত হয়ে আছে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ। তারই যথার্থ বিকাশ ঘটাতে হবে। তাকে উত্তম চরিত্রের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞানানুশীলনে শিক্ষার্থীর আন্তরিক প্রচেষ্টা। কর্তব্য পালনে শিক্ষকের নিষ্ঠা ও সততা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণ শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের সুসমন্বিত বিকাশ।

 

 

লেখক : শিক্ষক,  রসুলপুর জামিয়া ইসলামিয়া ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads