• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ইতেকাফের ফজিলত ও বিধিবিধান

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ইতেকাফের ফজিলত ও বিধিবিধান

  • প্রকাশিত ০৩ মে ২০২১

আজ ২০ রমজান। আজ সন্ধ্যা থেকে রমজানের সুন্নাত ইতেকাফ শুরু। রমজানের বিশ রোজার সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ থেকে নিয়ে ঈদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত ইতেকাফ করাকে সুন্নাতে কেফায়া বলে। এটা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময়ই আদায় করতেন। আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্য পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। এরপর তার পুণ্যবতী জীবন সঙ্গিনীগণও ইতেকাফ করেছেন। (বুখারি হাদিস নং-২০২৬; মসলিম, হাদিস নং-১১৭২) এই ইতেকাফ মহল্লাবাসীর মধ্য হতে যে কোনো একজন আদায় করলে পুরো মহল্লাবাসীর পক্ষ হতে আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ আদায় না করলে মহল্লার সবাই সুন্নাত ইতেকাফ ছেড়ে দেওয়ার গুনাহগার হবে।

ইবাদতের মাস রমজান মাস। আল্লাহর রহমত, মাগফেরাত, নাজাতবেষ্টিত এই মাস। বেশি বেশি আমল করে নিজের নেকির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার মাস। এই মাসের প্রধান আমল হচ্ছে রোজা আদায় করা। এর পাশাপাশি আরো কিছু আমল রয়েছে। তন্মধ্যে ইতেকাফের ফজিলত  অন্যতম। যার ফজিলত অনেক। ইতেকাফ হলো, নির্ধারিত সময়ে জাগতিক কাজকর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে অনেকটা বিছিন্ন হয়ে শুধু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে রাজি-খুশি করার নিয়তে পুরুষের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা হয় এমন মসজিদে এবং মহিলার জন্য ঘরের এক কোণের নির্দিষ্ট স্থানে ইবাদত করার উদ্দেশ্যে অবস্থান করা বা আবদ্ধ হয়ে থাকা। ইতেকাফ করার সর্বোত্তম জায়গা হলো মসজিদুল হারাম। এরপর মসজিদে নববী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এরপর হচ্ছে মসজিদুল আকসা। এরপর জামে মসজিদ। তারপর ওই সব মসজিদ যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা হয়। কোরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরকে [বায়তুল্লাহকে] পবিত্র করো তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১২৫) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে দশ দিন ইতিকাফ করবে, তার এই ইতেকাফ নেকী ও শ্রেষ্ঠত্বের বিবেচনায় দুটি হজ্ব ও দুটি ওমরার সমপর্যায়ের হবে।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদিস নং-৩৬৮০, ৩৬৮১)

ইতেকাফের উদ্দেশ্য : ইতেকাফের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহরাব্বুল আলামীনের একান্ত সান্নিধ্য অর্জন করা। সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক কায়েম করা। নিজেকে গুনাহ মুক্তির জন্য চেষ্টা করা। সর্বোপরি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকমতো জামাতের সঙ্গে সহজে আদায় করা। আর রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফের বিশেষ উদ্দেশ্য হলো, শবে কদরের মহান রাত্রির ফযিলাত পরিপূর্ণভাবে পেয়ে যাওয়া। কেননা, শবে কদরের রাত সুনির্ধারিত নয়। বরং হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে শবে কদর হয়ে থাকে। তাই শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর খোঁজার জন্য উত্তম একটি ব্যবস্থা হলো ইতেকাফ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত তালাশ কর।’ (সহিহুল বুখারি, হাদিস নং- ২০১৭)

ইতেকাফের শর্তাবলি : নিম্নোক্ত শর্তাবলি ছাড়া ইতেকাফ সহিহ হবে না। নিয়ত করা। মুসলমান হওয়া। জ্ঞানবান হওয়া। রোজা রাখা, মানত এবং সুন্নাত ইতেকাফ হলে। নফল ইতেকাফ হলে রোজা রাখা জরুরি না। নারীদের জন্য হায়েয-নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া।’ (ফাতাওয়ায়ে শামী-৩/৪৩০)

যেসব প্রয়োজনে ইতেকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারবেন : ইতেকাফকারী ব্যক্তি ‘শরয়ী জরুরত’, ‘মানবীয় জরুরত’ বা একান্ত জরুরি প্রয়োজন হলে মসজিদ থেকে বের হতে পারবেন। যেমন : ১. মলত্যাগ করার জন্য। ২. ফরজ গোসল করার জন্য, যদি মসজিদে সম্ভব না হয়। কিন্তু ফরজ গোসল ছাড়া অন্য যে কোনো গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতেকাফ ভেঙে যাবে। হ্যাঁ এটা করা যেতে পারে যে, ঠাণ্ডার জন্য, জুমার দিন জুমার জন্য গোসল করতে চাইলে মসজিদের সীমানার ভেতরে থেকে শরীরে তাড়াতাড়ি হালকা পানি দিয়ে নিতে পারবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেনো মসজিদের ভেতর পানি না যায়। ৩. অযু করার জন্য, যদি মসজিদের সীমানার ভেতর থেকে সম্ভব না হয়। ৪. খাবার আনার জন্য বাড়িতে যাওয়া, যদি খাবার এনে দেওয়ার কেউ না থাকে। ৫. মোয়াজ্জেন আজান দেওয়ার জন্য। ৬. যেই মসজিদে ইতেকাফ অবস্থায় আছে সেই মসজিদ জুমার মসজিদ না হলে জুমা আদায় করার জন্য। ৭. মসজিদের ক্ষয়ক্ষতি হলে, জালেম মসজিদ থেকে বের করে দিলে তিনি সেই মসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য মসজিদে গিয়ে ইতেকাফ করতে পারবেন। উল্লেখ, জানাজা পড়া এবং রোগী দেখার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না।

যেসব কারণে ইতেকাফ ভেঙে যায় : ১. যেসব জরুরতের কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া যায় সেসব ক্ষেত্রে  বের হয়ে বাইরে সেই জরুরত ছাড়া একটু বেশি সময় অবস্থান করলে। ২. শরয়ী জরুরত ছাড়া মসজিদ থেকে বের হলেই ইতেকাফ ভেঙে যাবে। চাই তা ইচ্ছে করে হোক অথবা ভুলে হোক। ৩. ইতেকাফকারী ব্যক্তি মসজিদের সীমানা মনে করে বের হয়েছে, পড়ে জানতে পারলো এটা মসজিদের সীমানার বাইরে ছিল তাহলে সেক্ষেত্রেও ইতেকাফ ভেঙে যাবে। ৪. ইতেকাফের জন্য রোজা শর্ত। তাই কেউ যদি রোজা ভেঙে ফেলে তাহলে তার ইতেকাফও ভেঙে যাবে। ৫. স্ত্রীর সাথে সহবাস করলে। ৬. স্ত্রীকে চুমু বা স্পর্শ করলে যদি ‘মনি’ বের হয়, তাহলে সেক্ষেত্রেও ইতেকাফ ভেঙে যাবে। ৭. অযুর কারণ ছাড়া শুধু এমনিতেই ব্রাশ, মেসওয়াক করতে বের হলে। ৯. খাবার খাওয়ার পর হাত পরিষ্কার করার জন্য বের হলে ইতেকাফ ভেঙে যাবে। ইত্যাদি...

ইতেকাফ ভেঙে গেলে করণীয় : ১. কোনো ব্যক্তির যদি সুন্নাত ইতেকাফ ভেঙে যায় তাহলে সেই ব্যক্তি শুধু ওই দিনের ইতেকাফ কাযা করবে। পুরো দশ দিনের কাযা করতে হবে না। তবে যেদিন কাযা করবে সেদিন রোজাও রাখতে হবে। ২. কোনো কারণে ইতেকাফ ভেঙে গেলে উচিত মসজিদই অবস্থান করা। সুন্নাত ইতেকাফ না হলেও নফল ইতেকাফের ফজিলত পাওয়া যাবে।

ইতেকাফ ভাঙা জায়েজ যে কারণে : ১. ইতেকাফকারী যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, যার চিকিৎসা মসজিদের বাইরে যাওয়া ছাড়া সম্ভব নয়। তবে তার জন্য ইতেকাফ ভেঙে দেওয়ার অনুমতি আছে। (শামী) ২. বাইরে কোনো লোক ডুবে যাচ্ছে বা আগুনে দগ্ধ হচ্ছে তাকে বাঁচানোর আর কেউ নেই, অনুরূপ কোথাও আগুন লেগেছে, নেভানোর কেউ নেই তবে অন্যের প্রাণ বাঁচানোর এবং আগুন নেভানোর জন্য ইতেকাফকারীর ইতেকাফ ভেঙে দেওয়ার অনুমতি আছে। ৩. জোরপূর্বক মসজিদ থেকে ইতেকাফকারীকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। ইতেকাফ ভেঙে দেওয়া জায়েজ। সেরূপ ইতেকাফকারীর যদি এমন সাক্ষ্য দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে, যা শরিয়তানুযায়ী তার জন্য ওয়াজিব সেরূপ সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ইতেকাফ ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি আছে। ৪. মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির কঠিন অসুস্থতার কারণেও ইতেকাফ ভেঙে দেওয়া জায়েজ। তেমনি পরিবারের কারো প্রাণ, সম্পদ বা ইজ্জত আশঙ্কার সম্মুখীন হলে এবং ইতেকাফ অবস্থায় তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে ইতেকাফ ভেঙে দেওয়া জায়েজ। ৫. এছাড়া যদি কোনো জানাজা হাজির হয় এবং জানাজা পড়ানোর কেউ না থাকে তখনো ইতেকাফ ভেঙে দেওয়া জায়েজ।’ (ফতহুল কবীর)

ইতেকাফ অবস্থায় করণীয় : ইতেকাফ অবস্থায় ভালো এবং নেক কথা বলা। অতিরিক্ত কথাবার্তা না বলা। বেকার বসে না থেকে নফল নামাজ পড়া কোরআন তেলাওয়াত করা। তাসবিহ-তাহালিলে মশগুল থাকা। বেশি বেশি দোয়া করা। আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করা। শবে কদরের রাত্র খোঁজ করা। তবে ইতেকাফ অবস্থায় বিশেষ কোনো ইবাদত নেই। তাই যে কোনো ইবাদত মন চাইলে করা যাবে। ইতেকাফ অবস্থায় চুপ থাকলে সওয়াব হয় এই মনে করে চুপ থাকা মাকরূহে তাহরিমি। বেচাকেনা করা মাকরূহ। তবে একান্ত প্রয়োজনে মসজিদে মালামাল উপস্থিত করা ব্যতীত বেচাকেনার চুক্তি করা যাবে।

মহিলাদের ইতেকাফ : ইতেকাফের ফজিলত শুধু পুরুষদের জন্য নির্ধারিত নয়। মহিলাদের জন্যও রয়েছে এর ফজিলত। ১. মহিলারা মসজিদে ইতেকাফ করতে পারবে না। তারা ঘরের একটি জায়গাকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করে সেখানে অবস্থান করবে। ২. বিবাহিত মহিলা হলে স্বামীর অনুমতি নিয়ে ইতেকাফে বসতে হবে। ৩. মাসিক দিনগুলো থেকে পবিত্র হয়ে ইতেকাফে বসতে হবে। অর্থাৎ মহিলা খেয়াল করবে যে, ইতেকাফের দিনগুলোতে তার মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা। ৪. কোনো মহিলা ইতেকাফ শুরু করে দেওয়ার পর মাসিক শুরু হলে ওইদিনের ইতেকাফ ভেঙে যাবে এবং সেইদিনের ইতেকাফ কাযা করতে হবে। ৫. মহিলা ঘরের যেই জায়গায় ইতেকাফে বসবে সেই জায়গা তার জন্য মসজিদের হুকুমে হবে। সুতরাং কোনো শরয়ী বা একান্ত মানবীয় জরুরত ছাড়া সেখান থেকে বের হলে তার ইতেকাফ ভেঙে যাবে। ৬. পুরুষদের জন্য যেসব কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ আছে তেমনিভাবে সেই সব কারণে মহিলাদের জন্যও ঘরের সেই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বের হওয়া জায়েজ আছে। যেসব কাজ করলে পুরুষের ইতেকাফ ভেঙে যায়, একজন ইতেকাফকারী মহিলা সেই কাজ করলেও তার ইতেকাফ ভেঙে যাবে।

আমাদের সমাজে মহিলাদের এই ফজিলতের কাজটি করতে কম দেখা যায়। এক্ষেত্রে তাদের অবহেলা দেখা যায়। যাদের বিশেষ কোনো জরুরত নেই তাদের জন্য ইতেকাফে বসে ইবাদতে কাটিয়ে দিয়ে উল্লিখিত ফজিলতগুলো পাওয়াই কাম্য। আবার অনেক এলাকায় দেখা যায়-কেউ মসজিদে ইতেকাফে বসে না বিধায় এলাকার কোনো এক ব্যক্তিকে সবাই টাকা দিয়ে মসজিদে বসায়। যা কোনোভাবেই জায়েজ নয়। এভাবে ইতেকাফে বসালে ইতেকাফ আদায় হবে না উল্টো গুনাহগার হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে পবিত্র মাহে রমজানে মসজিদে ইতেকাফ করার মাধ্যমে গুনাহের পাপরাশি থেকে বেঁচে থেকে অশেষ নেকি লাভের মোক্ষম সুযোগ দান করুন।

লেখক : মুহাদ্দিস, দারুল উলুম মোহাম্মদপুর কওমি মাদরাসা।

চাটমোহর, পাবনা

osmangoninomani@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads