• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯
বিশ্বনবী (সা.)-কে হত্যার অপকৌশল

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

বিশ্বনবী (সা.)-কে হত্যার অপকৌশল

  • প্রকাশিত ১৩ এপ্রিল ২০২১

মুসলমানগণ মদিনায় আগমনের ফলে তাওহিদের দাওয়াতের ভিত্তি আরো মজবুত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। মদিনাবাসীদেরকে মক্কাবাসীদের বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ নিলে তা হবে মক্কাবাসীদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। মক্কার মুশরিকরা এমন উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিপূর্ণ সচেতন ছিল। মক্কার কাফিরদের নিকট রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঠেকানো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। তারা নবীজিকে প্রতিহত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। কিন্তু কীভাবে তাকে ঠেকানো যায় সে বিষয়ে সবাই চিন্তিত। দারুন নদওয়াতে (কুরাইশদের সংসদ ভবন) পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়। সেই বৈঠকে সব কুরাইশ গোত্রের নেতৃবৃন্দকে দাওয়াত দেওয়া হয়। সবাই এতে অংশগ্রহণ করে। দুনিয়ার ইতিহাসে সবচাইতে নিকৃষ্টতম এ পরামর্শ সভার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয় যে, এমন একটি পরিকল্পনা করা যার মাধ্যমে তাওহিদের পতাকাবাহী রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার মাধ্যমে দীন ইসলামের অস্তিত্বকে চিরতরে মুছে ফেলা। এই নিকৃষ্টতম অধিবেশনে যেসব কোরাইশ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-আবু জাহেল, জুবায়ের বিন মুতঈম, তুয়াইমা বিন আদি, হাশেম বিন আমের বনি আবদে শামস, শাইবা বিন রাবিয়াহ, উৎবা বিন রাবিয়া, আবু সুফিয়ান বিন হারব, নজর বিন হারেস, আবুল বুখতারী বিন হিশাম, যাযমা বিন আসওয়াদ, হাকিম বিন হেযাম, বনি আসাদ বিন আব্দুল উযযা, নরিহ বিন হাজ্জাজ ও মুনাব্বা বিন হাজ্জাজ, উমাইয়া বিন খলফ।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সবাই যখন দারুন নদওয়ায় পৌঁছাল তখন ইবলিশ সম্ভ্রান্ত পণ্ডিতের রূপ ধরে অনুপ্রবেশ করে। সে নিজেকে নজদের শাইখ পরিচয় দিয়ে বলল, আমি শুনেছি যে আপনারা এক মহৎ সভার আয়োজন করেছেন। এজন্য আমি উপস্থিত হলাম সম্ভব হলে কিছু পরামর্শ দেব। তথাকথিত গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সভায় উপস্থিত। আলোচনা শুরু হলো। কিছুটা বিতর্কও তৈরি হলো। প্রথমে আবুল আসওয়াদ প্রস্তাব পেশ করল যে,  মোহাম্মদকে আমাদের শহর থেকে বের করে দেওয়া যেতে পারে। অতঃপর সে কোথায় থাকবে, কোথায় যাবে তার ব্যাপার। তার সাথে আমাদের কোনো রকম সম্পর্ক থাকবে না। এতে করে আমাদের আর কোনো সমস্যা থাকবে না। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করতে পারব। সে আমাদের মধ্যে আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আবুল আসওয়াদ প্রস্তাবটি শেষ করতে না করতেই নজদের শাইখ (ইবলিশ) বলে উঠলো, আল্লাহর কসম! এটা কোনো ভালো প্রস্তাব হলো না। তাছাড়া তোমরা দেখতেই পারছ যে, তার কথা কত চমৎকার এবং বাগধারা কতটা মিষ্ট। সে কীভাবে মানুষের মন জয় করে চলছে? আল্লাহর কসম! তোমরা যদি তাকে দেশান্তর করো, তবে সে অন্য কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেবে। সেখানে জনমত তৈরি করে বিপুল সংখ্যক অনুসারী তৈরি করবে। অতঃপর তাদের সাথে সখ্যতা করে তোমাদের শহরে আক্রমণ করবে এবং তোমাদের কোণঠাসা করবে। তাতে করে সবকিছুই তার ইচ্ছা অনুযায়ী হবে। সুতরাং এটা কোনো সমাধানের পথ হতে পারে না। তাই ভিন্ন কোনো পথ চিন্তা করো।

আবুল বুখতারি বলল, মোহাম্মদকে শক্ত শিকলে বেঁধে বন্দি অবস্থায় তালাবদ্ধ ঘরে ফেলে রাখা হোক। অবশ্যম্ভাবী পরিণতির জন্য (মৃত্যুর) অপেক্ষা করতে থাকবো। যেমনটি যুহাইর, নাবেগা ও অন্যান্য কবিদেরকে রাখা হয়েছিল। এবারও ইবলিশ আপত্তি করল যে, আল্লাহর কসম! এই প্রস্তাব সঙ্গত মনে হচ্ছে না। কারণ কোনো না কোনোভাবে তার সঙ্গীদের নিকট খবর পৌঁছে যাবে। তখন তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করে তাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে এবং তোমরা পরাজয় বরণ করবে। সুতরাং এ প্রস্তাবও সমর্থনযোগ্য মনে হচ্ছে না; বরং ভিন্ন কোনো রাস্তা বের করা প্রয়োজন। পরপর যখন দুইটা প্রস্তাব বাতিল বলে বিবেচিত হলো।

এবার অভিশপ্ত, কুখ্যাত আবু জাহেল বলল, এ ব্যাপারে আমার একটি অভিমত রয়েছে। আমি লক্ষ করছি যে, কেউই সে লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। উপস্থিত সকলে বলল আবুল হাকাম সেটা কি? সে বলল, আমার প্রস্তাব হলো-প্রত্যেক গোত্র থেকে সুঠামদেহী ও শক্তিশালী যুবক নির্বাচন করা হোক। প্রত্যেককে একটি করে ধারালো তরবারি দেওয়া হোক। অতঃপর সবাই তার দিকে অগ্রসর হয়ে অতর্কিতভাবে হামলা করে তাকে হত্যা করুক। যার দরুন আমরা সবাই তার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে যাবো। আর এভাবে হত্যা করার ফলে এই হত্যার দায় সব গোত্রের ওপর বর্তাবে। ফলে বিশেষ একটি সুবিধা হবে যে, বনু আবদে মানাফ একা সবার সাথে যুদ্ধ করতে সক্ষম হবে না। যার কারণে দিয়ত (খুনের বদলা একশত উট) গ্রহণে রাজি হবে। আমরা সব গোত্র মিলে তা দিয়ে দেব এতে করে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। এবার ইবলিশ আর কোনো আপত্তি না করে বললো, এটা গ্রহণযোগ্য। আর কোনো কথা বা খেয়াল আসলে তারপরও এটা বহাল থাকবে। দারুন নদওয়ার নিকৃষ্টতম অধিবেশন এমনই এক কাপুরুষোচিত, ঘৃণ্য ও জঘন্য সিদ্ধান্তে সমাপ্তি ঘটলো। সবাই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ হয়ে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করল।

এদিকে জিবরাইল আমীন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহির মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের কথা অবগত করলেন, তিনি বললেন, ‘আপনার প্রভু আপনাকে মক্কা ছাড়ার অনুমতি প্রদান করেছেন। আপনি এযাবৎ যে বিছানায় শয়ন করেছেন আজ রাতে সে বিছানায় শয়ন করবেন না।’ এই কথার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হিজরতের সময় জানিয়ে দেওয়া হলো। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ঠিক দুপুরে মাথা মোবারক ঢেকে হজরত আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহু-এর বাড়িতে তাশরিফ আনলেন। হজরত আবু বকরের (রা.)-এর সাথে হিজরতের সময় ও বিভিন্ন পন্থা নিয়ে আলোচনা করে নিজ গৃহে ফিরে এলেন। রাতের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এদিকে পাপিষ্ঠরা নদওয়ার গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে দিল। তাদের জঘন্যতম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ১১ জন পাপিষ্ঠ, নালায়েককে নির্বাচন করল। আবু জাহেল বিন হিশাম, উকবা বিন আবু মুয়িত, উমাইয়া বিন খলফ, তুয়াইমা বিন আদী, উবাই বিন খলফ, মুনাব্বাহ বিন হাজ্জাজ, হাকাম বিন আস, ইসার বিন হারেস, যাময়াহ বিন আসওয়াদ, আবু লাহাব, হুবাইহ বিন হাজ্জাজ এবং তার ভাই। সন্ধ্যালগ্ন শেষ হওয়ার পর রাতের অন্ধকার যখন চতুর্দিকে ছেয়ে গেল। পাপিষ্ঠরা তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাড়ির আশপাশে ওঁৎপেতে রইল। রাসুলুল্লাহ (সা.) শুয়ে পড়লেই তারা প্রিয় নবীজির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। অভিশপ্ত আবু জেহেল ঘেরাওকারী পাপিষ্ঠদের সাথে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করে যা তা বলতেছিল। তারা বিজয়ী হবে বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে ছিল। কিন্তু আল্লাহ যাকে বিজয়ী করতে চান সেই কেবল বিজয়ী হয়। তিনি যাকে বাঁচাতে চান কেউ তাকে মারতে পারেনা। পক্ষান্তরে তিনি যাকে পাকড়াও করতে চান পৃথিবীর কোনো মহাশক্তি তাকে রক্ষা করতে পারেনা ।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুশরিকদের বেষ্টনীর মধ্যেও হজরত আলীকে সবুজ হাযরামা চাদর জড়িয়ে নবীজির বিছানায় শুইয়ে দিলেন। বললেন, তোমার ভয় নেই। তারা কিছুই করতে পারবে না। অতঃপর প্রিয় নবীজি গৃহের বাইরে বের হয়ে এক মুষ্টি মাটি ছিটিয়ে দিলেন মুশরিকদের ওপর। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের দৃষ্টিশক্তি আটকে দিলেন। ফলে তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতে পেল না। এ সময় কোনো মুশরিক বাকি ছিল না যে, তাদের মাথায় বালুকণা যায়নি। অতঃপর হজরত আবু বকরের গৃহে প্রবেশ করে তাকে নিয়ে ইয়েমেন অভিমুখে রওনা হলেন। রাতের অন্ধকার থাকতেই তারা মক্কা থেকে বেশ কিছুদূর ‘সাওর’ নামক পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিলেন। এদিকে ঘেরাওকারী পাপিষ্ঠরা প্রিয় নবীজিকে হত্যার উম্মত্তায় উম্মত্ত হয়ে সুবর্ণ সুযোগের অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলো। কিন্তু এক ব্যক্তির খবরের মাধ্যমে যখন রাসুলুল্লাহর হিজরতের খবর জানতে পেরে তারা সবাই হতচকিত হয়ে পড়লো। দৌড়ে গিয়ে নবীজি (সা.)-এর ঘরের কাছে গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল যে, তিনি চাদর গায়ে শায়িত অবস্থায় রয়েছে। তারা বলল, আল্লাহর কসম! মোহাম্মদ শুয়ে রয়েছে। পাপিষ্ঠরা ঘরে প্রবেশ না করার কারণে হজরত আলী (রা.)কে রাসুলুল্লাহ মনে করলো।

সকাল হলো। হজরত আলী চাদর সরিয়ে বিছানা থেকে উঠলেন। তখন কুফফাররা বুঝতে পারল যে ব্যাপারটা কী ঘটেছে। তারা রাগান্বিত হয়ে আলীকে জিজ্ঞেস করল, মোহাম্মদ কোথায়? হজরত আলী বললেন, আমি জানিনা। অতঃপর তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খোঁজতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। একেবারে রাসুলের নাকের ডগায় গিয়েও প্রিয় নবীজিকে দেখতে পেল না। অতঃপর তারা হতাশ হয়ে ফিরে এলো। তাওহিদের পতাকাবাহী বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অক্ষত অবস্থায় মদিনায় হিজরত করলেন।

লেখক : মোহাম্মদ শরীফ

শিক্ষার্থী, আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া হামিউচ্ছুন্নাহ মেখল, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads