• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯
ইসলামের ওপর অবিচল থাকার উপায়

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ইসলামের ওপর অবিচল থাকার উপায়

  • প্রকাশিত ১০ এপ্রিল ২০২১

বর্তমান সমাজে মৌখিক ঈমানদার আর পরহেজগারের অভাব নেই। কিন্তু অন্তর আর আমলের দিক দিয়ে পাক্কা শয়তানে সয়লাব চতুর্দিক। আমাদের যেই অন্তরে থাকার কথা আল্লাহর ভয় ও স্মরণ এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য ও মহব্বত, সেই অন্তরে আজ ঢুকে গেছে সম্পদের ভালোবাসা। কারো অন্তরে নারীর ভালোবাসা। কারো অন্তরে বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা আর ক্ষমতার ভালোবাসা। আল্লাহতায়ালা কি এজন্য আমাদেরকে অন্তর দান করেছেন? কখনোই না। তাহলে কেন দিয়েছেন? পবিত্র কোরআনে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় ঈরশাদ করেছেন-‘আল্লাহ কোনো মানুষের অভ্যন্তরে দুটি অন্তর সৃষ্টি করেননি।’  (সুরা আহযাব, আয়াত-৪) অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর কোনো মানুষকেই দুটি অন্তর দান করেননি যে, সে তার এক অন্তর আল্লাহকে দেবে, আর আরেক অন্তর নফস ও শয়তানকে  দেবে।

আমাদের অন্তরকে দীনের দিকে ফেরাতে হবে। দুষ্টু শয়তানদের যে ওয়াসওয়াসা বা ধোঁকার বীজ অন্তরে  প্রোথিত আছে তা একেবারে মূলসহ উপড়ে ফেলতে হবে। যখন আমাদের অন্তর থেকে আল্লাহর স্মরণ ও ধ্যান-ধারণা চলে যায় তখন তা মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন আর দীনি কাজ ভালো লাগে না। নামাজ,  তেলাওয়াত, জিকির, দরূদ আর নেক আমলে একদমই অন্তর সায় দেয় না। কিন্তু যখন অন্তর সুস্থ থাকে তখন এসবকিছু করতে অস্থির হয়ে পড়ে। এমনকী জিকিরের বা তেলাওয়াতের আওয়াজে কম্পিত হয়ে ওঠে। ঈমানের জাযবা বা শক্তি বেড়ে যায়। রাত-দিন নিজেকে ইবাদতে, দীনি খিদমাতে, নেক আমলে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে দেখে নিন আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট বর্ণনা। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা এরূপই হয় যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় তখন তাদের অন্তরসমূহ ভীত হয়ে পড়ে, আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায়, আর তারা নিজেদের রবের ওপর নির্ভর করে।’ (সুরা আনফাল, আয়াত-২)

আমাদের অন্তর বা ক্বলবের উদাহরণ হলো এমন একটি গম্বুজের মতো যার চতুর্দিকে অনেকগুলো দরজা আছে এবং ওইসব দরজা দ্বারা অন্তরে বা ক্বলবে বিভিন্ন অবস্থা প্রবেশ করে। অথবা অন্তর এমন একটি লক্ষ্যবস্তুর মতো যার চতুর্দিক হতে তাকে ঘায়েল করার নিশানা করা হয়েছে।  কিংবা অন্তর এমন একটি আয়নার মতো যার ভেতরে একের পর এক বিভিন্ন দৃশ্য প্রবেশ করছে অথবা এমন কোনো হাউসের মতো যার মধ্যে চতুর্দিক হতে বিভিন্ন নালা দ্বারা পানি এসে প্রবেশ করছে। অর্থাৎ, শয়তান আমাদের অন্তরে বা ক্বলবে বিভিন্ন দিক দিয়ে বিভিন্নভাবে প্রবেশ করে, ধোঁকা দেয়। আমাদের নির্মল অন্তরটাতে সে তার রাজত্ব কায়েম করে ফেলে। আমাদেরকে বিভিন্ন কলা-কৌশলে, ভীতি প্রদর্শন করে তার দাস বা গোলাম বানিয়ে ফেলে। যদি আল্লাহর অপার দয়া আর করুণা আমাদের ওপর না থাকতো তাহলে হয়তো আমাদের ঈমানের ঝলমলে ও সুরভিত আঙিনা রেখে পাপের বিদঘুটে অন্ধকার আর দুর্গন্ধযুক্ত ডাস্টবিনে আজীবন পড়ে থাকতে হতো। মহান আল্লাহর অপার কৃপায় আমরা বড় বড় গোনাহ করেও বেঁচে যাই। তাওবা করলে ক্ষমা পেয়ে যাই। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘শয়তান তোমাদেরকে অভাব-অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের পক্ষ হতে ক্ষমা ও বেশি অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়,  সুবিজ্ঞ।’ (সুরা বাকারাহ, আয়াত-২৬৮)

যে আল্লাহ আমাদের প্রতি এতো দয়ালু, এতো ক্ষমাশীল, আমাদের উচিত; আমাদের অন্তর সেই আল্লাহর ভয় ও স্মরণের মধ্যে ইস্তেকামাত বা অবিচল রাখা। সমস্ত দুনিয়া এক দিকে চলে গেলেও তবুও  আমাদের অন্তর যেন আল্লাহ থেকে, রাসুল থেকে, ইসলাম থেকে দূরে সরে না যায়। আজকের এই পুঁজিবাদী সমাজে আমাদেরকে ইসলামের পথে অবিচল থাকার ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে আক্রমণের স্বীকার হতে হয়। কেননা পশ্চিমারা চায় না ইসলামের আলো কখনই কোনোভাবে আবার আমাদের অন্তরে ফিরে আসুক। ওরা চায় না আমরা সেই বদরী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠি। তাই আমাদেরকে ইসলামের পথ থেকে সরিয়ে নিতে, ইসলামকে ধ্বংস করতে তারা বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করছে। যার মাধ্যমে তারা আমাদের অবিচলতাকে  ব্যর্থ করে দিতে তৎপর। আমাদের দীন ইসলাম ও আমাদের আকিদাহকে ধ্বংস করতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তাই আমাদের অন্তরের অবিচলতায় আমরা সীসাঢালা প্রাচীরের মতো হতে হবে।

ইস্তিকামাহ (অবিচল) থাকতে মহান আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে ‘আর জালিমদের প্রতি ঝুঁকবে না। নতুবা তোমাদেরকেও আগুনে ধরবে। আর আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোনো বন্ধু নাই। অতএব কোথাও সাহায্য পাবে না।’ (সুরা হুদ, আয়াত-১১৩) এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, যদি আমরা জালিম শাসকদের ও তাদের প্রভুদের সাথে দীনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আপস করি, তাদের দীন থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করি, তাদের চিন্তা-দর্শন ও আকিদাসমূহের দিকে ঝুঁকে পড়ি বা আকৃষ্ট হই, তাহলে তা আল্লাহর কাছে ইস্তিকামাহ হিসেবে গণ্য হবে না; বরং উপরিউক্ত আয়াতে মুমিনদেরকে আল্লাহ আগুনের ভয় দেখাচ্ছেন। মুমিনরা এক্ষেত্রে বন্ধু হিসেবে কাউকে পাবে না এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বা অন্য কোনো জায়গা থেকে সাহায্যও পাবে না। এছাড়া আমরা যদি ব্যক্তিগতভাবে হারাম কাজে লিপ্ত হই যেমন সালাতে অবহেলা, পরনিন্দা, হারাম সম্পর্ক, অশ্লীলতার চর্চা ইত্যাদি তাহলে আমাদের প্রচেষ্টাও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই আল্লাহতায়ালা সম্মান-মর্যাদা এবং সাহায্য রেখেছেন দীনের ওপর অবিচল থাকার মাঝেই। আমাদের দীনকে আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে। দীন থেকে কোনোভাবেই বিচ্যুত হওয়া যাবে না। অবিচল থাকতে হবে। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘অবিচলতার সাথী হও, সম্মান-মর্যাদার অন্বেষণকারী হয়ো না (মানুষের কাছ থেকে)। কেননা তোমার অন্তর মর্যাদা পেতে চায়, কিন্তু তোমার রব বলেন অবিচলতার (ইস্তিকামাত) মাধ্যমে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করতে।’ (মাদারিজুস সালিকিন ২/১০৬)

অন্তরকে ইসলামের ওপর ইস্তিকামাত বা অবিচল রাখার উপায় :

০১. ইসলামি দাওয়াহ্-এর কাজ করা : আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘সুতরাং আপনি এর (ইসলামের) প্রতিই দাওয়াত দিন এবং হুকুম অনুযায়ী অবিচল (ইস্তিকামাহ) থাকুন। আপনি তাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করবেন না। বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাজিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ আমাদের পালনকর্তা ও তোমাদের পালনকর্তা। আমাদের জন্যে আমাদের কর্ম এবং তোমাদের জন্যে তোমাদের কর্ম। আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে বিবাদ নেই। আল্লাহ আমাদেরকে সমবেত করবেন এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন হবে।’ (সুরা শুরা, আয়াত-১৫)

০২. নেককাজের প্রতিযোগিতা করা : আল্লাহ ইরশাদ করেন, “‘আর সবার জন্যই রয়েছে ক্বিবলাহ্ একেক দিকে, যে দিকে সে মুখ করে (ইবাদত করবে)। কাজেই সৎকাজে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এগিয়ে যাও। যেখানেই তোমরা থাকবে, আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে সমবেত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৪৮)

০৩. নিষ্ঠা (ইখলাস) বজায় রাখা : আমরা যদি সকল কাজে নিষ্ঠাবান হতে পারি, প্রত্যেক কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করার চেষ্টা করি, তাহলে তা দ্বীনের ওপর অবিচল থাকতে আমাদের সাহায্য করবে।

০৪. সাহায্য ও বিজয়ের জন্য প্রচুর  দোয়া করা : আল্লাহর কাছে প্রতিনিয়ত  দোয়া করা, যাতে আল্লাহ মুসলিমদেরকে বিজয়ী করেন এবং দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এবং দীনের ওপর ইস্তিকামাত রাখেন। রাসুল (সা.) অবিচল থাকার জন্য বেশি বেশি এই  দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী। আমার অন্তরকে তোমার দীনের উপর অবিচল রাখো।’ (তিরমিযী, আহমাদ)

০৫. আল্লাহর ওপর ভরসা (তাওয়াক্কুল) রাখা : আমাদেরকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখতে হবে যে, আল্লাহ অবশ্যই বিজয় দান করবেন এবং মুসলিমদেরকে খিলাফতের নিয়ামত দ্বারা সম্মানিত করবেন, যদি আমরা ঈমান আনি ও সৎকাজ করতে থাকি। কেননা তা আল্লাহর ওয়াদা। এতে করে আমরা মানসিকভাবে দৃঢ়পদ থাকার শক্তি অর্জন করব।

০৬. ধৈর্যধারণ (সবর) করা : দীনের ওপর ইস্তিকামাত থাকার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো ধৈর্য। ইসলাম প্রতিষ্ঠায় দাওয়াহ্ করার জন্য পশ্চিমা কুফফার ও তাদের দালালদের মাধ্যমে যে ধরনের বাধার ও অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হবে সে ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধি-বিধানের ওপর অবিচল থাকতে হলে আমাদের ধৈর্যধারণ করতে হবে। আল্লাহ ঈরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য ধারণ করো এবং মোকাবিলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার। (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত-২০০)

০৭. নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াত ও ইসলামী জ্ঞান অর্জন : প্রতিনিয়ত  কোরআন তিলাওয়াত করা ও ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা। যা আমাদের চিন্তাসমূহকে পরিশুদ্ধ করতে সাহায্য করবে এবং আল্লাহর কাছাকাছি যেতে সহায়তা করবে। ফলে ইসলামের ওপর অবিচল থাকা সম্ভব হবে। নতুবা আমরা প্রকৃত ইসলাম থেকে বিচ্যুত হবো। সঠিক ইসলামী জ্ঞানের সচ্ছতাই বিচ্যুতি থেকে রক্ষা পাবার পূর্বশর্ত।

লেখক :হাফিজ শাহ্ আলম সজীব

সিনিয়র শিক্ষক, নয়াবন্দর ইসলামি একাডেমি, বিশ্বনাথ, সিলেট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads