• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
জাহেলিযুগের নীতি বিষয়ে নবীজির কর্মপন্থা

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

জাহেলিযুগের নীতি বিষয়ে নবীজির কর্মপন্থা

  • প্রকাশিত ২৭ মার্চ ২০২১

ইসলামের পূর্বে এই পৃথিবী ছিল জুলুম-অত্যাচার, হত্যা-লুণ্ঠন, ব্যভিচার-মাদক ও সংঘাতেপূর্ণ এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী। কোথাও শান্তি ও নিরাপত্তার কোনো ছোঁয়া ছিল না। শান্তির পরশ পেতে মানুষ উদ্গ্রীব ছিল। এমন সময় আল্লাহতায়ালা মানবমুক্তির দূত হিসেবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আসমানিগ্রন্থ দিয়ে ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণ করলেন। পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ মানবজাতির হেদায়াতগ্রন্থ। মানুষের করণীয়-বর্জনীয় সবকিছুই শরিয়তে বর্ণিত আছে। পৃথিবীকে শান্তিবান্ধব বসবাসযোগ্য করতে আল্লাহতায়ালা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জাহেলি যুগের যাবতীয় আবর্জনা নিশ্চিহ্ন করার আদেশ দেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তবে কি তারা জাহেলি যুগের ফয়সালা লাভ করতে চায়? যারা নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে, তাদের জন্য আল্লাহ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালা দানকারী কে হতে পারে?’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৫০)

কিছু জাহেলি নীতি। যেগুলো ইসলাম পরিপূর্ণ বাতিল করেছে। এক. সর্বপ্রকার শিরক ও কুফুরি কর্মকাণ্ড। আল্লাহ ব্যতীত অপর কাউকে ইবাদতযোগ্য ধারণা করা। জাহেলি যুগের মানুষেরা সর্বস্তরে অসংখ্য জীব-জড়কে ইবাদতযোগ্যে বলে আকিদা পোষণ করত। এই আকিদা সরাসরি কুফুর। কিন্তু প্রথা হিসেবে জনরণ্যে এসব কুফুরি আকিদা বিস্তার লাভ করেছিল। আল্লাহতায়ালার একত্ববাদের ঘোষণা করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহেলি যুগের এসব ভ্রান্ত আকিদা বাতিল সাব্যস্ত করেছেন।

দুই. জাহেলি যুগের মানুষেরা তারকারাজির নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করত। এই প্রথা ব্যাপকভাবে চালু ছিল। অথচ বিষয়টি বড় প্রকারের শিরক। এতে আল্লাহর স্থানে তারকাকে বসিয়ে দেওয়া হয়। তারকাকে সৃষ্টিকর্তা ও দাতা হিসেবে মান্য করা হয়। অথচ বৃষ্টি দেওয়া, না দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহতায়ালারই। ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই প্রথা ও মনোভাবকে বাতিল বলে ঘোষণা করেন।

তিন. বংশ কৌলীন্য, রূপ-সৌন্দর্য ও গোঁড়া অহমিকা প্রদর্শন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘নিজ গৃহে অবস্থান করো, সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহেলি যুগে প্রদর্শন করা হতো’। (সুরা আহজাব, আয়াত- ৩৩) ‘কাফেররা যখন তাদের অন্তরে অহমিকাকে স্থান দিল-যা ছিল জাহেলি যুগের অহমিকা’। (সুরা ফাতহ, আয়াত-২৬) আয়াত অবতীর্ণ হলে নবী (সা.) এসব কঠোরভাবে নিষেধ করেন।

চার. বংশে অপবাদ এবং মৃত ব্যক্তির জন্য কৃত্রিম কান্নাকাটি করা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষের ভেতর দুটি বিষয় এমন রয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষেরা কুফুরে জড়িয়ে যায়। কারো বংশ সম্পর্কে অপবাদ আরোপ এবং মৃত ব্যক্তির জন্য কৃত্রিম কান্নাকাটি করা।’ হাদিস ব্যাখ্যাকারগণ লিখেছেন, এখানে কুফুরিতে জড়িয়ে যাওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য, এ স্বভাব দুটি ইসলামপূর্ব যুগের এবং কুফুরিপ্রথা। ইসলামে বংশ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা ইসলামে পরিপূর্ণ নিষিদ্ধ।

পাঁচ. জাহেলি যুগে গোত্রপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতি ছিল ন্যায়-অন্যায় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। স্বীয় গোত্রের লোকেরা অপরাধ করলেও তারা অপরাধী স্বজনের পক্ষাবলম্বন করত। এটাকেই ইসলাম ‘সামপ্রদায়িক চরমপন্থা’ রূপে সাব্যস্ত করেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোনো প্রকারের অন্যায় বংশপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতিকে শক্ত হাতে প্রতিহত করেছেন। বলেছেন, ‘হে মুসলমান সমপ্রদায়! আমি তোমাদের মাঝে জীবিত থাকাবস্থায় তোমরা জাহেলি যুগের আচরণ করছ?’ (ফাতহুল কাদির : ১/৫৪৮)

ছয়. কিছু বর্বর রীতি। যেমন : অচ্ছুৎ মনে করে কন্যাসন্তান জীবন্ত কবর দেওয়া। অভাবের আশংকায় সন্তান জন্মদান না করা। ধোঁকাপূর্ণ লটারি ইত্যাদি। ইসলাম এসব সমূলে উৎখাত করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দারিদ্র্যের কারণে তোমরা নিজ সন্তানদেরকে হত্যা করো না।’ (সুরা আনআম, আয়াত-১৫১)

সাত. জাহেলি যুগের কতক বিবাহরীতি। যেমন : দশজন পুরুষ একজন মহিলাকে বিবাহ করত। এরপর স্ত্রী সবার সাথে সঙ্গম করার পর সন্তান প্রসব করলে, মহিলার যার প্রতি ভালোবাসা জন্মাত, তার দিকে সন্তানের বংশ নির্ধারিত হতো। আরেক প্রকার বিবাহ ছিল, স্বামী নিজ স্ত্রীকে স্ত্রীর ঋতুকাল শেষে অন্য পুরুষের নিকট গর্ভধারণের জন্য প্রেরণ করত, ইত্যাদি।

আট. জাহেলি কিছু দণ্ডবিধি। যেমন : জাহেলি যুগে ক্ষমতাবানরা দুর্বলের ওপর দ্বিগুণ দণ্ড আরোপ করত। পক্ষান্তরে নিজেরা দুর্বলদেরকে দিত সামান্য। শক্তিশালীদের একজনের বিনিময়ে দুর্বলদের দশজনকে হত্যা করা হতো। কিন্তু দুর্বলদের একজনের বিনিময়ে সবলদের একজনকেই হত্যা করা হতো।

নয়. জাহেলি যুগে ইলার (স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর সাথে সঙ্গম না করার শপথ) মেয়াদ ছিল এক-দুই বছর। ইসলাম এসে ইলার মেয়াদ ঘোষণা করে চার মাস। এরপর স্বামী স্ত্রীকে হয় বিবাহ করে কাফফরা দেবে। না হয় বাদশাহ তাকে তালাক বা ফায় দিতে বাধ্য করবে।

দশ. চক্রাবৃদ্ধি হারে জাহেলি যুগের সুদখোররা সুদ খেত। ইসলাম এসে সর্বপ্রকার সুদকে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ বিক্রিকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত- ২৭৫)

এগারো. জাহেলি যুগে কুরাইশ ও তাদের সমমনা ‘হুমুস’রা নিজেদের মর্যাদা প্রদর্শন করতে হজের মৌসুমে মুজদালিফায় অবস্থান করত। আর অন্যদেরকে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে বাধ্য করত। মুজদালিফায় আসতে দিত না। ইসলাম এসে সবাইকে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে জাহেলি অন্যায় প্রথা বাতিল করে দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সেই স্থান (সবাই একসাথে আরাফার ময়দানে অবস্থান করে সেখান) থেকেই রওয়ানা হবে, যেখান থেকে অন্যরা রওয়ানা হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৯৯)

এছাড়া জাহেলি যুগের আরো অনেক রীতি রয়েছে। লোকেরা যত উপকার আর কল্যাণ বর্ণনা করুক না কেন, শরিয়ত ও মানবস্বভাববিরোধী হওয়ার কারণে ইসলাম এসব নীতিসমূহকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যেমন : মদপান, ব্যভিচার, চুরি, জুয়া, ধোঁকা ও জ্যোতিষবিদ্যা ইত্যাদি। এসব ইসলামে হারাম।

লেখক :মুফতি আমিরুল ইসলাম লুকমান

খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ হরপাড়া, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads